২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জাফর ভাই মারা গেছেন

জাফর আহমেদ চৌধুরী - ফাইল ছবি

জাফর ভাইয়ের সাথে আর কখনো দেখা হবে না। টেলিফোনেও কখনো আর কোনো কথা হবে না। কারণ, তিনি মারা গেছেন। কেউ মারা গেলে তার সাথে কারো পার্থিব কোনো যোগাযোগ থাকে না। মৃত ব্যক্তি কারো কারো স্বপ্নে কখনো আবির্ভূত হতে পারেন। শুনেছি প্রিয় মানুষেরা স্বপ্নে নিয়মিত দেখা দেন। কিন্তু বাস্তবে তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। আমার মা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকে ঘুমানোর আগে প্রায়ই আশা করি, মা যাতে স্বপ্নে আসেন। গত ১৬ বছরে মাত্র তিনবার আমার স্বপ্নে মা দেখা দিয়েছেন। প্রথমবার দেখি তার মৃত্যুর প্রায় চার বছর পর। হু হু করে কেঁদেছি। কাউকে জানতে বা বুঝতে দেইনি। আব্বা গত হয়েছেন ১৩ বছর হয়ে গেছে। তাকেও দু-একবার স্বপ্নে দেখেছি। আরো অনেক বন্ধু ও প্রিয়জন পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। তাদের কাউকে স্বপ্নে দেখিনি অথবা দেখে থাকলেও আমার মনে নেই। অতএব নিশ্চিত হতে পারি না যে, জাফর ভাইকে কখনো স্বপ্নে দেখতে পাবো।

জাফর আহমেদ চৌধুরী। বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব। বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক মহাপরিচালক। গত ১৩ জুলাই শুক্রবার ভোরে তিনি ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন। আমরা সমবয়সী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ব্যাচের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে আমরা পরিচিত এবং একে অপরকে ‘ভাই’ ও ‘আপনি’ সম্বোধন করতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। তার সাবজেক্ট ছিল ইকোনমিকস, আমার পলিটিক্যাল সায়েন্স। ছাত্রজীবনের সবপর্যায়ে তিনি ভালো ছাত্র ছিলেন। বিতার্কিক হিসেবেও তার খ্যাতি ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তঃহল বিতর্ক প্রতিযোগিতায় তিনি হলের পক্ষে চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা অর্জন করে। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে তিনি সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। ছাত্রাবস্থায় সাংবাদিকতা শুরু করেছিলাম এবং ছাত্রজীবন শেষে পেশা বদল করতে ইচ্ছে হয়নি। এখনকার ছাত্রছাত্রীরা একই ক্লাসের হলেই একজন আরেকজনকে ‘তুই’ বলার অধিকার পেয়ে যায়, আমাদের সময় সে অধিকারের প্রয়োগ খুব বেশি ছিল না। আমাকে কিছু সহপাঠী ‘তুমি’ বললেও বেশির ভাগই ‘আপনি’ সম্বোধন করত।

