২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আডিয়ালা কারাগার

নওয়াজ শরিফ - ফাইল ছবি

নওয়াজ শরিফকে রাওয়ালপিন্ডির আডিয়ালা কারাগারে বন্দী করা হয়েছে। ১৩ জুলাই রাতে লন্ডন থেকে ফিরে আসার পর তাকে এই কারাগারে প্রেরণ করা হলে তার কিছু সমালোচক ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের জন্য এটা কোনো অসাধারণ বিষয় ছিল না। কেননা নির্বাচনের কিছু দিন আগে কোনো রাজনীতিবিদকে কারাগারে বন্দী করার ঘটনা আমাদের ইতিহাসে সহজেই খুঁজে পেতে পারি। যে নির্বাচনে নওয়াজ শরিফকে জোর করে এক বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেয়া হয়েছিল, সেটি ২৪ অক্টোবর, ১৯৯০ সালে হয়েছিল। আর ওই নির্বাচনের মাত্র দুই সপ্তাহ আগে আসিফ আলী জারদারিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ওই সময় পর্যন্ত জারদারি নিয়মিত রাজনীতিতে জড়াননি। কিন্তু তার গ্রেফতারি তাকে রাজনীতিবিদ বানিয়ে দেয়।

তিনি কারাগার থেকেই নির্বাচনে লড়াই করে জয়লাভ করেন। নওয়াজ শরিফকে আগামী ২৫ জুলাই নির্বাচনের ১২ দিন আগে গ্রেফতার করা হলো। তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন না। কিন্তু তিনি যদি নির্বাচনের আগে জামিনে মুক্তি পেয়ে যেতেন, তাহলে কমপক্ষে চৌধুরী নেসার আলী খানের জন্য নির্বাচনে সফল হওয়া কঠিন হয়ে যেত। ১৭ জুলাই ইসলামাবাদ হাইকোর্টে নওয়াজ শরিফের জামিনের আবেদনের ওপর কার্যক্রম শুরু হয় এবং তা ৩০ জুলাই পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে। এত দীর্ঘ সময়ক্ষেপণে বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন, তবে আমি কোনো আইনি তর্কে লিপ্ত হচ্ছি না। আমার ক্ষুদ্র মতে, ২৫ জুলাইয়ের আগে নওয়াজ শরিফকে জামিনে মুক্তি দেয়া হলে নির্বাচনের কিছুটা হলেও মানসম্মান অবশিষ্ট থাকত। এটা বেশ কঠিন হলে, কমপক্ষে শুনানিকে অল্প সময়ের জন্য মুলতবি করা যেতে পারত। তবে এ শুনানিকে কয়েক দিনের জন্য মুলতবি করে নওয়াজ শরিফের প্রতি সহানুভূতি বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

কিছু মানুষ ২৫ জুলাইয়ের জাতীয় নির্বাচনকে স্থগিত করাতে তৎপরতা চালিয়েছিল। নির্বাচন স্থগিত হয়নি। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে ২৫ জুলাইয়ের আগেই এ নির্বাচনের কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। কমপক্ষে ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ দল নির্বাচনের আগে ‘পলিটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’য়ের অভিযোগ উত্থাপন করে চলেছে। মুসলিম লীগ (এন) ও পিপলস পার্টি ছাড়াও মুত্তাহিদা মজলিসে আমলের প্রধান মাওলানা ফজলুর রহমান, এএনপি প্রধান ইস্ফান্দিয়ার ওয়ালি খান ও বিএনপি প্রধান আখতার মেঙ্গালের পাশাপাশি এমকিউএমসহ পাকিস্তানের আরো বেশ কিছু নেতাও এ অভিযোগ করছেন যে, একটি বিশেষ দলকে সুবিধা দেয়ার চেষ্টা চলছে, অথবা, পছন্দ মাফিক ব্যক্তিকে জেতানোর ছক করা হচ্ছে। কেউ মানুন আর না মানুন, ১৯৯০ সালের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে। ভুলে যাবেন না, ২০০২ সালে বেনজির ভুট্টো ও নওয়াজ শরিফ পাকিস্তানে ছিলেন না। আদালত ও মিডিয়া স্বৈরশাসক পারভেজ মোশাররফের পকেটে ছিল। তার পরেও ১০ অক্টোবর, ২০০২ সালের নির্বাচনে সব রাষ্ট্রীয় দফতর মিলেও মুসলিম লীগকে (কিউ) নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এনে দিতে পারেনি।

