২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

তুরস্কের জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতা

তুরস্কের জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতা - ছবি : সংগৃহীত

তুরস্ক এশিয়া ও ইউরোপের সন্ধিস্থলে অবস্থিত একটি ইউরেশীয় দেশ। দেশটির সরকারি নাম প্রজাতন্ত্রী তুরস্ক। গত ২৪ জুন তুরস্কে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় নির্বাচনের নির্ধারিত তারিখ ছিল ৩ নভেম্বর ২০১৯। কিন্তু প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান নানা বিবেচনায় গত ১৮ এপ্রিল দেশে আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দেন এবং সে মোতাবেক ২৪ জুন প্রেসিডেন্ট ও ৬০০ সদস্যের জাতীয় পরিষদ-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ৭৮০৫৮০ বর্গকিলোমিটার আয়তন এবং আট কোটি ১০ লক্ষাধিক জনসংখ্যার দেশটির এবারের নির্বাচনে নিবন্ধিত ভোটারের সংখ্যা ছিল পাঁচ কোটি ৬৩ লাখ ২২ হাজার ৬৩২ জন। এবারের নির্বাচনটি নানা কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রথমত, এবারে প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন একই সাথে অনুষ্ঠিত হয়েছে।

দেশে ২০১৬ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর থেকে চলমান জরুরি অবস্থার মধ্যে এটি হলো। মুসলিম বিশ্বের নেতৃস্থানীয় একটি দেশ তুরস্ক। দেশটি ন্যাটো জোটের সদস্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য পদপ্রার্থী। ভৌগোলিক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের কারণে তুরস্কের নেতৃত্বের বৈশ্বিক গুরুত্ব রয়েছে। তুরস্কের ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট এবং সাম্প্রতিক নির্বাচনে অন্যতম প্রার্থী এরদোগান প্রায় ১৬ বছর ধরে দেশটির ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন। তিনি সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ, কুর্দি সমস্যা, ইরাক-সিরিয়ায় আইএস গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই, অভিবাসী সঙ্কট ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে তুরস্ককে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুরস্কের প্রভাব, আগাম নির্বাচন এবং একই সাথে প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় এবারের নির্বাচনের প্রতি বিশ্ববাসীর ছিল বিশেষ নজর।

ইতিহাসের একজন ছাত্র-শিক্ষক হিসেবে অটোমান সুলতান সুলায়মান ও নব্য তুরস্কের জনক কামাল আতাতুর্কের দেশ তুরস্ক দর্শনের স্বপ্ন আমার বহুদিনের। এবার এ স্বপ্ন পূরণের একটি সুযোগ পেয়ে গেলাম। ২৪ থেকে ২৯ জুন তুরস্কের ইস্তাম্বুল এবং আনাতোলিয়ার ঐতিহাসিক ট্রয় নগরী পরিভ্রমণে বের হলাম। তুরস্কের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ছিলেন ছয়জন। তারা হলেন ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির রজব তাইয়েব এরদোগান, কামাল আতাতুর্কের রিপাবলিকান পিপলস পার্টির মুহাররেম ইনজে, দ্য গুড পার্টি-এর মেরাল আকশেনার, কুর্দিদের দ্য পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সেলেহাতিন দেমিরতাস, ইসলামপন্থী সাদাত পার্টির তেমেল কারামুল্লাউলু এবং বামপন্থী জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল প্যাট্রিয়টিক পার্টির দেগু পেরিনজেক। সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে দু’টি রাজনৈতিক জোট এবং আরো কয়েকটি দল। রাজনৈতিক জোট দুটোর একটি হলো (জমহুর ইত্তেফাক)। এ জোটের শরিক ছিল ক্ষমতাসীন একেপি, জাতীয়তাবাদী দল এমএইচপি এবং ইসলামি জাতীয়তাবাদী বুয়ুক বির্লিক পার্টি। অন্য দিকে, ঞযব ঘধঃরড়হ অষষরধহপব (মিল্লেত ইত্তেফাক) নামক জোটে ছিল কামালপন্থী সিএইচপি, নবগঠিত ইয়ি পার্টি, ইসলামপন্থী সাদাত পার্টি এবং ডেমোক্র্যাট পার্টি। কুর্দিদের রাজনৈতিক দল এইচডিপি কোনো জোটে না গেলেও নেশন অ্যালায়েন্সের সাথেই তাদের গোপন আঁতাত ছিল। গণমাধ্যমে বলা হচ্ছিল, এবারের তুরস্কে ইতিহাসে সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোটযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ২০০২ সাল থেকে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে টানা ১৬ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট এরদোগান এবং তার রাজনৈতিক দল একেপির বিজয় নিয়ে গণমাধ্যমে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছিল। পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশগুলো এ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ইউরোপের দু-একটি দেশ ছাড়া প্রায় সব জায়গাতেই তার নির্বাচনী প্রচারণায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও বিরোধীদের প্রচারণার সুযোগ দেয়া হয়। মধ্যপ্রাচ্যের আরব নেতৃত্বের অনেকেই নির্বাচনে এরদোগানবিরোধীদের সহায়তা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এরদোগান এবং তার ক্ষমতাসীন দলকে পরাজিত করার জন্য এবার বিরোধী দলগুলো একটি শক্তিশালী নির্বাচনী জোট গঠন করে কৌশলগত প্রার্থী দাঁড় করানোর ফলে এরদোগানের বিজয় কঠিন হবে বলে পর্যবেক্ষকরাও মনে করেন।