জাফর ভাই দীর্ঘ ৪৫ বছর আমার ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলেন। চুয়াত্তর সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচয়ের পর থেকে জীবনের কোনো পর্যায়েই আমরা কখনো বিচ্ছিন্ন ছিলাম না। বিসিএস ক্যাডারে তার অন্তর্ভুক্তির পর ময়মনসিংহ জেলার ডেপুটি কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকতে হয়েছে তাকে। তখন দেখা সাক্ষাৎ কম হলেও যোগাযোগে ব্যত্যয় ঘটেনি। তার মৃত্যু চিরবিচ্ছেদের অমোচনীয় রেখা টেনে দিলো। ধর্মকর্মে তেমন মতি না থাকলেও ধর্মে বিশ্বাস করি এবং সে কারণে হাশরে বিশ্বাস করি। হাশরের ময়দানে পৃথিবীর তাবৎ সৃষ্টিকে কুরআনের ঘোষণা অনুযায়ী মৃত্যুর স্বাদ পেতে হবে। ছোটকাল থেকে ওয়াজে শুনে এসেছি, রোজ হাশরে পুণ্যাত্মারা তাদের প্রিয়জনদের সাক্ষাৎ পাবেন। কী এমন পুণ্য করেছি পাপাচারে পরিবেষ্টিত থেকে? পাপের জন্য শাস্তি দিতে ও পুণ্যের জন্য পুরস্কৃত করতে মানুষের পুনরুত্থান হলে মানুষের কল্যাণ সাধনের পুরস্কার নিতে জাফর ভাই যে স্তরে থাকবেন, তার ধারে কাছে পৌঁছতে আমাকে কত ‘হুকবা’ (এ সংক্রান্ত কোনো হিসাব ইসলামি গবেষণা গ্রন্থে আছে কি না জানা নেই। কিন্তু হুজুরদের বক্তৃতায় শুনেছি দুনিয়ার ২৮০ বছরে পরকালের এক ‘হুকবা’, আর সেখানে কত ‘হুকবা’য় এক বছর তা কেউ জানে না), জাহান্নামের আগুনে কতকাল পুড়ে পরিশুদ্ধ হলে জাফর ভাইয়ের সাথে পরকালে দেখা হবে, তা আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেয়ার অর্থই হচ্ছে তার সাথে সাক্ষাতের আশা পোষণ করার মতো ভালো মানুষ ছিলেন।

ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাবে গঠনতন্ত্র অনুসারে জেলা প্রশাসক পদাধিকার বলে এই ক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন। জাফর ভাই জেলা প্রশাসক হিসেবে জেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি হন এবং সাংবাদিক কমিউনিটি ও সংবাদপত্রের সাথে তার সম্পর্কের সেতু তৈরি হয়। তিনি নিয়মিত কবিতা লিখতে শুরু করেন। আমাকেও কিছু কবিতা পাঠালেন এবং আমি সেগুলো আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক নতুন ঢাকা ডাইজেস্টে প্রকাশ করি। এর আগে পরে সময় পেলেই তিনি ঢাকা ডাইজেস্টে লিখেছেন। ‘আন্ধারমানিকের সেটেলার লিডার’ নামে তার অসাধারণ এক গল্প ডাইজেস্টে ছেপেছিলাম। জাফর ভাই বিটিভির মহাপরিচালক থাকাকালে তার কবিতায় সুরারোপ করতেন বিখ্যাত সুরকাররা এবং সেগুলোতে কণ্ঠ দিতেন দেশের সেরা শিল্পীরা। টেলিভিশনে যেদিন তার গানের অনুষ্ঠান হতো, সে দিন আগেই তিনি ফোন করে জানাতেন। নিজে গানের সমঝদার না হলেও তার অনুরোধ রাখতে অনুষ্ঠান দেখে তাকে জানাতাম। এরপর তিনি তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হয়ে আসেন তিনি। আমি তখন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) উপপ্রধান বার্তা সম্পাদক।

