২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা

রথযাত্রা - ফাইল ছবি

শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা ৩০ আষাঢ়। মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি, শান্তি ও মৈত্রীর পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য তিনি বিগ্রহ গণউৎসব শান্তি ও মৈত্রীর মিলনলগ্নে মন্দির ছেড়ে রাজপথে সবাইকে দর্শন দানের জন্য বেরিয়ে আসেন। আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী প্রভুপাদ ১৯৬৫ সালে তার গুরুদেবের নির্দেশে পাশ্চাত্যে কৃষ্ণ ভাবনামৃত প্রচারের জন্য আমেরিকায় গিয়েছিলেন। সেখানে সানফ্রান্সিসকোতে ভারতবর্ষের বাইরে প্রথম রথযাত্রা উদযাপন করেছিলেন সনাতন ধর্মমতে। জগতের পরম প্রভু শ্রী জগন্নাথ দেব। কলকাতায় জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা হতো, তা দেখে প্রভুপাদ অভিভূত হতেন। উড়িষ্যার জগন্নাথপুরীর রথযাত্রা হলো আদি রথযাত্রা। সেখানে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষের সমাগম হয়ে থাকে। শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত লীলাকে কেন্দ্র করে শত শত বছর ধরে ৪৫ ফুট উঁচু তিনটি রথে জগন্নাথ, বলদেব ওসুভদ্রাকে নিয়ে হাজার হাজার মানুষ দু’মাইল পথ পেরিয়ে রথকে গুণ্ডিচা মন্দিরে নিয়ে যায়। চার শ’ বছর আগে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু পুরীর রথযাত্রা মহোৎসবে তার পার্ষদদের নিয়ে কীর্তন করে নৃত্য করতেন। ষাটের দশকের শেষ দিকে শ্রী প্রভুপাদ আমেরিকার বিভিন্ন নগরীতে রথযাত্রা মহোৎসবের প্রচলন এবং ইসকনের মন্দিরগুলোতে রাধা-কৃষ্ণ বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা করেন। শ্রী শ্রী জগন্নাথদেব কৃপাশীল। যারা মন্দিরে তাকে দর্শন করতে আসে না, তাদের সবাইকে কল্যাণ-ঐক্য-কৃপা আশীর্বাদ করতে তিনি মন্দির থেকে বেরিয়ে আসেন। একবার শ্রীকৃষ্ণ বলরাম ও সুভদ্রাদেবী সূর্যগ্রহণের সময়ে কুরুক্ষেত্রে পঞ্চতক তীর্থে স্নান করতে যান। এখনো কুরুক্ষেত্রে সূর্যগ্রহণের সময় স্নান করতে বহু পুণ্যার্থী গমন করেন। পাঁচ হাজার বছর আগে শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকা থেকে গিয়েছিলেন কুরুক্ষেত্রে। কৃষ্ণ তখন রথে উঠে বলেছেন, তিনি কুরুক্ষেত্র থেকে তার রাজধানী দ্বারকায় ফিরে যাবেন। সাথে রয়েছেন শ্রী বলরাম ও সুভদ্রা। চারপাশে রাজপুরুষ ও সৈনিক। কৃষ্ণের পরিধান গোপবেশের পরিবর্তে রাজবেশ। হাতে বাঁশির পরিবর্তে ধনুর্বাণ, কোমরে তলোয়ার, সাথে বর্ম ও মাথায় মুকুট। কৃষ্ণকে এভাবে দেখে গোপীদের মন ভরল না।

বিশেষ করে রাধারানী বললেন, এই কৃষ্ণ সেই কৃষ্ণ নয়, যাকে আমরা চিনতাম, বৃন্দাবনের বনে বনে আমাদের সাথে যিনি লীলা খেলা করতেন। সেই কৃষ্ণের মাথায় ময়ূরের পাখা, তার পরনে পীত বসন; গলায় বনমালা এবং হাতে বাঁশি। অথচ এ কৃষ্ণের পরনে রাজবেশ। রাধারানীর মনোভাব বুঝতে পেরে ব্রজবাসীরা কৃষ্ণের রথের দড়ি আর ঘোড়াগুলো ধরে টানতে টানতে নিয়ে চললেন বৃন্দাবনের দিকে। বলরাম, ব্রজবাসীদের শৈশবের ও কৈশোরের সাথী, তাকেও তারা রথে চড়ালেন। সুভদ্রা কৃষ্ণের বোন; তাকেও তারা নিয়ে চললেন। জগন্নাথপুরীর এ রথযাত্রাটি হচ্ছে গোপীদের সেই কুরুক্ষেত্র রথযাত্রা দ্যোতক। রথের সময় জগন্নাথ বা কৃষ্ণকে নিয়ে যাওয়া হয় নীলাচল থেকে সুন্দরাচলে। সেখানে কৃষ্ণ ব্রজবাসীদের সাথে আট দিন ছিলেন। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু ভাবতেন, কৃষ্ণ কতদিন ধরে তোমাকে দেখতে চেয়েছি। আর এখন তোমাকে দর্শন করছি। শ্রী প্রভুপাদ বলেছিলেন, বাঁ পাশে একদল, ডান পাশে একদল, সামনে একদল এবং পেছনের দিকে একদল, আর শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু মাঝখানে থাকতেন। তারা সবাই নাচতেন এবং কীর্তন করতেন। রথযাত্রার সময় ভগবান শ্রী জগন্নাথ স্বয়ং আমাদের সামনে উপস্থিত হন। তাই এটি একটি অনন্য উৎসব। এর মাধ্যমে আমরা ভগবানের প্রতি আমাদের হৃদয়ের ভক্তি ও প্রেম নিবেদন করতে পারি। রথযাত্রার দিন রথারূঢ় পরমেশ্বর ভগবান শ্রী শ্রী জগন্নাথদেব, বলদেব ও সুভদ্রাদেবীকে দর্শন করে ভক্তরা হৃদয়ের ভক্তি নিবেদন করে। রথের রশি ধরে টানে, ভগবানের প্রসাদ গ্রহণ করে। এভাবে তারা মানব জন্মকে সার্থক করে তোলে।