তুরস্কের নির্বাচনসংক্রান্ত এসব ধারণা নিয়েই ২৪ তারিখ নির্বাচনের দিন সকালে ইস্তাম্বুল পৌঁছি। ট্যাক্সিতে ইস্তাম্বুলের বায়েজিত এলাকায় অবস্থিত ওয়েস্টার্ন প্লাস প্রেসিডেন্ট হোটেলের দিকে যাত্রা করলাম। আশা করেছিলাম, পথঘাটে একটি উৎসবমুখর নির্বাচনী পরিবেশ দেখব, কিন্তু কোথাও সে রকমটি চোখে পড়েনি। এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ব্যানার বা পোস্টারও কোথাও দেখলাম না। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম ভোটের কথা। এ ব্যাপারে খুব আগ্রহ দেখলাম না তার মাঝে। জানালেন এখনো ভোট দেননি, তবে আমাকে নামিয়ে ভোট দিতে যাবেন। ইস্তাম্বুল অবস্থানকালে আমাকে সাহচর্য দেয়ার কথা মারমারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণারত বাংলাদেশী সালাহ উদ্দিনের। ফোন করলে তিনি জানান, একটি নির্বাচনী কেন্দ্রে পর্যবেক্ষক হিসেবে তিনি আছেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, নানা কারণে এবারের নির্বাচনটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় ভোটের দিন বিদেশী সাংবাদিকদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি দেখা যায়। আলজাজিরার তথ্যানুযায়ী, ৩৪টি দেশের ৬০০-এর বেশি সাংবাদিক ভোটগ্রহণের খবর সংগ্রহ করেছেন। দেশী-বিদেশী বিপুলসংখ্যক পর্যবেক্ষকও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন। আমার অনুরোধে সালাহ উদ্দিন কিছুক্ষণের মধ্যেই হোটেলে চলে আসেন এবং কাছেই ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াটিক সায়েন্সেস ফ্যাকাল্টিতে স্থাপিত একটি ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনে নিয়ে যান। কেন্দ্রের প্রবেশপথে পুলিশ কর্মকর্তাকে আমার পরিচয় দিয়ে পরিদর্শনের অনুমতি চাওয়া হলে একজন কর্মকর্তা আমাকে সাথে নিয়ে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করেন। কেন্দ্রটিতে দু’টি বুথ ছিল। যেখানে দু’টি করে চারটি ব্যালটবাক্স। প্রতিটি বুথে দু’জন করে নির্বাচনী কর্মকর্তা ব্যালটবাক্স সংরক্ষণ এবং ভোটারদের ব্যালট পেপার সরবরাহ করছেন। প্রতিটি বুথে ছয়জন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর প্রত্যেকের একজন করে এজেন্ট। জিজ্ঞেস করে জানলাম, তারা সংসদ নির্বাচনেও নিজ নিজ দল বা জোটের প্রার্থীর এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন।

রাস্তাঘাটে প্রার্থীর পোস্টার বা ব্যানার দেখিনি, তেমনি ভোটকেন্দ্রেও না। এমনকি ভোটকেন্দ্রে কোনো প্রার্থী বা দলীয় কর্মীদের সঙ্ঘবদ্ধ কোনো প্রচারণাও চোখে পড়েনি। ভোটাররা আসছেন এবং অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে নিজেদের ভোট দিয়ে চলে যাচ্ছেন। সালাহ উদ্দিনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, এটি কি কোনো ব্যতিক্রমী চিত্র; না এটাই সারা দেশের নির্বাচনী চিত্র। উত্তরে তিনি জানালেন, এটাই কমবেশি সারা দেশের সাধারণ নির্বাচনী চিত্র। ভোট গ্রহণে কারচুপি কিংবা ভোটারদের প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বা জোট কোনো ভূমিকা রাখে কি না। জবাবে সালাহ উদ্দিন জানায়, তুরস্কে সে দুটো নির্বাচন দেখেছে, কোনো নির্বাচনেই ভোট কারচুপি বা কেন্দ্র জবরদখল, ভোটারদের হুমকি প্রদান বা প্রভাবিত করার কোনো অভিযোগ শোনেনি।