বাসস রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও কোনো সচিবকে বাসস অফিস পরিদর্শনে আসতে দেখিনি। কিন্তু আমি বাসসে থাকার কারণে তিনি বাসসে সৌজন্য পরিদর্শনে আসেন। আমি প্রীত হয়েছি। তথ্য মন্ত্রণালয়ে খুব বেশি দিন ছিলেন না তিনি। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পেয়ে সেখানে দীর্ঘ সময় কাটান। ওই সময়েই আমার বেশ কিছু পারিবারিক অনুষ্ঠান হয় এবং পারিবারিক বিপর্যয় ঘটে। প্রতিবারই জাফর ভাই হয় আমার বাসায় অথবা অনুষ্ঠানস্থলে এসেছেন। আমিও তার ডাকে একইভাবে সাড়া দিতাম। পরিবেশ সচিব থাকাকালে তাকে প্রায় প্রতি মাসেই বিদেশে যেতে হতো পরিবেশসংক্রান্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে। বেশির ভাগই মন্ত্রীপর্যায়ের কনফারেন্স এবং এতে যোগ দেয়ার কথা পরিবেশমন্ত্রীর। কিন্তু পরিবেশমন্ত্রী তরিকুল ইসলাম উচ্চ ডায়াবেটিকে আক্রান্ত। সার্বক্ষণিক চিকিৎসায় থাকতে হয় তাকে। হাসপাতালেও কাটাতে হয়। অতএব, তিনি পরিবেশ সচিবের ওপর কনফারেন্সগুলোতে অ্যাটেন্ড করার দায়িত্ব ন্যস্ত করতেন। জাফর ভাই কোনো একটি দেশ ঘুরে এলেই সচিবালয়ে তার দফতরে যাই। তিনি তার ভ্রমণের সরস বর্ণনা করবেন, এমনকি বিদেশে অবস্থানকালে দৈনিক ভাতা হিসেবে মোট কত ডলার পেয়েছেন, তাও বলেন। তার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা লিখতে তাগিদ দেই। তিনি লিখেছেন। ঢাকা ডাইজেস্ট প্রকাশিত হওয়ার পর কপি ও সম্মানীসহ হাজির হই। সম্মানীর পরিমাণ সামান্য, এক হাজার টাকা। সম্মানী নিতে না চাইলেও টেবিলের ওপর রেখে আসি। মন্ত্রী, এমপি বা সচিবপর্যায়ের কেউ কারো বন্ধু হলে তার যে কী বিপদ, তা ভুক্তভোগীরাই জানেন।

ছাত্র রাজনীতি করিনি বলে মন্ত্রী বা এমপিপর্যায়ের কোনো বন্ধু আমার ছিল না। সাংবাদিকতা করার সুবাদে অনেক রাজনীতিবিদের সাথে পরিচয় থাকলেও কারো সাথে কখনো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সৃষ্টি করার প্রয়োজন পড়েনি। তবে ওই সময়ে সহপাঠী ও বন্ধু জনা দশেক সচিব ছাড়াও অনেক বন্ধু অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বসতেন। ছোট্ট দেশ, জানাজানি হতে বিলম্ব ঘটে না যে, কে কার কতটা ঘনিষ্ঠ। অতএব, তদবিরের অনুরোধে বাসা বা অফিসে টিকতে পারি না। অনেককে সোজা বলে দেই ‘আমার দ্বারা হবে না’। তবে অনেকের অনুরোধ এড়ানো যায় না। ঘনিষ্ঠজনের চিঠি নিয়ে আসে বা তাদের দিয়ে আমাকে টেলিফোন করায়। এমনকি আমার মাকে দিয়েও টেলিফোন করিয়েছে দু-এক ক্ষেত্রে। বাধ্য হয়ে অনুরোধের কোনো কোনো ঢেঁকি গিলতে হয়। অবশ্য ভুয়া বা বদ লোকের তদবির করে আমাকে বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয়নি। সাংবাদিকতার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় অন্তত এ ধারণাটুকু করতে পারতাম যে, কার তদবির করলে যথার্থই সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি বা এলাকার অথবা কোনো মানুষের সঙ্কট মোচন হবে। আমি যাদের কাছে তদবির নিয়ে গেছি, তারা তদবির নাকচ করে দেননি। বিনা ক্লেশে এবং ঘুষ ছাড়াই কাজ সম্পন্ন হওয়ায় সংশ্লিষ্টরা বিস্মিত ও খুশি হয়েছেন।

