১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আবুল বাজনদার

আবুল বাজনদার - ছবি : সংগৃহীত

যেদিন প্রথম ডাক্তারি শুরু করেছি, সে দিন থেকেই দেখে আসছি আমাদের বেশির ভাগ লোক কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে জানেন না। বরং যে উপকার করবে, অনেকেই তার ক্ষতি এবং তার বিরুদ্ধে অত্যন্ত আপত্তিকর অভিযোগ করবে!

নিজে ডাক্তারি করতে গিয়ে অনেকবার এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হয়েছি। ইন্টার্নশিপের সময় গাইনি বিভাগে সন্তান প্রসবের পর এক মহিলার প্রস্রাবের নমুনা পরীক্ষা করার জন্য প্যাথলজি বিভাগে পৌঁছানোর প্রয়োজনে কোনো স্বজন উপস্থিত ছিল না। এটা জেনে নিজ হাতে তার প্রস্রাবের নমুনার পরীক্ষানল প্যাথলজি বিভাগে পৌঁছে দিয়ে টাকার রসিদ রোগীর হাতে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। পরবর্তীকালে মেয়েটি অভিযোগ করেছে, ‘কোনো ডাক্তারই নাকি আসে না। চিকিৎসা নাকি হচ্ছে না!’

ইন্টার্নি থাকাকালে মেডিসিন বিভাগে এক রোগী বুকে ব্যথা নিয়ে ভর্তি হয়। তাকে প্রয়োজনীয় ওষুধ প্রয়োগ করলাম। কাগজপত্র লেখালেখি করাসহ শুধু তার জন্য আধা ঘণ্টার মতো সময় দিতে হলো। জিজ্ঞাসা করলাম, এখন কেমন লাগছে? ব্যথা কমছে কি না। বলল, একটু কমেছে। চেহারার দিকে তাকিয়ে নিজেও বুঝতে পারলাম, ব্যথা কমেছে। তবে মাত্র দুই মিনিট পরই আক্ষেপ করে রোগী বলল, ‘আমার জন্য এখনো কিছুই করলেন না?’

এক রোগীকে রাত ৪টায় চিকিৎসা দিয়েছি। পরের সকালেই সে তার বেডের ডাক্তারকে বলেছে, রাতে কোনো ডাক্তার ছিল না ওয়ার্ডে। অথচ সেই রাতে ওয়ার্ডের সেই কক্ষের আরো দুই রোগীকেও রাত ১১টায় এবং ভোর সাড়ে ৪টায় চিকিৎসা দিয়েছি।

একসময় ওয়ার্ডে ১৩-১৪ বছর বয়সী এক ছেলে ভর্তি হয়েছিল। তার অবস্থা ছিল গুরুতর। ছুটির দিন ছিল। সকালে চারজন ডাক্তার ডিউটিতে ছিলাম। প্রায় ৪০ জনের মতো রোগী সে ওয়ার্ডে। ডিউটিরত ডাক্তারদের মধ্যে আমি ছিলাম সবার সিনিয়র। শুধু সেই ছেলেটির জন্য একজন ডাক্তারকে আলাদা করে নিয়োগ করেছিলাম।
আমরা বাকি তিনজন ৩৯ জন রোগী দেখছিলাম। এর মধ্যেও নিজে থেকে সেই ছেলেটির শারীরিক অবস্থা সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছিলাম। ছেলেটির অবস্থা হঠাৎ খুব খারাপ হয়ে যায়। সকালে বিভাগীয় প্রধান এসে রোগীকে দেখে পরামর্শ দিয়ে গেলেন আমাদের।

জুনিয়রকে দৌড়ের ওপর রেখেছিলাম ছেলেটির জন্য। সেই জুনিয়র ডাক্তারকে নিজে গিয়ে আইসিইউ এবং বক্ষব্যাধি বিভাগে রেফারেল পৌঁছাতে বাধ্য করেছি। দুঃখের বিষয় ছেলেটি মারা যায়। তারপর ছেলেটির মা বলতে থাকে, একটা ডাক্তারও ছিল না। কোনো চিকিৎসাই হয়নি!

