২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

প্রতিবেশীর আচরণ ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র

প্রতিবেশীর আচরণ ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র -

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে বিগত ৪৭ বছরে একটা বিষয় দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, বলার উপায় নেই, বাংলাদেশের প্রতি ভারতের আচরণ বন্ধুসুলভ। ১৯৭২-৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ঢাকা হলের (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল) সামনে দিয়ে বিকেলে দক্ষিণ দিকে বেচারাম দেউড়ি বড় বোনের বাসায় যেতাম। পথে বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের পূর্ব পাশের দেয়াল ঘেঁষে ইউক্যালিপটাস গাছের নিচে, রাস্তায় প্রতিদিনই দেখতাম, গোটা বিশেক ঢাউস সাইজের ভারতীয় খালি ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে পাগড়ি মাথায় শিখ ড্রাইভার। সন্ধ্যার পর যখন একই পথ দিয়ে পরীবাগের বাসায় ফিরতাম আর একটি ট্রাকও দেখা যেত না। মাঝে মাঝে সন্ধ্যার প্রাক্কালে বাসায় ফেরার পথে দেখতাম, খালি ট্রাকগুলো মাল বোঝাই এবং ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। ভেতরে কী আছে তা বোঝার উপায় নেই। ট্রাকগুলো চলে যেত। বুঝা যায়, ভারতেই যেত। বুঝতাম, এ ট্রাকগুলো ওয়ার-ব্যুটি নিয়ে যেত। একদিন দুপুরে বায়তুল মোকাররমের উত্তরের রাস্তায় ত্রিপল দিয়ে ঢাকা একটি বোঝাই ট্রাক শিখ ড্রাইভারকে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে চালিয়ে নিয়ে যেতে দেখেছি। বলা যায়, যুদ্ধের অব্যবহিত পরে ভারতের বহু সৈন্য বাংলাদেশে লুটতরাজে ব্যস্ত ছিল। সে সময়ের সরকার এটাকে স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছিল। নচেৎ এমনটা কিছুতেই ঘটতে পারত না। কিংবা বাংলাদেশ সরকার নিরুপায় ছিল।

কখনো ভারতে যাইনি। শুনেছি, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে রিলিফের নামে বিদেশ থেকে যা আসত তার অনেক কিছুই কলকাতার ফুটপাথে বিক্রি হতো। এ দেশের বহু প্রাইভেটকার বেহাত হয়ে ভারতের রাস্তায় চলত। পরে অবশ্য ভারত সরকার এটা নিয়ন্ত্রণ করেছে বলে জানা যায়। সে সময়ে ভারতের অবস্থা এতটাই শোচনীয় ছিল যে, ঢাকায় বসে কলকাতার পত্রিকায় পড়েছি- পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার লোকেরা তখন ঘাস খেতে বাধ্য হয়। সে তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা অনেক ভালো ছিল। তবুও পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের উন্নাসিকতা কম ছিল না। ১৯৭৩ সালের গোড়ার দিকে তদানীন্তন দৈনিক মর্নিং নিউজে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত ছিলাম। একদিন সন্ধ্যার দিকে কলকাতার যুগান্তরের যুগ্ম সম্পাদক (নামটি মনে পড়ছে না) সস্ত্রীক মর্নিং নিউজ অফিসে এলেন। আমি এবং মর্নিং নিউজের সিটি এডিটর আমানুল্লাহ তাদের সাথে করে পল্টন ময়দানে এলাম। সেখানে তখন ভারতীয় খ্যাতনামা শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করছিলেন। বিখ্যাত শ্যামল মিত্রও ছিলেন। মাঠে তিলধারণের ঠাঁই নেই। এটা দেখে যুগান্তরের যুগ্ম সম্পাদক সবিস্ময়ে বললেন, ‘এত লোক’! তার স্ত্রী বললেন, ‘এরা মূর্খ তো।’ এই হলো স্বাধীন বাংলাদেশীদের প্রতি তাদের ধারণা।