জাফর ভাই যেখানেই দায়িত্ব পালন করেছেন সেখানেই অনেকের তদবির নিয়ে গেছি। তিনি যখন সচিব হননি, তখনো। নির্বাচন কমিশনে ডেপুটি সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দেয়ার পর একদিন নিজেই জানালেন, এলাকায় আপন কোনো লোকের নির্বাচন সংক্রান্ত কাজ থাকলে ফোন করে পাঠিয়ে দেবেন। আমলারা তদবির নাকচ করেন, জাফর ভাই যেচে তদবির নেয়ার মানুষ। যেকোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী লোকজন আমার মনোজগতে ‘টাউট’ এর প্রতিমূর্তি। আমার আপন দু-একজন নির্বাচনে আসক্ত। তবুও বলি, নির্বাচন কমিশনে ছোটখাটো কোনো কাজ থাকলে যাতে আমাকে জানায়। এসব বিষয় কেন জানি, গোপন থাকে না। চাউর হয়ে যায়। ভোটার লিস্ট মুদ্রণের অর্ডার পাওয়ার দাবি নিয়ে আসেন এলাকার একাধিক প্রেস মালিক ও মুদ্রণ ঠিকাদার। অর্ডারটা যেন তাদের পক্ষে স্থানীয় নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয় সেই ব্যবস্থা করে দিতে হবে। জাফর ভাইয়ের অফিসে গিয়ে এসব তদবির করতে নিজেই বিব্রত বোধ করি। তবুও নিকট কাউকে তার বাসায় নিয়ে যাই। যদি তারা কাজ পাওয়ার সব শর্ত পূরণ করতে পারে, তাহলে তাদেরকে কাজ দেয়ার সুপারিশ করি। তিনি আমাকে ও তাদের আশ্বস্ত করেছেন; বিধি মোতাবেক হলে কাজের ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন। নির্বাচনে এলাকা নির্ধারণ প্রক্রিয়াগতভাবে জটিল না হলেও বিদ্যমান এলাকার একটু হেরফেরেই তা প্রার্থীর জয়-পরাজয়ের সূচক হয়ে উঠে। কেউ কেউ দাবি নিয়ে আসে; ‘তার ওয়ার্ডের ভোটারদেরকে অন্য ওয়ার্ডের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে। ওইসব ভোটারকে এখন অমুক কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে হবে, যেখানে প্রতিপক্ষ প্রার্থীর এলাকা। সে তো আমার বাঁধা ভোটারদের ভোট জোর করে নিয়ে নেবে। সেই পাকিস্তান আমল থেকে এরা আমাদের কেন্দ্রে ভোট দিয়ে আসছে ইত্যাদি।’ বভিন্ন এলাকার সম্ভাব্য প্রার্থী বা প্রার্থীদেরকে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে জাফর ভাইয়ের কাছে নিয়ে যাই। তিনি সব শোনেন। তাদেরকে বাইরে বসতে বলে আমার কাছে জানতে চান সীমানা নির্ধারণে যদি আমার আপন কোনো প্রার্থীর ক্ষতি হয়, তাহলে আগের অবস্থাই বহাল রাখা হবে। সিদ্ধান্ত যার পক্ষে যায় সে সন্তুষ্ট হয়, যার বিপক্ষে যায় সে হয় ক্ষুব্ধ। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। কারণ, আমি জানি- আমাকে কারো কাছে ভোট ভিক্ষা করতে হবে না।

১৯৯৯ সালে আমি যখন দৈনিক বাংলার বাণীর নিউজ এডিটর হিসেবে যোগ দেই আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতায়। আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য, জাতীয় সংসদ সদস্য ও বাংলার বাণীর সম্পাদক শেখ ফজলুল করিম সেলিম। ১৯৯৬ সালে মন্ত্রিসভা গঠনের সময়ই তাকে কেন মন্ত্রী করা হয়নি তা নিয়ে কানাঘুষা ছিল প্রচুর। বাংলার বাণীতে যাতায়াতকারী আওয়ামী লীগের জাদরেল ক’জন নেতার কাছে জানতে চাইলে সেলিম ভাইকে মন্ত্রী না করার পেছনে তারই ছোট ভাই শেখ মারুফের ভূমিকার কথা বলেন। এর সত্যতা সম্পর্কে আমার সন্দেহ ছিল। শেখ সেলিম আওয়ামী লীগে বিপুল জনপ্রিয়।