বাংলা ১০৭৯ সনে ধামরাইয়ে রথযাত্রা উৎসব হয়েছিল। ১১০৪ সন থেকে ১৩৪৪ সন পর্যন্ত মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া বালিয়াটির জমিদাররা চারটি রথ তৈরি করে দেন। সর্বশেষ রথটি ছিল ৬৭ ফুট দীর্ঘ ও ৫৪ ফুট প্রস্থ এবং চারতলাবিশিষ্ট। খচিত ছিল দেব-দেবীর মূর্তি। সূক্ষ্ম কারবাস করা সুউচ্চ রথ দেখার জন্য বিভিন্ন দেশের মানুষ ভিড় জমাত। রথ টানার জন্য প্রায় ২৭ মণ পাটের কাছি দরকার হতো। রথটি ’৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পুড়িয়ে দেয়। এরপর দুই বছর বাঁশের তৈরি রথ দিয়ে রথযাত্রা পালিত হয়েছে। টাঙ্গাইলের দানবীর রনদা প্রসাদ সাহার মেয়ে শ্রীমতি জয়াপতি সাহাসহ দানশীল ব্যক্তিদের সহায়তায় স্বাধীনতার পর তৈরি করা হয় শ্রী শ্রী যশোমাধবের রথ। ২০০৬ সালে রথযাত্রা উপলক্ষে তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনার বীণা সিক্রি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে রথটি পুনর্নির্মাণের ঘোষণা দেন। এ জন্য ব্যয় ধরা হয় ৭৮ লাখ টাকা। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে আদি রথটির আদলে পুনর্নির্মাণকাজ শুরু হয়। রথের প্রতি তলায় খচিত হয়েছে দেবদেবীর মূর্তি চিহ্ন। এটি ১৫ চাকা বিশিষ্ট।

ঢাকা মহানগরীতে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সঙ্ঘ ইসকনের বার্ষিক রথযাত্রা মহোৎসব জগন্নাথপুরী ধামের পরই বৃহত্তম অনুষ্ঠান। রথের দিন সকালে হরিণাম সঙ্কীর্তন শুরু হয়; পরে অগ্নিহোত্র যজ্ঞ বিশ্বশান্তি ও মঙ্গল কামনায়; যজ্ঞ শেষে মহাপ্রসাদ বিতরণ। অপরাহ্নে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা স্বামীবাগ আশ্রম থেকে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির পর্যন্ত। এতে সনাতন ধর্মাবলম্বী বহু নারী-পুরুষ অংশ নিয়ে থাকেন। অনুষ্ঠান চলে ১০ দিন। এবারো ইসকন ১৪ জুলাই থেকে ১০ দিনের কর্মসূচি নিয়েছে। ২২ জুলাই শেষ দিনের অনুষ্ঠান ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে। সকালে পদাবলি কীর্তন, জগন্নাথ লীলামৃত, আলোচনা সভা এবং বেলা ৩টায় উল্টোরথের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির থেকে স্বামীবাগ আশ্রম। ভক্তরা উপস্থিত হয়ে সবার মঙ্গল কামনায় ব্রতী হবেন- এ কামনা করেছেন আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সঙ্ঘ (ইসকন) নেতারা। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে সবিনয় নিবেদন- পরিবারের সবাইকে নিয়ে রথযাত্রা অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণ করুন।

হৃদয়ের মধ্যে আধ্যাত্মিকবোধ সৃষ্টি করে ভগবানের চরণে নিজেকে সমর্পণ করুন। বাংলাদেশ-ভারতসহ সারা বিশ্বে ইসকনের রথযাত্রা সাড়ম্বরে পালিত হয়ে আসছে। এটা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। রথের চাকার পবিত্র ঘূর্ণনে মুছে যাক সব অন্ধকার। দূর হয়ে যাক- অনাচার, অন্যায় ও অশান্তি। মহান আলোকে পূর্ণ হোক ধরিত্রী। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গড়ে উঠুক সম্প্রীতিময় অসাম্প্রদায়িকতার বাতাবরণ। সব সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও ধর্মীয় ভক্তিবিশ্বাস আমাদের ঐতিহ্যের গৌরবকে আরো সমুন্নত করুক। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যুগ যুগ ধরে এ দেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ নিজ নিজ ধর্ম সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে পালন করে আসছে। এ পুণ্যময় রথযাত্রার মধ্য দিয়ে সমাজে ও জাতীয় জীবনে সম্প্রীতির বন্ধন আরো মজবুত হোক- এটাই প্রত্যাশা। তা সাফল্য বয়ে আনবে আমাদের রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে এবং সবার মধ্যে। জয় শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য প্রভু নিত্যানন্দ। শ্রীঅদ্বৈতগদাধর শ্রীবাসাদি গৌরভক্তরা। হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে। এই বত্রিশ অক্ষরের ষোল নাম সর্বদা জপ করা উচিত। পরমাত্মার শান্তি কামনায় ব্রতী হতে হবে। এ লক্ষ্যে সার্থক হোক রথযাত্রা। সবার প্রতি রইল সশ্রদ্ধ প্রণাম ও শুভ কামনা।
msnislamtrasport@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement