২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জীবন থেকে নেয়া

মাহাথির মোহাম্মদ - ছবি : এএফপি

ইসলামি সভ্যতার সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে যে কারণে তা হলো, জ্ঞানীদের পক্ষ থেকে এ শিক্ষা ও সিদ্ধান্ত প্রচার করা যে, মুসলমানদের বিজ্ঞান চর্চা করা উচিত নয়। কেননা, এটা সেকুলার ও ধর্মসিদ্ধ নয়। এ শিক্ষা প্রচারের অব্যবহিত পরই মুসলিম সভ্যতা পশ্চাৎগামী হতে থাকে এবং কালক্রমে মুসলিমরা দুর্বল ও নিজেদের রক্ষায় অক্ষম হয়ে পড়েন।
আরো খারাপ হলো তখন, যখন তারা এই পশ্চাৎপদতাকে ‘আল্লাহর ইচ্ছা’ বলে প্রচার করতে থাকেন। আসলে তারা আল্লাহর এ নির্দেশকে অবজ্ঞা করেন যে, আল্লাহ ততক্ষণ উম্মাহকে সাহায্য করবেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের প্রথমে সাহায্যের চেষ্টা না করেন। অবশ্যই বিজ্ঞানের জ্ঞান অর্জনই কেবল উম্মাহকে রক্ষার সক্ষমতা এনে দেবে। যতক্ষণ তারা তা করতে ব্যর্থ হবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা প্রার্থনার কোনো জবাব পাবেন না।

অবশ্য এখনো অনেক কিছু করার আছে। কিন্তু মুসলিমদের ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক প্রাচুর্য দান করা সত্ত্বেও তারা নিজেদের রক্ষা ও সমৃদ্ধির জন্য কিছু করেননি। তথাপিও ‘ফরজে কিফায়া’ হিসেবে যা বর্ণিত, সে ব্যাপারে ইসলামের বক্তব্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট। এ নির্দেশনা মোতাবেক, মুসলিমদের মধ্যে এমন ব্যক্তিরা থাকবেন, যাদের শক্তি ও কাজ ইসলাম ও তাদের সম্প্রদায়কে রক্ষা ও উন্নয়নে ব্যবহার করতে হবে। যদি তাদের মধ্যে কেউই এটা করতে সক্ষম না হন, তবে সব সম্প্রদায়ই ভয়ানক পাপ করল বলে পরিগণিত হবে।
আমার উপলব্ধি মতে, ভালো প্রশাসক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, সৈনিক ও নেতার প্রাপ্যতা এসব অনেক পাপ থেকে মুসলিম সম্প্রদায়কে মুক্ত করতে পারবে। এসব মানুষ প্রকৃতপক্ষে ইসলামের নির্দেশাবলি বাস্তবায়ন করছে। নামাজ, দোয়া, দান-খয়রাত, হজ পালন যেখানে ব্যক্তির উপকার সাধন করে থাকে, সেখানে সম্প্রদায়ের প্রয়োজনে গৃহীত ব্যবস্থা শুধু ব্যক্তির উপকার নয়, সম্প্রদায়কে তার সাধারণ পাপ থেকে রক্ষা করবে।

দুর্ভাগ্যক্রমে মুসলিমরা ও তাদের ধর্মীয় গুরুগণ কেবল ‘ফরজে আইন’, যেমন- নামাজ, রোজা, জাকাত, হজের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন। ‘ফরজে কিফায়া’-এর ওপর সেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয় না। কিন্তু কুরআন বা হাদিসের কোথাও বলা নেই যে, পরজীবনে ‘ফরজে কিফায়া’-এর চেয়ে ‘ফরজে আইন’ কারো জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
মুসলমানেরা ভালোভাবেই জানেন, যেসব সৈনিক ইসলাম ও ইসলামি সম্প্রদায় রক্ষার জন্য মৃত্যুবরণ করেন, তারা শহীদের মর্যাদা লাভ করেন এবং তাদেরকে জান্নাতে স্থান পাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। তাই যদি হয়, তবে যারা সম্প্রদায়ের সুরক্ষা ও কল্যাণের কাজে নিয়োজিত, পরকালে ঠিক তাদের মতোই সম্মান পাবেন, যারা ধর্মের বিধিবিধান পরিপালন এবং যারা ধর্মের চর্চা, ইবাদত ও কুরআন পাঠ করেন।
সম্প্রদায়ের রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা কেবল সৈনিকগণ দেন না, এ ক্ষেত্রে আরো ভূমিকা রাখেন প্রতিরক্ষা শিল্পে যারা কাজ করেন, যারা গবেষক, উন্নয়নবিদ, প্রতিরক্ষার জন্য অস্ত্র উৎপাদক, মোট কথা, সমস্ত প্রশাসন। তবে শর্ত হলো, তাদের কাজ করতে হবে নিষ্ঠার সাথে এবং যথাযথভাবে। তারা একই পুরস্কারের দাবিদার।
অবশ্যই তাদের যদি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ এবং দুর্নীতিপরায়ণ হন, তবে তারা ভয়ঙ্কর পাপ করবেন এবং পরজীবনে তাদের শাস্তি প্রাপ্য হবে।