কেন তিনি মন্ত্রী হবেন না? প্রশ্নটা আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। এরই মধ্যে খবর আসে, তাকে মন্ত্রী করা হচ্ছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদের শেষ বছরে মন্ত্রী হলেন শেখ সেলিম এবং তাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হলো। মন্ত্রী হওয়ার পর তিনি মাত্র একদিন বাংলার বাণী অফিসে আসেন। আমরা তাকে স্বাগত জানাই। ফুলের তোড়া উপহার দেই। তার কাছে এলাকার বহু লোক আসত এবং প্রত্যেকের সমস্যা সমাধানে তিনি হাত বাড়িয়ে দিতেন। চিকিৎসার কাজে এলাকার কেউ এলে তিনি মেডিক্যাল ও ক্রাইম রিপোর্টার আবুল হোসেনকে কাজে লাগাতেন। আবুলের বাবা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। সেই সুবাদে আবুলের বেশ প্রভাব ছিল ঢাকা মেডিক্যালে। তার হস্তক্ষেপে অনায়াসে রোগীর ভর্তি ও চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়ে যেত। সেলিম ভাই সবাইকে এবং বিশেষভাবে আবুলকে লক্ষ করে বললেন, ‘চিকিৎসার প্রয়োজনে কেউ এলে যথাসাধ্য সহায়তা করব। কিন্তু কেউ যাতে কোনো ডাক্তার-নার্সের বদলির তদবির নিয়ে আমার কাছে না আসে। কথাটা আমি আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের লোকজনকেও বলে দিয়েছি।’ তিনি তো তার কথা বলেই খালাস। অল্পদিনের মধ্যেই আমার এলাকার বেশ ক’জন ডাক্তার তাদের কাক্সিক্ষত স্থানে বদলির ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করতে এলেন। আমি যত বলি, সেলিম ভাই বদলির কথা শুনতেই পারেন না; তাদের চাপ তত বাড়ে।

শুধু বদলি নয়, সরকারি হজ মিশনে ডাক্তার বা প্যারামেডিক অন্তর্ভুক্ত করা, মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের সুপারিশ করার জন্যও চাপ আসে। আমি যেভাবে পারি, এড়িয়ে যাই। তবে আমার সহকর্মী ফটোসাংবাদিক কাজল হাজরার অনুরোধ এড়াতে পারি না। কাজলের বোন একজন নার্স। যেখানে পোস্টিং, সেখান থেকে বদলি হয়ে সুবিধাজনক স্থানে আসতে চান। এই তদবির নিয়ে সেলিম ভাইয়ের কাছে যেতে পারি না। কাজটা না হলে ছোট হয়ে যাব। জাফর ভাই তখন স্বাস্থ্য মন্ত্রালয়ের যুগ্ম সচিব। ফোন করে জানতে চাইলাম তার দায়িত্বের মধ্যে কী কী আছে। অনেক কাজের মধ্যে নার্সিং ও তার আওতায়। কাজল হাজরাকে নিয়ে তার অফিসে গেলাম। তার কথা হলো, এখন যেকোনো বদলি সম্পূর্ণ বন্ধ। একটা বদলির ঘটনা জানতে পারলে কালই ১০০টা আবেদন পড়বে। তবুও আমার অনুরোধে তিনি বদলির ব্যবস্থা করেছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সেশন জটের কারণে আমাদের দীর্ঘ সাত বছরের আবাস সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের একটি প্রসঙ্গ আনা উচিত মনে করছি। হলের ১২ নম্বর রুম ইস্ট হাউজের দক্ষিণ-পূর্ব কোণায়। রুমটির বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য হলো তিন দিকে খোলা বারান্দা। হলে একই ধরনের আরেকটি রুম ছিল ওয়েস্ট হাউজের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে। রুম নম্বর ১৫৪। যদিও আমি ওয়েস্ট হাউজের বাসিন্দা এবং আমার রুম নম্বর ছিল ১৫২, কিন্তু ইস্ট হাউজের ১২ নম্বর রুমের বাসিন্দাদের ভালো দিক সম্পর্কে আমার যতটা জানা ছিল, আমার পাশের ১৫৪ নম্বর রুমের বাসিন্দাদের সম্পর্কে তেমন ভালো কিছু জানতাম না। তবে আমার সময়ের একজন ১৫৪ নম্বরে থাকতেন, যিনি নিয়মিত মদ্যপান করতেন। সারাক্ষণ তার চোখ ঢুলু ঢুলু থাকত। কখনো কখনো ওই রুমে রাতযাপনকারী তরুণীকেও বের হয়ে যেতে দেখেছি। তার ভয়ে কেউ টুঁ শব্দটিও করত না। তিনি পরবর্তী সময়ে জাতীয় সংসদের সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। কয়েক বছর আগে তার মৃত্যু ঘটেছে। অপর দিকে, ১২ নম্বর রুম এমন সব ছাত্রের আবাসস্থল ছিল, যাদের অনেকে তাদের কর্মজীবনে খ্যাতির অধিকারী হয়েছিলেন। এমন যে তিনজন সম্পর্কে আমি জানি, তাদের একজন জাফর আহমেদ চৌধুরী।

১২ নম্বর রুমের অতীত দুই বাসিন্দার একজন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্দশ ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর আবদুল মতিন চৌধুরী। ১৯৭৪ সালে সলিমুল্লøাহ মুসলিম হলের ইস্ট হাউজের লনে এক অনুষ্ঠানে তিনি ১২ নম্বর রুমের দিকে দেখিয়ে বলেন, তিনি ওই রুমে থাকতেন। আরেকজন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. মোহর আলী। অনার্সের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি ইংরেজিতে ‘হিস্টরি অব দ্য মুসলিমস অফ বেঙ্গল’ এ নামে বই লিখেছিলেন ১৯৫৩ সালে। সেটি আমাদের সময়েও ইতিহাসের ছাত্রছাত্রীরা পড়ত। আমিও পড়েছি। কারণ, ইতিহাস আমার সাবসিডিয়ারি ছিল। বইটির ভূমিকার নিচে ১২ নম্বর রুমের উল্লেখ ছিল। পরে তিনি সৌদি আরবের কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং চার খণ্ডে ‘হিস্টরি অফ দ্য মুসলিমস অফ বেঙ্গল’ শীর্ষক বই সমাপ্ত করেন। সৌদি সরকার তাকে কিং ফয়সাল পদকে ভূষিত করেছিল।

জাফর ভাইয়ের কথায় ফিরে আসি। কোলন ক্যান্সারে ভুগছিলেন। জীবনের শেষ দিনগুলোতে তিনি ব্যাধিজনিত যাতনায় কাটিয়েছেন। তার সাথে ফোনে শেষ কথা হয়েছে কয়েক মাস আগে। নিজের অসুস্থতার কথা জানাননি। চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুর যেতে হয়েছিল, তাও বলেননি বরং কিছু সিরিয়াস পড়ালেখা শুরু করেছেন বলে জানিয়েছেন। গত সপ্তাহেই প্রিয়ভাজন হারুনকে ফোন করেছিলাম। তখনই জানতে পারি, তার ক্যান্সারের কথা। কষ্ট পেয়েছি, কিন্তু এটি তার চিরবিদায়ের কারণ হবে, এমন ভাবিনি। হারুনকে বলেছিলাম জাফর ভাইকে আমার সালাম পৌঁছে দিতে। তিনদিন পর তার মৃত্যুসংবাদ জানার পর আবার ফোন করলাম। হারুন জানাল, আমার কথা জানাতে যখন তাকে ফোন করেছে তখন জাফর ভাই হাসপাতালে। কথা হয়েছে। যথারীতি আমার সালামও পৌঁছে দিয়েছে। আমি কেমন আছি, জানতে চেয়েছেন। দোয়া করতে বলেছেন। জাফর ভাইয়ের ব্যাধির কথা না জানলেও তার কষ্টের কথা জানতাম। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেই যে ক’জন সিনিয়র আমলাকে ‘ওএসডি’ (অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি) করে দিয়েছিল, তাদের একজন জাফর ভাই। অর্থাৎ অবসর নেয়ার বয়সে পৌঁছার আগ পর্যন্ত তিনি আর কর্মক্ষেত্রে ফিরতে পারেননি। আমলারা যদি ক্ষমতাসীন সরকারের রাজনীতির সমর্থক না হন, তাহলে শাস্তি হিসেবে ‘ওএসডি’ করার রীতি সব রাজনৈতিক সরকারই করে আসছে। আওয়ামী সরকার এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি কঠোর। সিনিয়র আমলারা তো বটেই, জুনিয়র আমলারাও আওয়ামী সরকারের করাল থাবা থেকে নিষ্কৃতি পাননি। জাফর ভাইকে এমনকি তার সার্ভিস বেনিফিট পেতেও অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়েছে। তার সরকার সমর্থক বন্ধু আমলাদের চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত বেনিফিট পেয়েছিলেন, যা তার চিকিৎসায় ব্যয় হয়েছে।

