২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গাজীপুরে বেড়ায় ক্ষেত খেয়েছে

গাজীপুর সিটি নির্বাচনের একটি কেন্দ্রের দৃশ্য - ছবি : নয়া দিগন্ত

যেমন আশঙ্কা করা গিয়েছিল, মিডিয়া রিপোর্ট থেকে প্রতীয়মান তার চেয়েও খারাপ হয়েছে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এমনকি খুলনার চেয়েও খারাপ। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কোনো ভালো নির্বাচন আমরা কোনো দিনই দেখিনি- না ১৯৭৩ সালে, না ২০১৪ সালে। এ দলের দেশের শাসনভার জবরদখল করার প্রবণতা আমরা স্বাধীনতার পর থেকেই দেখে আসছি। শুধু এদের কথাই বলব কেন। বাংলাদেশের ৪৭ বছরের ইতিহাসে এমন একটি দল দেখলাম না, যারা নির্বাচনকালে দায়িত্বশীল আচরণ করেছে। নির্বাচনে এ ধরনের জবরদস্তি ১৯৯৬ সালে বিএনপিও করেছিল। তবে এ দলটি ধন্যবাদ পেতে পারে এ কারণে যে, তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে যথাশিগগির পুনর্নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর সৎ সাহস দেখিয়েছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে ‘নিয়ম রক্ষার নির্বাচন’ বলে জাতিকে আশ্বস্ত করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সরকার তার চেয়েও খারাপ ও ত্র“টিপূর্ণ একটি নির্বাচনের ফলাফলকে গায়ের জোরে এবং প্রতিবেশী একটি দেশের খুঁটির জোরে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে চার বছরের অধিককাল পার করে দিলো। এ কারণে ইতিহাসে বিএনপি সরকার যদি ধন্যবাদার্হ্য হয় তবে আওয়ামী লীগ সরকারকে অবশ্যই নিন্দার্হ্য হতে হবে।

২০১৪ সালের পর দেশে যে ক’টি স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়েছে তার প্রায় সব ক’টাই আওয়ামী লীগ সরকারের দখলদারিত্বের অধীনে হয়েছে। ব্যতিক্রম হিসেবে কুমিল্লার নাম উল্লেখ করা যায়। আমি নারায়ণগঞ্জের নাম উল্লেখ করলাম না, কারণ সেখানে আওয়ামী লীগের স্বনামধন্য প্রার্থী ছিল যে এর আগেও দলীয় প্রার্থী না হয়েও নিজ যোগ্যতা বলে বিজয়ী হয়েছিল। আর রংপুরে জাতীয় পার্টির প্রার্থী জিতলেও তা আওয়ামী লীগ সরকারের ঘরানারই লোক। তাই সেটাও উল্লেখ্য নয়। ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পাঁচটি নির্বাচনে বিএনপি জিতার কারণে আওয়ামী লীগ সরকার আতঙ্কিত হয়ে নির্বাচন কৌশল পাল্টে ফেলে। এখন আওয়ামী লীগ সরকার বেপরোয়া। যেকোনো নির্বাচনে ছলেবলে কৌশলে তাকে জিততেই হবে। কারণ, এটা জাতীয় নির্বাচনের বছর। আওয়ামী লীগ সরকার এ নীতি গ্রহণ করেছে যে, ‘উই আর টু উইন বোথ দ্য ব্যাটল অ্যান্ড দি ওয়ার’। স্থানীয় সরকার নির্বাচন ‘ব্যাটল্’ এবং জাতীয় নির্বাচন ‘ওয়ার’। কোনো প্রকার ছাড় তারা দেবে না। হালের খুলনা ও গাজীপুর তার প্রমাণ।

গাজীপুরে যা ঘটে গেল তাতে বোঝা যায় আওয়ামী লীগ সরকার কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেই নয়, নির্বাচন কর্মকর্তাদেরও নিজেদের বিজয়ের কাজে লাগাতে পিছপা হয়নি। সেখানে কেন্দ্র দখল, নির্বাচন কর্মকর্তা দখল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দখল সবই হয়েছে। যে কারণে আওয়ামী লীগ কর্মীরা সেখানে লাখেরাজ পেয়েছে। তারা যে যেভাবে পেরেছে দেদার ব্যালট পেপার ছিনতাই করেছে এবং নিজেদের প্রার্থীর মার্কায় সিল মেরেছে ও ব্যালট বাক্স ভরেছে। তাদের মোটো ছিল শুধু জেতা নয়, বিপুল ব্যবধানে জিততে হবে। যেন কেউ ‘খোঁড়া’ যুক্তি দেখাতে না পারে যে ভোট কারচুপি হয়েছে। তাই দশ বিশ হাজারের ব্যবধান নয় লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধান দেখাতে হবে যেন কোনো প্রতিবাদ ধোপে না টেকে। এ কাজে সহায়তা করেছে ক্ষেত্রবিশেষে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচন কর্মকর্তারা। নির্বাচন কমিশনের পাঁচজন লোকের বিপুল সাংবিধানিক ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের যেন কিছুই করার নেই একমাত্র সাফাই গাওয়া ছাড়া। এর প্রতিবাদে তারা বড়জোর পদত্যাগ করতে পারেন।

এই যেখানে অবস্থা সেখানে জাতীয় নির্বাচন কেমন হতে পারে? সবাই বলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হয় না। যে নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হয় না তাতেই যদি এই অবস্থা, তবে যে নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হবে তাতে কী অবস্থা দাঁড়াবে। ভাবুন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার জন্য নির্বাচনব্যবস্থাকে ভণ্ডুল করে দিয়েছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার জিতবে নাকি বিএনপি জিতবে তার চেয়ে বড় কথা হলো কেমন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে হার-জিত নির্ধারিত হলো তা বিবেচনা করা। আমরা সাধারণ লোক দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চাই, যাতে সব ভোটার স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। আমরা ভোটাধিকার প্রয়োগের স্বাধীনতা চাই। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ভিত্তিতে যদি আওয়ামী লীগ সরকারই আবার ক্ষমতায় আসে, তবে কারো কিছু বলার নেই। কিন্তু অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে মনে হয় আওয়ামী লীগ সরকার দেশের জনগণকে সে সুযোগ দিতে রাজি নয়। তাদের ক্ষমতা চাই; জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের স্বাধীনতা চুলায় যাক। এটা কোনো গ্রহণযোগ্য থিউরি হতে পারে না।

নির্বাচন এখন যেমনটা হচ্ছে যদি তাই হয় তবে জনগণের অর্থ ব্যয় করে এই লোক দেখানো নির্বাচন করার দরকারটাইবা কী। বিএনপি পড়েছে শাখের করাত পরিস্থিতিতে। নির্বাচনে গেলে জোরজবরদস্তি হার, না গেলে দোষ যে তারা নির্বাচন ব্যতিরেকে ভিন্ন পন্থায় ক্ষমতায় আসতে চায়। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন নির্বাচনে বিএনপি কস্মিনকালেও ক্ষমতায় আসবে না বা আসতে দেয়া হবে না। এটা নিশ্চিত বলা যায়; আমার আশঙ্কা যদি মিথ্যা প্রমাণিত হয় খুশি হবো। নানাবিধ প্রতিকূলতার মধ্যে তবু বিএনপি স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো করে যাচ্ছে। আমি তো মনে করি বিদ্যমান ব্যবস্থায় ও পরিস্থিতিতে আগামী রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও বিএনপিকে খুলনা এবং গাজীপুরের ভাগ্য বরণ করতে হবে। তবুও বিএনপি সেখানে নির্বাচনে যাচ্ছে। এ জন্য আওয়ামী লীগ সরকারকে বিএনপির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। যদিও অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় আওয়ামী লীগ সরকার চায় না বিএনপি কোনো নির্বাচনে আসুক। বিএনপি একটি বড় দল তাই আওয়ামী লীগ সরকার যদি বিএনপিকে সমীহ না করে তবে আওয়ামী লীগ ঘরানার বাইরের কেউ আওয়ামী লীগ সরকারকে সমীহ করবে না। হয়তো এরা জোর করে একটি নিকট প্রতিবেশীর সমর্থনে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে ক্ষমতায় থাকতে পারবে, কিন্তু ভোটাধিকার বঞ্চিত দেশের লোক তাদের ক্ষমার চোখে দেখবে না। এর পরিণতি কী হতে পারে তা অবশ্য আমরা কেউ বলতে পারি না। প্রতিহিংসার রাজনীতি কোনো দিনও কোনো দলের জন্য সুফল বয়ে আনে না।