১৮ ফেব্র“য়ারি, ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের দিনগুলোতে আমার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। মোশাররফ সরকার সে নির্বাচনের আগে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারে কিছু টিভি ব্যক্তিত্বকে যুক্ত করেছিল। আর কিছু টিভি ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপট থেকে গায়েব করে দেয়। তবুও মোশাররফ সরকার কাক্সিক্ষত ফলাফল অর্জন করতে পারেনি। ১১ মে, ২০১৩ সালের নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ শুধু তেহরিক-ই-ইনসাফ ও পিপলস পার্টি থেকেই উত্থাপিত হয়নি, বরং মুসলিম লীগের (এন) পক্ষ থেকেও উঠেছিল। কিন্তু চিফ জাস্টিস নাসিরুল মুলকের সামনে কিছুই প্রমাণ করা যায়নি। এখন নাসিরুল মুলকই তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী। এদিকে, ২৫ জুলাইয়ের নির্বাচনের আগেই অনিয়ম নিয়ে হইচই শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও ২৫ জুলাই ওই ফলাফল পাওয়া যাবে না, যার ভবিষ্যদ্বাণী করা হচ্ছে। নির্বাচনের পর আপনারা এমন কিছু লোককে কাঁদতে ও চিৎকার করতে দেখতে পাবেন, যারা আজকাল অন্য কারো শক্তির বলে জয়ের উল্লাস করে বেড়াচ্ছেন। বুদ্ধিমত্তার সাথে কর্ম সাধিত না হলে ২৫ জুলাইয়ের পর পাকিস্তানে এক বড় রাজনৈতিক ঝড় উঠবে এবং যদি মুসলিম লীগ (এন), পিপলস পার্টি, এমএমএ, এএনপি ও অপর কিছু গুরুত্বপূর্ণ দল এক হয়ে যায়, তাহলে এবার না কাজে আসবে কিউ লীগ, না কোনো উপকার করতে পারবে জিপওয়ালা (আর্মি)। দু’টি রাষ্ট্রীয় দফতরকে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে কারাগারে প্রেরণ করতে হবে। ছোট হয়ে যাবে আডিয়ালা কারাগার।

রাজনীতির লোকদের কারাগারে বন্দী করলে পাকিস্তানের সমস্যার সমাধান হবে না। বন্দী করা সমস্যার কোনো সমাধান নয়। আমার স্মরণে আছে, ১৯৯৩ সালে বেনজির ভুট্টো দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি এফআইএ’র কর্মকর্তা রেহমান মালিককে শরিফ ভ্রাতাদের পিছে লাগিয়ে দেন। শাহবাজ শরিফকে গ্রেফতার করে আডিয়ালা কারাগারে বন্দী করা হয়। কখনো কখনো শাহবাজ শরিফের সাথে সাক্ষাৎ করতে আডিয়ালা কারাগারে যেতাম। তিনি বলতেন, কারাগারে তার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করা হয়।

ওই সময় চৌধুরী শুজায়াত হুসাইন ও পারভেজ ইলাহীর সাথেও ওই কারাগারে সাক্ষাৎ হতো। একদিন ইসলামাবাদের পাঞ্জাব হাউজে গভর্নর, চৌধুরী আলতাফ হুসাইনের কাছে বসেছিলাম। তখন এক ব্যক্তি এলেন এবং আমাদের সামনে এক দস্তাবেজ রাখলেন। গভর্নর সাহেব দস্তাবেজে চোখ বুলালেন এবং বললেন, পাঁচ নয়, সাত বছর। আগন্তুক ব্যক্তি বিনয়ের সাথে দস্তাবেজ ফেরত নিলেন এবং চলে গেলেন। জানা গেল, তিনি একজন জজ সাহেব, যিনি কালাশনিকভ মামলায় শেখ রশিদ আহমদের দণ্ড লিখে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু গভর্নর সাহেব কম দণ্ডে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। পরদিনই আমি ও আমির মতিন আডিয়ালা কারাগারে পৌঁছি এবং শেখ রশিদ আহমদকে বলি, আপনার সাত বছরের দণ্ড হতে যাচ্ছে। শেখ সাহেব কারাগার থেকে নওয়াজ শরিফকে খবর দেন, আমার দণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন। নওয়াজ চুপ থাকেন। ১৯৯৭ সালে নওয়াজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী হলে সিনেটর সাইফুর রহমান জাস্টিস মালিক কাইউমের মাধ্যমে আসিফ জারদারি ও বেনজির ভুট্টোর বিরুদ্ধে রায় পেলেন। কিছু দিন পর সাইফুর রহমানকেও আডিয়ালা কারাগারে জারদারির সাথে বন্দী করা হয়। এরপর আমার অপরাধী চোখ মোশাররফের শাসনামলে আদালতের জবাবদিহিতার সময় ওই দৃশ্যও দেখেছে, যখন সাইফুর রহমান ধড়াস্ করে আসিফ জারদারির পায়ে পড়ে যান এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেন, আমি নওয়াজ শরিফের চাপে পড়ে আপনার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা সাজিয়েছিলাম।