দেশের একজন নেতা হিসেবে আমার ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, তার পরিপালনে এবং আমার ব্যক্তিজীবনে কুরআন পাঠের ভূমিকা অপরিসীম, শ্রেষ্ঠ দিকনিদের্শনা প্রদান করেছে। আমি অনুভব করি, অন্যরাও এর থেকে উপকৃত হতে পারেন। পুরো মালয়েশিয়া যদি এভাবে ‘যথাযথ দিকনির্দেশনা’ দ্বারা পরিচালিত হয়, তবে মালয়েশিয়া একটি মহান দেশে পরিণত হবে। সাধারণ এ ধারণা নির্বাসিত হবে যে, অমুসলিম দেশ পারে, সেভাবে মুসলিম দেশ যেভাবে উন্নত হতে পারে না। সম্ভবত একটা অহমিকার উপাদান এ ক্ষেত্রে কাজ করে থাকে। কিন্তু এ সত্য চাপা দেয়া যায় না যে, তাদের কর্ম ইসলামকে একটা মর্যাদাবান ও শক্তিশালী ধর্ম হিসেবে গড়ে তুলবে।
ইসলামকে মালয়েশিয়া রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণের মাধ্যমে সাংবিধানিক বিধিকে যখন আরো অর্থবহ করার সিদ্ধান্ত নিলাম, তখন আমি এটা বুঝাতে চাইনি যে, মালয়েশিয়ার সব মানুষকে মুসলিম হতে হবে। যা আমরা চেয়েছিলাম, তা হলো, মালয়েশিয়ার নাগরিক ইসলামি মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হবেন। তাদের সবার ইসলামে বিশ্বাসী হওয়ার প্রয়োজন নেই। সেই লক্ষ্য থেকে আমার প্রধান মন্ত্রিত্বের দ্বিতীয় বর্ষে ঘোষণা দিলাম, মালয়েশিয়া সরকার ইসলামি মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হবে।

মালয়েশিয়ার বিভিন্ন বিশ্বাসের মানুষের মূল্যবোধে ভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু সেই ভিন্নতাকে অনেক বড় বা অনেক বেশি করে দেখি না। মোটের ওপর পশ্চিমা মূল্যবোধ বা কথিত সার্বজনীন মূল্যবোধ হিসেবে যাকে আমরা আখ্যায়িত করি, ভালো ইসলামি মূল্যবোধ তার সমতুল্য বলে আমি মনে করি। যদি কোনো পার্থক্য রয়েছে বলে মনে হয়, তবে তা ইসলামের শিক্ষার কারণে নয়; বরং তা তাদের ব্যাখ্যার কারণে, যারা পার্থক্য থাকা প্রয়োজন বলে মনে করে থাকেন। অবশ্য কিছু পশ্চিমা মূল্যবোধ রয়েছে, যা ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিশেষ করে সেগুলো, যা বর্তমান সময়ে উদ্ভূত। কিন্তু এমনকি মালয়েশিয়ার অমুসলিমরাও এসব মূল্যবোধ প্রত্যাখ্যান করতে চাচ্ছে।
এমনকি যুবক বয়সেও বুঝতে পারতাম না, কেন মুসলিম দেশগুলো পশ্চিমা দেশের তুলনায় পশ্চাৎপদ ও দুর্বল। এটা ইসলামের শিক্ষার জন্য হতে পারে না, যে সত্য শিক্ষা কুরআনে দেখতে পাওয়া যায় এবং যে শিক্ষা ধর্মীয়ভাবে কতগুলো শিক্ষিত মানুষ কর্তৃক প্রচারিত নয়। সত্য ঘটনা এই যে, একটা সময় ছিল যখন মুসলিম দেশগুলো পশ্চিমের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল।

