২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

ওয়াশিংটন-আঙ্কারা টানাপড়েন : নেপথ্য ঘটনা

ওয়াশিংটন-আঙ্কারা টানাপড়েন : নেপথ্য ঘটনা - ছবি : সংগৃহীত

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তিনি সমঝোতা পছন্দ করেন আর এটা যদি হয় তুরস্কের সাথে তাহলে তো অনেক সম্ভাবনার মধ্য থেকে যেকোনো একটি বেছে নেয়ার সুযোগ থাকে। এর মধ্যে বিশেষভাবে অন্তর্ভুক্ত আছে মার্কিন কংগ্রেসের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা তুরস্কের রাশিয়া থেকে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এস-৪০০ কেনার বিষয়টি।

তুরস্কের এস-৪০০ ক্রয়ের বিষয়টি রাশিয়ার ওপর মার্কিন অবরোধের ঠিক কোন ধারা অমান্য করা হবে। আগে এটি সরবরাহ করা হোক বা সক্রিয় করা হোক কিন্তু এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে একমাত্র তারই অধিকার আছে বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখার কিংবা যদি তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, এখানে জাতীয় নিরাপত্তার মতো বিষয় বিবেচনা করার অবকাশ আছে।

নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তুরস্কের একজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক জানিয়েছেন, আঙ্কারা এরই মধ্যে একটি প্রস্তাবনা তৈরি করেছে যা ওয়াশিংটনের জন্য হবে সবচেয়ে কল্যাণকর। ওই কর্মকর্তার মতে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসৌলু তার সর্বশেষ ওয়াশিংটন সফরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওকে বলেছেন, এস-৪০০ এর জন্য রাশিয়ার সাথে যে চুক্তি এরই মধ্যে হয়ে গেছে তা তুরস্ক বাতিল করতে পারবে না। যদিও পম্পেওকে তিনি এও বলেছেন যে, তুরস্ক ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে কাজ করতে আগ্রহী এবং একই সঙ্গে এই প্রতিশ্রতিও দিচ্ছে যে, এই আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দেশটিতে ন্যাটোর মোতায়েন করা প্রতিরক্ষাব্যবস্থার জন্য হুমকি হবে না।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘অবশ্যই আমরা ন্যাটোর অংশ, কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য কোনো ঝুঁকিও আমরা চাই না।‘ ওয়াশিংটনের শঙ্কা কমানোর জন্য তুরস্ক এরই মধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। রাশিয়া প্রস্তাব দিয়েছিল, আগামী ৯ মাসের মধ্যে তুরস্কের মাটিতে রুশ সেনাবাহিনীর কারিগরি বিভাগের কর্মীদের মাধ্যমে এস-৪০০ সরবরাহ ও মোতায়েন করা হবে। কিন্তু আঙ্কারা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে মস্কোকে অনুরোধ করেছে তাদের সেনারা যেন তুরস্কে না এসে বরং প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সংযোজন, মোতায়েন ও পরিচালনার জন্য তুর্কি সেনাকর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয় কিংবা ন্যাটো নিয়ন্ত্রিত এলাকায় অন্য কোনোভাবে এর ব্যবস্থাপনা করে। আর এ কাজ সম্পন্ন হতে লাগবে ১৯ মাস।

পঞ্চম প্রজন্মের এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান প্রতিরোধে এস-৪০০ মোতায়েনের ফলে গোয়েন্দা ঝুঁকির বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসন সাম্প্রতিক কালে আরো বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। বেশ কয়েকজন মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, এস-৪০০ রাডার তুরস্কের এফ-৩৫ এর তথ্য সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দিতে সক্ষম। আর এর ফলে এই যুদ্ধ বিমানের দুর্বলতা ও এর নির্মাণ কাঠামোর বিস্তারিত চলে যেতে পারে রাশিয়ার হাতে। অবশ্য তুরস্কের কর্মকর্তারা এই সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, তারা পরিকল্পনা করছেন এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা হবে তাদের নিজেদের সফটওয়্যার-এর মাধ্যমে এবং এর সঙ্গে রাশিয়া কিংবা ন্যাটোর নেটওয়ার্কের কোনো সংযোগ থাকবে না।
আরো একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট যে, ট্রাম্প প্রশাসন একটি মধ্যবর্তী সমঝোতা খুঁজতে কাজ করছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের ইউরোপীয় অঞ্চল ও ন্যাটো’র নীতিবিষয়ক উপসহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী থমাস গফাস সম্প্রতি বলেছেন, তুরস্ক একটি সার্বভৌম দেশ এবং এ কারণেই সে দেশের কর্মকর্তারা নিজেদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।