রোগী বেঁচে গেলে স্বজনেরা বলে, আল্লায় সারাইছে। মারা গেলে বলে, ডাক্তার ছিল না। ডাক্তারের দোষ। ডাক্তারের অবহেলা আর ভুল চিকিৎসা। আল কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘বস্তুত তাদের কোনো কল্যাণ সাধিত হলে তারা বলে যে, এটা সাধিত হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর যদি তাদের কোনো অকল্যাণ হয়, তবে বলেÑ এটা হয়েছে তোমার পক্ষ থেকে।’ (সূরা নিসা, আয়াত-৭৮)

আসলে এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আমাদের রোগীদের নিত্যনৈমিত্তিক আচরণ এগুলো।
এ ধরনের দুঃখজনক ঘটনার সর্বশেষ উদাহরণ, আবুল বাজনদার। ভ্যানচালক হিসেবে দিন আনে দিন খায় অবস্থায় ছিল। অপুষ্টিতে ভুগছিল। হঠাৎ তার একটি রোগ দেখা দেয়। সে হয়ে ওঠে ‘বৃক্ষমানব’। প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা চলে আড়াই বছর। ২৫ বার অপারেশন হয়েছে তার।

ঢাকা মেডিক্যালে তাকে আদর যত্নে চিকিৎসা এবং উন্নত পরিবেশে উন্নত খাবার দেয়া হয়।
তার আড়াই বছর আগের চেহারা আর এখনকার চেহারা তুলনা করলেই তা বুঝা যায়। সে শেষ পর্যন্ত নাকি হাসপাতাল থেকে পালিয়েছে। তারপর ডাক্তারদের বিরুদ্ধে মিডিয়াতে অভিযোগও করেছে!

নিজে মোটা চালের ভাত খেয়েই বড় হয়েছি। এখন মোটা চাল খাওয়া হয় না, কারণ সেটা হাতের কাছে পাই না। পেলে আগ্রহভরে খাবো। কিন্তু আবুল বাজনদার নাকি মোটা চালের ভাত খেতে পারে না। অথচ হাসপাতালের অন্য সব রোগী সরবরাহকৃত মোটা চালের ভাতই খায়। অন্য রোগীরা এসি ছাড়া দিন কাটায়। তার নাকি এসি ছাড়া চলে না!

১০ বছর ধরে ডাক্তারি করি। কোথাও কোনো জমি কেনা তো দূরের কথা, লেখাপড়া করতে ঢাকায় এসে ছোট দু’টি কক্ষের সাবলেটে থাকি। একটি বেসিনও নেই। সরু গোসলখানা। গোসল করার সময় বালতি রাখতে চাইলে নিজে ঠিকমতো জায়গা নিয়ে দাঁড়াতে পারি না। বারান্দা তো নেই-ই!

শুনেছি, ঢাকা মেডিক্যালের চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের প্রফেসর কবির চৌধুরী স্যার আবুল বাজনদারকে মোট ছয় লাখ টাকা দিয়েছেন বাড়ি করার জন্য! দরিদ্র পরিবারের এসএসসি, এইচএসসি পাস কত যুবক একটি চাকরির খোঁজে ক্লান্ত। বেশির ভাগ চাকরির জন্য কম্পিউটারের ব্যবহার জানা আবশ্যক। কম্পিউটারের নানামুখী ব্যবহার শেখার জন্য ২০-৩০ হাজার টাকার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলেই চলে।

আবুল বাজনদারকে ছয় লাখ টাকা না দিয়ে ২০ জন এইচএসসি পাস বেকার যুবককে ৩০ হাজার টাকা করে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের জন্য দিলে তারা সবাই কম্পিউটার ব্যবহার শিখে ভালো চাকরি পায় এবং ৩০ হাজার টাকার মূল্য বুঝতে পারে! কিন্তু আবুল বাজনদার ছয় লাখ টাকার মূল্য দিতে জানল না!
লেখক : চিকিৎসক, ঢাকা মেডিক্যাল
কলেজ হাডপাতাল


আরো সংবাদ



premium cement