আমি পড়েছি, স্পেনের আন্দালুসিয়ায় বসতি স্থাপনকারী মুসলিমরা সে সময়ের ইউরোপীয়দের তুলনায় কৃষিতে অনেক উন্নত ছিলেন। তারা পাহাড় থেকে পানি এনে জমিতে সেচ দেয়ার জন্য দীর্ঘ নালা নির্মাণ করেন। তারা ছিলেন নির্মাণকাজে অত্যন্ত দক্ষ। গ্রানাডার আল-হামরায় এখনো এর নজির বিদ্যমান। তারা পর্যটক ও বণিকদের জন্য রাস্তা নির্মাণ করেছিলেন। বণিকদের অশ্ব ও উট রাখার আস্তাবলসহ তাদের থাকার জন্য হোটেল নির্মাণ করেন। ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী এবং স্থায়ী দোকানদারদের জন্য মার্কেট তৈরি করা হয়েছিল।
তারা নক্ষত্রের গতিবিধি লক্ষ করে বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে জাহাজ পরিচালনা করতেন এবং বিস্তীর্ণ মরুভূমি পাড়ি দিতেন। আরব বণিকেরা বিশাল ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রান্তিক বন্দরগুলোতে এসে চীনা ও ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সাথে ব্যবসা ও পণ্য বিনিময় করতেন। তাদের শহর ও নগরগুলো ছিল সুপরিকল্পিতভাবে স্থাপিত এবং তাদের মসজিদগুলো তাদের দক্ষতা, পদার্থবিদ্যা ও সৌন্দর্য চেতনার পরিচয় বহন করত। তাদের সেনাবাহিনী ছিল সুসংগঠিত ও শক্তিশালী। একইভাবে তাদের ছিল শক্তিশালী নৌবাহিনী।

সব কিছুই মুসলিম ও তাদের সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব নির্দেশ করত। তথাপি তারা ছিলেন নিষ্ঠাবান মুসলিম, ধর্মীয় কর্তব্য পালনে কঠোরভাবে নিবেদিত এবং নিজ ধর্ম সম্পর্কে বিজ্ঞ। ধর্মের পণ্ডিতগণ গভীরভাবে ধর্মচর্চা এবং ইসলামের নানা দিকের ওপর পাণ্ডিত্যপূর্ণ সন্দর্ভ রচনা করতেন, এমনকি তারা বিজ্ঞান, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসাশাস্ত্রে পারদর্শিতা অর্জন করেন। সে সময় তাবৎ বিশ্ব ইসলাম ও মুসলিমদের সম্মান করত। সব ক্ষেত্রেই মুসলিমদের সফলতা তাদের জন্য এ সম্মান বয়ে এনেছিল। সফল দেশ হওয়া মানেই অনৈসলামিক দেশ হওয়া নয়। একটা দেশ তখনই সেটা হবে, যখন সে দেশ ইসলামের শিক্ষাকে অবজ্ঞা করবে। পরজগতে সুবিধা লাভের আশায় এ জগতে ব্যর্থতার বিষয়ে ইসলামের শিক্ষা কিছুই বলে না। ১৯৯৬ সালে একটা অমুসলিম রাজনৈতিক দলের সাধারণ সভায় ভাষণে ঘোষণা দিয়েছিলাম, মালয়েশিয়া একটি ইসলামি দেশ। তাতে অমুসলিমরা কোনো আপত্তি করেননি। কেননা, তারা জানতেন, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দ্বারা পরিচালিত সরকার নিরপেক্ষ এবং তাদের প্রতি ন্যায়পরায়ণ ছিল। কিন্তু কিছু মুসলিম রয়েছেন, এমনকি মালয়েশিয়াতেও যারা বিশ্বাস করেন, কোনো একটি দেশকে শুধু তখনই মুসলিম দেশ হিসেবে গণ্য করা হবে, যখন সে দেশ অপরাধীদের শিরñেদ ও হস্তকর্তন চালু করবে।

কিন্তু এটা একটি স্বেচ্ছাচারী বিচারপদ্ধতি। কুরআন ইসলামি সম্প্রদায়ের কথা বলে, ‘ইসলামি দেশ’ নয়। কুরআনে শাস্তির ওপর জোর দেয়া হয় না। প্রকৃতপক্ষে, মুসলিমদের ক্ষমা করতে এবং সদয় হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ‘সূরা আল মায়িদার ৪৫ নম্বর আয়াতে কুরআন বলছে, যারা প্রতিশোধ আদায়ের অধিকার প্রত্যাহার করে নেয়, তাদের গুনা ক্ষমা করা হবে। স্পষ্টতই ইসলাম দয়া ও ক্ষমাশীল। সর্বোপরি ন্যায় প্রতিষ্ঠাই একটি সম্প্রদায়কে ইসলামি হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।হ
লেখক : মালয়েশিয়ার দীর্ঘকালীন প্রধানমন্ত্রী, যিনি আবার নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ৯২ বছর বয়সে সম্প্রতি সে দায়িত্ব পুনরায় গ্রহণ করেছেন। তার জীবনভিত্তিক লেখা থেকে নেয়া নিবন্ধ।


আরো সংবাদ



premium cement