জাফর ভাইয়ের সাথে আর দেখা হবে না, ভাবতেই বেদনা অনুভব করছি। মৃত্যু যেহেতু অবধারিত, অতএব মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে লাভ নেই। মেনে নেয়াই ভালো যে, ‘মৃত্যু এক ধরনের রূপান্তর, মৃত্যুতে দেহের অবসান ঘটে, কিন্তু একটি চেতনার মাঝে রয়ে যায় জীবন এবং জীবনের ধারাবাহিকতার নামই মৃত্যু। হজরত ঈসা আ: বলেছেন, ‘মৃত্যুর কথা ভেবে হৃদয়কে যন্ত্রণায় দগ্ধ করো না। স্রষ্টায় বিশ্বাস করো; আমার ওপরও বিশ্বাস স্থাপন করো। আমার পিতৃগৃহ অনেকগুলো কক্ষ শোভিত। যদি তা না হতো, তাহলে কি আমি তোমাদেরকে বলতাম যে, আমি যাচ্ছি তোমাদের জন্য জায়গা প্রস্তুত করতে। আমি আবার ফিরে আসব এবং তোমাদেরকে আমার সাথে নিয়ে যাব। ... আমি কোথায় যাচ্ছি, তোমরাও তা জানতে পারবে।’

বাংলাদেশের খ্যাতিমান সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ ফয়েজ আহমেদ তার এক বন্ধু সাংবাদিকের (যার নাম আমার মনে নেই) মৃত্যুতে লিখেছিলেন, ‘তুই যা, আমি আসছি।’ জাফর ভাই ৬৪ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে গেলেন। আমার মা পৃথিবী থেকে যখন বিদায় নেন, তখন তার বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। আমার বয়স ৬৪ চলছে। অতএব, জাফর ভাইকে বলতেই পারি, ‘আমিও আসছি।’

দেখুন:

আরো সংবাদ



premium cement
কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পান, সেভাবেই ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে : কৃষিমন্ত্রী চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে সিএনজি ও বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ২, আহত ৪ ভান্ডারিয়ায় ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা দেখতে দর্শনার্থীদের ঢল তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে ৭ দিন স্কুল বন্ধের দাবি চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত বিএনপি সাম্প্রদায়িক শক্তি, এদের রুখতে হবে : ওবায়দুল কাদের সাদিক এগ্রোর ব্রাহামা জাতের গরু দেখলেন প্রধানমন্ত্রী ভারতে লোকসভা নির্বাচনে প্রথম ধাপে ভোট পড়েছে ৬০ শতাংশ সারা বিশ্ব আজ জুলুমবাজদের নির্যাতনের শিকার : ডা. শফিকুর রহমান মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশী : পররাষ্ট্রমন্ত্রী চন্দনাইশ, বাঁশখালী ও বোয়ালখালীতে ৩ জনের মৃত্যু

সকল