আডিয়ালা কারাগারে জাভেদ হাশেমির সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে ওখানে ইউসুফ রেজা গিলানির সাথে সাক্ষাৎ হতো। রেহমান মালিকও ওই আডিয়ালা কারাগার থেকে আমাকে পত্র লিখতেন। যে ১ নম্বর কুঠরিতে রেহমান মালিক সময় পার করেছেন, সেখানে আসিফ জারদারি, শাহবাজ শরিফ ও শেখ রশিদও সময় পার করেছেন। এখন ওই ১ নম্বর কুঠরিতে নওয়াজ শরিফকে বন্দী করা হয়েছে। আডিয়ালা কারাগারের উইমেন উইংয়ে মরিয়াম নওয়াজ বন্দী হয়ে আছেন। এটা ওই স্থান, যেখানে আয়ান আলীকে বন্দী করা হয়েছে। ক্যাপ্টেন সফদার এ কথায় বেশ খুশি যে, তার এমন এক কারাগারে সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছে, যেখানে মমতাজ কাদেরী বন্দী জীবন অতিবাহিত করেছেন। আডিয়ালা কারাগারে রাজনৈতিক নেতাদের আসা-যাওয়া লেগেই থাকে। নেতারা যখন ক্ষমতায় থাকেন, তখন কারাগারের বাথরুম উন্নত করার দিকে মনোযোগ দেন না। যখন কারাগারে বন্দী হন, তখন বাথরুমের নোংরা অবস্থা দেখে কাঁদতে থাকেন। আমাদের রাজনীতিবিদরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করার শপথ নিয়ে বসে আছেন। এ জন্য তারা বারবার কারাগারে পৌঁছেন। যারা রাজনীতিবিদদের বারবার কারাগারে পাঠিয়ে থাকে, তাদের বোঝা উচিত, কারাগারের ভয় এখন আর কোনো ভয় নয়। আপনারা নিজেরাই আইনকে হাস্যকৌতুকে পরিণত করেছেন। কেননা এ আইন পারভেজ মোশাররফের সামনে নিথর। জনগণ দেখেছে যে, আডিয়ালা কারাগারে আসিফ জারদারি ও নওয়াজ শরিফ তো যেতে পারেন, কিন্তু মোশাররফ যেতে পারে না। এ কারাগারও এক হাস্যকৌতুকে পরিণত হয়েছে। আর এটাই আমাদের রাষ্ট্রের বড় যন্ত্রণা। 

* হামিদ মীর : পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক। দৈনিক জং থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব


আরো সংবাদ



premium cement
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট কারীদের চিহ্নিতকরণ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি ১২ দলীয় জোটের কলিং ভিসায় প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে ফেরার সময় মারা গেল মালয়েশিয়া প্রবাসী নারায়ণগঞ্জ যুবদলের সদস্য সচিবকে আটকের অভিযোগ হাতিয়া-সন্দ্বীপ চ্যানেলে কার্গো জাহাজডুবি : একজন নিখোঁজ, ১১ জন উদ্ধার হঠাৎ অবসরের ঘোষণা পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়কের বগুড়ায় গ্যাসের চুলার আগুনে বৃদ্ধা নিহত বগুড়ায় ধানের জমিতে পানি সেচ দেয়া নিয়ে খুন জিআই স্বীকৃতির সাথে গুণগত মানের দিকেও নজর দিতে হবে : শিল্পমন্ত্রী অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ চুয়েট, শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ সখীপুরে সাবেক ও বর্তমান এমপির সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ তীব্র গরমের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার অন্যতম দায়ী : মির্জা আব্বাস

সকল