গফাস বলেন, ‘পশ্চিমা প্রযুক্তির কী ধরনের ঝুঁকি আছে তা মূল্যায়ন করার জন্য আমাদের একটি আলাদা প্রক্রিয়া আছে এবং এই ক্রয় কার্যক্রমেও সে ব্যাপারটি থাকতে পারে।’ এর অর্থ হলো, কোনো প্রকার ঝুঁকি তৈরি করা ছাড়াই এফ-৩৫ ও এস-৪০০ এর মতো জটিল প্রযুক্তির যেন সহাবস্থান থাকতে পারে এমন একটি সমাধান পেন্টাগন খুঁজছে।

তুরস্ক এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পরিদর্শনের যে প্রস্তাব মার্কিনিদের দিয়েছে তা অনেক বড় একটি সুযোগ এবং এর মাধ্যমে তারা এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা এই পরিদর্শন সম্ভাবনা নিয়ে এরই মধ্যে উদ্বিগ্ন। তুরস্কের একজন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেছেন, তুরস্ককে এ ধরনের উন্নত প্রযুক্তি দেয়ার ক্ষেত্রে এস-৪০০ চুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত রুশ কর্মকর্তাদের হতাশ করেছে। তুরস্ক ওয়াশিংটন ও মস্কোর মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্যমূলক অবস্থান গ্রহণের চেষ্টা করছে।

আরো পড়ুন :

অভিবাসী নীতি : মার্কেলের উদারনীতির বিজয়
হামিম উল কবির

অভিবাসী প্রশ্নে ক্রিশ্চিয়ান সোস্যাল ইউনিয়ন নেতা ও জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হস্ট সেহফারের কঠোর নীতির বিপরীতে জার্মান চ্যান্সেলর এঞ্জেলা ম্যারকেলের উদারনীতি বিজয়ী হয়েছে। শুধু জার্মানির অভ্যন্তরেই নয়Ñ ইতালি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড ও চেক প্রজাতন্ত্রের সরকারগুলো একই সুরে অভিবাসীদের বিরোধিতা করছিল। শেষ পর্যন্ত ২৮ জুন রাতে ব্রাসেলসের বৈঠকে উদারনীতিরই বিজয় হলো। ইতালি ও গ্রিসে আসা অভিবাসীদের সমানভাগে ভাগ করে নেয়ার জার্মান প্রস্তাব সবাই মেনে নিয়েছে হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ড ছাড়া। জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হস্ট সেহফারও শেষ পর্যন্ত অভিবাসন রাজনীতিতে চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মারকেলের কাছে হেরে গেলেন। পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েও পদত্যাগ করেননি।

অভিবাসীদের সমানভাগে ভাগ করে নেয়ার সিদ্ধান্তে অ্যাঞ্জেলা ম্যারকেল সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অভিবাসন ইস্যুতে ম্যারকেলকে ‘সরকারে না থাকার’ আল্টিমেটাম দিয়েও শেষ পর্যন্ত অটল থাধকতে পারেননি। সেহফার জানিয়ে ছিলেন, ‘অবৈধ অভিবাসীদের বাধা দিতে অস্ট্রিয়া ও জার্মানি সীমান্তে পুলিশ মোতায়েনের সিদ্ধান্তে তিনি যে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন তা থেকে তিনি সরে এসেছেন।’ সেহফার অভিবাসীদের জার্মানিতে তাদেরই প্রবেশের অনুমতি দিতে চান যারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্য কোনো দেশে এর আগে আশ্রয় প্রার্থী ছিল।
কেন অভিবাসী নিতে চায় জার্মানি এবং অ্যাঞ্জেলা মারকেল নিজের দেশে অনেক বিরোধিতা সত্ত্বেও অভিবাসীদের পক্ষ নিলেন ? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে জার্মানির জনসংখ্যা ও অর্থনীতির দিকে তাকালে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রিপোর্ট অনুসারে ২০১৩ সালে জার্মানির জনসংখ্যা ছিল ৮ কোটি ১৩ লাখ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এদের এত কম যে, এই হার অব্যাহত থাকলে ২০৬০ জার্মানির জনসংখ্যা কমে দাঁড়াবে সাত কোটি আট লাখে।