একটি দেশের জন্য কোনো ব্যক্তি বা দল অপরিহার্য নয়। আজ যদি আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি বিলুপ্ত হয়ে যায় তবে দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না। ব্রিটেনে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে লিবারেল পার্টি বহু দিন ক্ষমতায় ছিল। আজ বহু বছর এ দল ্িবলুপ্ত এবং বিস্মৃত প্রায়। তাতে করে ব্রিটেনের কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি হয়নি। ভারতে কংগ্রেস এককালে দোর্দণ্ড প্রতাপে দেশ শাসন করেছে, আজ তাদের জনপ্রিয়তা তলানিতে। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম টানা তিন দশকেরও অধিককাল ক্ষমতায় ছিল, আজ তারা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। এমন অনেক উদাহরণ টানা যায়। আমাদের বাংলাদেশের কথাই বলি না কেন। জাতীয় পার্টি অনুগ্রহ-লালিত বিরোধী দলকে সংসদে বসিয়ে দেশ শাসন করেছে; আজ সে দল সংসদে নিজেই অনুগ্রহ-লালিত বিরোধী দল। ওই যে কথায় বলে না ‘সকাল বেলা আমির রে ভাই ফকির সন্ধ্যা বেলা’ কিংবা ‘চিরদিন কারো সমান যায় না’। তাই ইতিহাস যাতে কলঙ্ক লেপন না করতে পারে সেভাবে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ।

জাতি হিসেবে বাংলাদেশীদের মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন একান্ত জরুরি। অন্যথায় জাতিকে মূল্য দিতে হবে। যেমনটা দেশে বিদেশে নিন্দিত বিগত ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর বর্তমান সরকারকে দিতে হয়েছে। বর্তমান সরকারপ্রধান নিজেই বলেছেন, তিনি ভারতকে যা দিয়েছেন তা ভারত চিরদিন মনে রাখবে। তিনি ভারতকে যা-ই দিয়েছেন এটা তিনি দিয়েছেন এ দেশের জন্য কোনো কিছু প্রাপ্তি ছাড়া কেবল ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। এ দানে দেশের কোনো গৌরব নেই, আছে ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থের অভীপ্সা। নিকট বৃহৎ প্রতিবেশীকে এ দানের প্রতিদানে তিনি যদি পুনর্বার ক্ষমতায় আসার অভিলাষ চরিতার্থ করতে চান তবে তিনি ভুল করবেন। ইতিহাস তাকে ক্ষমা করবে না। ক্ষমতায় আরোহণের ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য আওয়ামী লীগ যা করছে তা যদি বিএনপি করত তবে আমি বিএনপির সমালোচনায় একই কথা বলতাম।হ
লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা কাডার


আরো সংবাদ



premium cement
কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পান, সেভাবেই ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে : কৃষিমন্ত্রী চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে সিএনজি ও বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ২, আহত ৪ ভান্ডারিয়ায় ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা দেখতে দর্শনার্থীদের ঢল তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে ৭ দিন স্কুল বন্ধের দাবি চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত বিএনপি সাম্প্রদায়িক শক্তি, এদের রুখতে হবে : ওবায়দুল কাদের সাদিক এগ্রোর ব্রাহামা জাতের গরু দেখলেন প্রধানমন্ত্রী ভারতে লোকসভা নির্বাচনে প্রথম ধাপে ভোট পড়েছে ৬০ শতাংশ সারা বিশ্ব আজ জুলুমবাজদের নির্যাতনের শিকার : ডা. শফিকুর রহমান মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশী : পররাষ্ট্রমন্ত্রী চন্দনাইশ, বাঁশখালী ও বোয়ালখালীতে ৩ জনের মৃত্যু

সকল