পাকিস্তান আমলে পূর্বপাকিস্তানের নেতা ও কর্মকর্তাদের হরহামেশা রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদ যাতায়াত করতে হতো। শুনেছি এই অভিজ্ঞতার আলোকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতে অবস্থানরত মওলানা ভাসানী বলেছিলেন ‘এতদিন আমাদের ঢাকা রাওয়ালপিন্ডি-ইসলামাবাদ দৌড়াতে হয়েছে। দেশ স্বাধীন হলে আবার ঢাকা দিল্লি দৌড়াতে হবে না তো?’ এ কথা ইন্দিরা গান্ধীর কানে গেলে তিনি ক্ষুব্ধ হন। মওলানাকে দীর্ঘ দিন নজরবন্দী দীর্ঘদিন রাখা হলো। মওলানার আশঙ্কা সত্যি হয়েছে। আজকাল আমাদের দেশের নেতাকর্মী ও সরকারি কর্মকর্তাদের প্রায়ই কলকাতা-দিল্লি দৌড়াতে হয়। জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে এলে দেশের বিভিন্ন দলের শীর্ষ থেকে মাঝারি নেতারা দিল্লি সফর করেন। সেদিন প্রধানমন্ত্রীর এক শীর্ষ উপদেষ্টা দিল্লি বসেই বললেন, ভারত বিএনপিকে কোনো প্রকার ‘সুযোগ’ দেবে না। বাংলাদেশে কোনো দলের ক্ষমতায় আসার ‘সুযোগ’ কেন ভারতের ওপর নির্ভর করবে? আওয়ামী লীগ নেতাদের বলতে শুনেছি, ভারত এখন এক পাকিস্তান মোকাবেলা করছে। বাংলাদেশে বিএনপি ক্ষমতায় এলে ভারতকে দু’দিকে দুই পকিস্তান মোকাবেলা করতে হবে; অর্থাৎ তাদের ভয়, বাংলাদেশও পাকিস্তান হয়ে যাবে। এসব ছেলে ভুলানো জুজু বুড়ির ছড়া শোনানোর দিন কি এখনো শেষ হয়নি?

ভারত একটি বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বহু নদীর উৎপত্তি ভারতে। নদীমাতৃক কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের অস্তিত্বের ক্ষেত্রে আবহমান কাল থেকে নদী একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সেসব নদীর সব ক’টিতে ভারত একতরফাভাবে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশকে মরুকরণের দিকে ঠেলে দিয়েছে। একসময় বাংলাদেশের যেসব নদীতে পানি থৈ থৈ করত, ছোট-বড় নানা মাছে পরিপূর্ণ ছিল। শুষ্ক মওসুমে তাতে পানি থাকে না। এককালের প্রমত্তা পদ্মার বুকে জাগে ধু ধু বালু চর; এর বুক চিরে জেগে ওঠে পায়ে চলার পথ; মোটরবাইক ও গরু ঘোড়া মহিষের গাড়ি চলে। কত নদী খাল বিল জলাশয় মজে গেছে; তার হিসাব এখন আর কেউ রাখে না। কৃষিকাজ চলে বিপজ্জনকভাবে ভূগর্ভস্থ পানির সেচ দিয়ে; সেই বহতা পানি আজ আর নেই। বর্ষা মওসুমে উজানের নদীগুলোর বাঁধের মুখ ভারত খুলে দেয়। সেই পানিতে ভাটিতে ক্ষেতের ফসল ঘরবাড়ি ভেসে যায়।