একই রিপোর্ট অনুসারে ২০১৩ সালে ব্রিটেনে জনসংখ্যা ছিল ছয় কোটি ৪১ লাখ। ২০৬০ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে ৮ কোটি ১০ লাখে। এ তথ্য অনুসারে জার্মানি ও ফ্রান্সকে পেছনে ব্রিটেন এগিয়ে যাবে জনসংখ্যায়। বাড়তি জনসংখ্যাকে এক সময় আমেরিকান ও ইউরোপীয়রা দায় হিসেবে দেখালেও এবং মুসলিম বিশ^কে জনসংখ্যা কমিয়ে আনার জন্য চাপ ও আর্থিক সহায়তা করে গেলেও এখন তারাই জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ইউরোপ অথবা আমেরিকানদের মধ্যে জন্ম হার এত কম যে, তাতে জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে।

ফলে এক সময় কর্মক্ষম জনসংখ্যা না থাকায় উৎপাদন হ্রাস পেতে বাধ্য। পরিণতিতে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়তে পারে। এ যুক্তিতে এখন ইউরোপ ও আমেরিকার কিছু দেশ অভিবাসী নিয়ে কর্মক্ষম হাত বাড়াতে চাচ্ছে। কেউ নিচ্ছে কেবল দক্ষ জনশক্তি যেমন কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশ। কিন্তু জার্মানি নিয়েছে একেবারেই ১০ লাখের বেশি অভিবাসী। এর বেশির ভাগ সিরিয়া থেকে আগত মুসলিম অভিবাসী।
জার্মানির অর্থনীতিবিদেরা এ মুহূর্তে বলছেন যে, অভিবাসন খারাপ কিছু নয়। যে ভাবে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে তাতে জার্মানিতে ২০৬০ সালের মধ্যে তাদের জন্য পেনশন, স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য সেবা দিতে জিডিপির ৫ শতাংশ চলে যাবে। অর্থনীতিবিদেরা ইতোমধ্যে হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন জন্মহার হ্রাস পাওয়ায় আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে জার্মানিতে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমে যাবে ৬০ লাখ। জার্মান অর্থমন্ত্রী সিগমার গ্যাব্রিয়েল ২০১৫ সালে বিশালসংখ্যক অভিবাসী নেয়ার আগে সংসদে যে ভাষণ দিয়ে ছিলেন তার সারসংক্ষেপ করলে এমন দাঁড়ায় যে, ‘অভিবাসীদের দক্ষ করে তাদের হাতে কাজ দিতে পারলে তারা সম্পদে পরিণত হবে।

জার্মান অর্থনীতি আরো শক্তিশালী হবে।’ বিপরীতে কর্মক্ষম হাত না বাড়াতে পারলে ২০৫০ সালের পর জার্মান অর্থনীতির সূচক শুধুই নিচের দিকে নামবে। জার্মানদের দিয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কাক্সিক্ষত মানে পৌঁছানো সম্ভব নয়। বিকল্প হিসেবে অ্যাঞ্জেলা মারকেলের সরকার নিজ দেশে কট্টরপন্থীদের বিরোধিতা সত্ত্বেও অভিবাসী নেয়ার ঝুঁকি নিয়েছেন।

ইতালি ও গ্রিসে আসা অভিবাসীদের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব সদস্য দেশে সমানভাবে ভাগ করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও পূর্ব ইউরোপের দুই দেশ হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ড এ পরিকল্পনা একেবারে নাকচ করে দিয়েছে। এ দুই দেশের জনসংখ্যা সমস্যা অবশ্য অন্য দেশগুলোর মতো নয়। আবার এ দুই দেশ ইউরোপের অন্যান্য দেশের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে। ফলে এরা অভিবাসী প্রশ্নে বিরোধিতা করবে এটাই স্বাভাবিক।


আরো সংবাদ



premium cement