প্রাক-নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা সম্পর্কে আমি জানতে আগ্রহী ছিলাম। এ ব্যাপারেও প্রথমে সালাহ উদ্দিন এবং পরে আমার এক প্রাক্তন ছাত্র মারমারা বিশ^বিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থী মিনহাজুল আবেদিন এবং কোনিয়া বিশ^বিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষক শামসুজ্জামান খান রাজীবের কাছ থেকে অনেক তথ্য জানতে পেরেছি। ২৪ জুন নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও দলগুলোর প্রচার শুরু হয়েছিল মে মাসের প্রথম দিক থেকে। তবে তাদের প্রচারণার ধরন আমাদের মতো নয়। প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে সেগুলো কর্মীদের মাধ্যমে প্রত্যেক ভোটারের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে থাকে। নির্বাচনী সমাবেশ আয়োজন করে প্রার্থীরা সেখানে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা করা হয়, তবে সেটা কখনো ব্যক্তিচরিত্র হনন বা শালীনতার সীমা অতিক্রম করে না। গুরুত্বপূর্ণ শহরের জনসমাগমস্থলে দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনী বুথ তৈরি করে সেখানে ভোটারদের কাছে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরা হয়। এবারের নির্বাচনের প্রাক্কালে পবিত্র রমজান মাস থাকায় রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীরা প্রচুর ইফতার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সেখানে ভোটারদের আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালান। নির্বাচনী প্রচারণা চলাকালে উল্লেখ করার মতো কোনো সন্ত্রাসী ও সহিংস ঘটনা ঘটেনি বলে তারা জানান।

সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলে। প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা ৮৬ শতাংশের বেশি। এরপর ভোট গণনাকালে আমাদের দেশের মতো কেন্দ্রের সামনে উৎসুক জনতা বা নেতাকর্মীদের কোনো ভিড় ছিল না। এমনকি এ নিয়ে শহরের কোথাও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, সমর্থক বা সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো জটলা বা তৎপরতাও চোখে পড়েনি। তুরস্কে এখন গ্রীষ্মকাল। সূর্যাস্ত ৮টা ৪৫ মিনিটের দিকে। আমরা গেলাম ইস্তাম্বুল বিজয়ী সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহর মসজিদ দেখতে। তখনো মাগরিবের নামাজ হতে দেরি থাকায় পাশেই আমরা একটি জায়গায় গেলাম। সেখানে অনেক চায়ের দোকান। প্রতিটি দোকানেই প্রচুর লোকের উপস্থিতি।

ইতোমধ্যে অনলাইনে ভোটের ফলাফল সম্পর্কে তথ্য আসতে শুরু করেছে। তবে এ নিয়ে তখনো তেমন কোনো চাঞ্চল্য চোখে পড়েনি। মাগরিবের নামাজ পড়ে সিরিয়ান একটি রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার শেষে রাস্তায় নেমে এসে অভাবনীয় দৃশ্যের মুখোমুখি হলাম। ইতোমধ্যে নির্বাচনের ফলাফল চূড়ান্ত হয়েছে। সব আশঙ্কা ও জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান আবারো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। ইন্টারনেট খুলে দেখলাম, তিনি প্রথম দফা ভোটেই প্রয়োজনীয়সংখ্যক ভোট পেয়ে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। উল্লেখ্য, তুরস্কের নির্বাচনী বিধান অনুযায়ী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কেউ যদি ৫০ শতাংশ ভোট না পান, তবে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী দু’জনের মধ্যে দ্বিতীয় দফা ভোটযুদ্ধ হয়। কিন্তু এবারের নির্বাচনে এরদোগান ৫২.৫৯ শতাংশ ভোট লাভ করে নির্বাচিত হলেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সিএইচপির মুহরেম ইনজে পান ৩০.৬৪ শতাংশ ভোট। বাকি চারজনের মধ্যে ন্সুর চধৎঃু-এর মেরাল আকশেনারের প্রাপ্ত ভোট ৭.২৯ শতাংশ, এইচডিপি প্রার্থী সেলেহাতিন দেমিরতাসের ৮.৪০ শতাংশ, সাদাত পার্টির তেমেল কারামুল্লাউলুর .৮৯ শতাংশ এবং প্যাট্রিয়টিক পার্টির দেগু পেরিনজেকের .২০ শতাংশ।