বাংলাদেশ ভারতকে কী দেয়নি? সোনালী আঁশ পাট বিসর্জন দিয়েছে। ট্রানজিট দিয়েছে। বাংলাদেশের ভেতরে ভারতীয়দের কাজের সুযোগ করে দিয়েছে, যারা বার্ষিক ছয় বিলিয়ন ডলার নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছেন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর স্থিতিশীলতা এবং এদের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব করার সুযোগ করে দিয়েছে ঢাকা। ভারতীয় পণ্যের ও সংস্কৃতির অবাধ প্রবেশাধিকার দিয়েছে যেটা ভারত আজো দেয়নি। অসাম্প্রদায়িকতার নামে নিজ ঐতিহ্য ভুলে এবং বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনে ১০ শতাংশকে অ্যাকোমোডেট করতে গিয়ে বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় রীতি-নীতিকে হেয় করা হচ্ছে। অন্যায় অনাচার অবিচার ব্যভিচার খুন গুমের মতো অপরাধকে উসকে দেয়া হয়েছে। কাশ্মিরের মুসলমানদের ওপর ভারতীয় নির্যাতনের প্রতিবাদ করা থেকে বাংলাদেশ বিরত রয়েছে সচেতনভাবেই। অথচ মুক্তিযুদ্ধকালে সংখ্যালঘু নির্যাতনের দায়ে বাংলাদেশে দোষীদের ফাঁসি হয়েছে এবং আরো বহু মামলা বিচারাধীন রয়েছে। তাই যেকোনো দেশে নির্যাতনের প্রতিবাদ করা বাংলাদেশেরই সাজে। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বর্ডারে বাংলাদেশীদের গুলি করে, কখনো বা মেরে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখে, এর কোনো বিচার নেই। প্রতিবছর লাখ লাখ বাংলাদেশীকে ভারত ভ্রমণের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে তারা ভারতে যেন চিকিৎসাসেবা নিতে পারে। এদিকে দেশীয় চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো পয়মাল হয়ে গেছে। বাংলাদেশী ছেলেমেয়েরা যাতে ভারতে লেখাপড়া করতে যায় সে লক্ষ্যে কত তোড়জোড়। দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বরবাদ হয়ে গেছে।

অনেকেই বলেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারিত হয় পড়শির মুখ চেয়ে। বিচক্ষণ পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশের নেই। রোহিঙ্গা মুসলমান সমস্যার কথাই ধরা যাক। মিয়ানমার সেনাবাহিনী যখন ওদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে দলে দলে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দিচ্ছে, সেই মুহূর্তে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমার গিয়ে সে দেশের সাথে সংহতি ঘোষণা করে এলেন। কিন্তু এর প্রতিবাদে ভারতের বন্ধুপ্রতিম সরকার টুঁ শব্দটি করেনি। সারা বিশ্বে এমনকি ভারতেও মুসলমানেরা আজ নিগৃহীত। কয়েকজন ভারতীয় শীর্ষ নেতা ঢাকা এসেছেন কিন্তু কেউ রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যাননি। উপরন্তু আসামের এক কোটি মুসলমান এবং ভারতের অন্যত্র অবস্থানরত ৪০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার পাঁয়তারা চলছে। পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে- ‘ইহুদি, নাসারা (ও পৌত্তলিকরা) কখনো তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের মিল্লাত গ্রহণ করবে। বলো, আল্লাহর হিদায়াতই হচ্ছে প্রকৃত পথ। তোমার কাছে সঠিক জ্ঞান আসার পরও যদি তুমি তাদের ইচ্ছানুসারে চলতে থাকো, তাহলে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া তুমি কোনো বন্ধু ও সাহায্যকারী পাবে না’। (সূরা বাকারা ২: আয়াত ১২০)

ভণ্ডামিসর্বস্ব নীতির কারণে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে বন্ধুহারা হয়ে বিশেষ দেশের পকেটে।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানটি দেখুন। স্থলভাগের তিন দিক থেকে ভারত একে বেষ্টন করে আছে। আমরা গলা চড়িয়ে বলি, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান স্ট্যাটিজিক্যালি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তা হতে পারত যদি বাংলাদেশকে কোনো দেশ বেষ্টন করে না রাখত। পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো হলে অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্র এবং চীন ও পাশ্চাত্যের দেশগুলো বাংলাদেশকে সমীহ করত। পাকিস্তানের সাথে এদের সম্পর্ক ভালো। বিশেষ কোনো রাষ্ট্রকে খুশি রাখতে গিয়ে নিজ দেশকে বিশ্বের দরবারে একঘরে এবং লিপ-সার্ভিস-রাজনীতির শিকারে পরিণত করবেন না। রোহিঙ্গা মুসলিম সমস্যা বাংলাদেশ পররাষ্ট্রনীতির ঘাটতিটা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো এবং এর পরিণাম আমরা হারেহারে টের পাচ্ছি। প্রচারসর্বস্ব উন্নয়নের নামে সরকার আমাদের ভুলিয়ে রাখতে চাইলেও জাতীয় সঙ্কট রয়ে গেছে।
লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা কাডার


আরো সংবাদ



premium cement