পার্লামেন্ট নির্বাচনে এরদোগানের একে পার্টি ২৯৫টি আসন পেয়েছে। গত নির্বাচনের তুলনায় এবার তার দলের আসন কমায় একেপি সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। তবে জোটের শরিক দল এমএইচপির ৪৯টি আসন মিলিয়ে এরদোগানের জোটের আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৪৪। অন্য দিকে প্রধান বিরোধী দল সিএইচপি পার্টি লাভ করেছে ১৪৬টি আসন। এ জোটের ইয়ে পার্টির আসন সংখ্যা ৪৪টি। জোটের আরেক শরিক দল, সাদাত পার্টি কোনো আসনই পায়নি। কুর্দিশ এইচডিপি দল ৬৭টি আসন পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়।

সারা দিন ভোটের কোনো উল্লেখযোগ্য আমেজ চোখে না পড়লেও নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পরপরই পুরো দৃশ্য পাল্টে যায়। এরদোগান এবং একে পার্টির সমর্থক নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ ইস্তাম্বুলের রাস্তায় নেমে আসেন। তুরস্কের জাতীয় ও একে পার্টির পতাকা এবং এরদোগানের ছবি হাতে নিয়ে উল্লসিত জনতা বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে এবং নেচে-গেয়ে বিজয়োল্লাস প্রকাশ করেন। তবে এ উল্লাসের মধ্যে উচ্ছৃঙ্খলতা ছিল না, ছিল না বিরোধী রাজনীতিবিদ ও দলের প্রতি কোনো বিষোদগার। শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল বিজয় উদযাপন। রাতেই বিজয়ী প্রেসিডেন্ট এরদোগান ইস্তাম্বুলে এক জনসমাবেশে ভাষণ দেন। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে তার এ ভাষণ সরাসরি প্রচার করা হয়। ভাষণে তিনি তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনর্নির্বাচিত করায় এবং তার দলের প্রতি আস্থা রাখায় দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এরদোগান তার ভাষণে নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়ন এবং তার ‘ভিশন ২০২৩’ অর্জনে দেশবাসীর সহযোগিতা কামনা করেছেন।

তুরস্কের নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশের পর এরদোগানের বিরোধীদের পক্ষ থেকে অনিয়মের কিছু ছোটখাটো অভিযোগ উত্থাপন করা হলেও সবাই এ ফলাফল মেনে নিয়েছেন এবং বিজয়ী এরদোগানকে অভিনন্দন জানান। নির্বাচনের পর আরো পাঁচ দিন তুরস্কে ছিলাম। এ সময় সহিংসতা বা উত্তেজনার কথা শুনিনি। ইস্তাম্বুলসহ কয়েকটি নগরীতে বিজয়ী প্রেসিডেন্ট এরদোগানের পক্ষ থেকে তার দল কর্তৃক দেশবাসীকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে টানানো কিছু ব্যানার ও বৈদ্যুতিক বিলবোর্ড চোখে পড়েছে। এর বাইরে সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পরবর্তী কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন প্রত্যক্ষ করা আমার জন্য একটি বিশেষ অর্জন। এ নির্বাচন প্রত্যক্ষ করে সে দেশের নির্বাচনী সংস্কৃতির প্রত্যাশিত রূপ দেখলাম। একই সাথে মনটা বিষাদে ভরে গেল আমার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচনী চিত্রের কথা মনে করে। আমার দেশের নির্বাচনের কী হাল? ১৯৯০ সালের একটি গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশে যে গণতান্ত্রিক ধারার সূচনা হয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে দেশের মানুষ নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের যে অধিকার লাভ করেছিল, তার আজ কী করুণ পরিণতি। ২০১৮ সাল আমাদের জাতীয় নির্বাচনের বছর। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন এবং তৎপরবর্তী স্থানীয় সরকারগুলোর নির্বাচনের বেহাল দশা দেখে আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে এ দেশবাসীর খুব আস্থা আছে বলে মনে হয় না। তবুও আমরা আশাবাদী হতে চাই। ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যেন কোনোভাবেই অপমৃত্যু না হয়। রাজনীতিবিদদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক, গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করুক; এ প্রত্যাশাই আমাদের সবার।

লেখক : অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢা.বি.


আরো সংবাদ



premium cement