অনুপম প্রবাহিণী ‘হালদা’
- সৈয়দ মুহম্মদ জুলকারনাইন
- ০৪ জুলাই ২০১৮, ১৯:৫৯
নদী বাংলাদেশের প্রাণশক্তি। আমাদের ঐতিহ্যের গৌরবের যা কিছু, নদীকে কেন্দ্র করেই। এ দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির পরতে পরতে জড়িয়ে আছে নদী প্রসঙ্গ। নদীর বদৌলতে আমাদের দেশ সবুজ, সতেজ ও তৃণময়। নদীমাতৃক দেশ হিসেবে এ অঞ্চলের যোগাযোগ ও মালামাল পরিবহনের প্রধানতম মাধ্যম ছিল নদীপথ। এ ব্যবস্থা সঙ্কোচিত হলেও অনেক এলাকাতে এখনো বিদ্যমান। দেশের অর্থনীতির সাথে নৌ-পরিবহন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যেকোনো দিক থেকে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। গুরুত্বের কথা বিবেচনায় নিয়ে ভারত, পাকিস্তান, আমেরিকা ও মিসর একটি করে নদীকে জাতীয় নদী ঘোষণা করেছে। অবশ্য আমেরিকা ‘বাফেলো’ ছাড়াও আরো চারটি নদীর কিছু অংশকে জাতীয় নদীর আওতায় এনেছে। এতে দেখা যাচ্ছে মডেল হিসেবে একটি নদীকে জাতীয় নদীর মর্যাদা দিয়ে তার রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচর্যা ও দূষণমুক্ত রাখার ফলে সে দেশের অন্যান্য নদীর প্রতিও অনুরূপ দায়বদ্ধতা এসেছে। বেড়েছে সব নদীর সমান যত্ন নেয়ার তাগিদ।
কোনো নদী একটি দেশের ভেতরে উৎপত্তি হয়ে সে দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দেশটির সীমানার আওতাভুক্ত অন্য কোনো নদী বা সাগরে মিলিত হলে, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে অবদান রাখলে, নদীটির পানি সুপেয় ও কৃষি উৎপাদনসহ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচলে যদি অবশ্যম্ভাবী হয় সে নদীকে জাতীয় নদী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এসব মানদণ্ড বা নির্ণায়ক সর্বোপরি মৎস্য প্রজননের কথা বিবেচনায় নিলে হালদা নদীর নাম এসে যায়। এটি পৃথিবীর অন্যতম জোয়ার ভাটার নদী এবং দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র মিঠাপানির মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র। হালদা নদীর দৈর্র্ঘ ৮১ কিলোমিটার। আবার বেশি হওয়ার দাবিও করেছেন অনেকে। এটির উৎপত্তিস্থল পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলাধীন পাতাছড়া ইউনিয়নের পাহাড়মালা। সেখান থেকে সৃষ্ট সরু পানিপ্রবাহ বা নহর হালদা ছড়া নামে মানিকছড়ি উপজেলার বেলছড়া ও সালদাছড়া খালে সংযুক্ত হয়ে প্রথমে হালদা খাল অতঃপর ফটিকছড়ির ধুরং খালের সাথে মিলিত রূপই হালদা নদী। চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে চলা হালদা হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলা দু’টিকে ভৌগোলিকভাবে বিভক্ত করেছে। পশ্চিমে হাটহাজারী এবং পূর্ব পাশে রাউজান উপজেলা পেরিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও থানার কালুরঘাট এলাকায় এসে হালদা নদী কর্ণফুলীর সাথে মিশেছে। দেশের মৎস্য খনিখ্যাত হালদার সাথে যুক্ত হয়েছে আরো ১৯টি খাল ও ৩৬টির মতো ছড়া।
বাংলাদেশের হিসাব অনুযায়ী এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যবর্তী সময়ের অমাবস্যা বা পূর্ণিমা তিথিতে বজ্রসহ প্রবল বর্ষণের দিনে বা রাতে পাহাড়ি ঢলের তোড়ে নদীতে সৃষ্ট তীব্র স্রোতে কার্প জাতীয় (রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশ) মাছ ডিম ছাড়ে। ফেনিল ঘোলা পানিসহ ভৌত-রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যগুলোর সমন্বিত ক্রিয়ায় সে সময় হালদা নদীতে মা মাছের ডিম ছাড়তে যে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তা অন্য কোথাও নেই। বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা থেকে সরাসরি কার্প জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। স্থানীয় মৎস্যচাষি বা জেলেদের আহরিত ক্ষুদ্রকায় ডিম থেকে বের হয় পোনা। এর জন্য তিন-চার দিন অপেক্ষায় থাকতে হয়। পরবর্তী সময়ে পোনাগুলো সংরক্ষণ, পর্যবেক্ষণ ও পরিচর্যার মাধ্যমে একটু বড় আকৃতির রূপ ধারণের পর বেচা-বিক্রি শুরু হয়। ডিম থেকে পোনা, পোনা থেকে বড় মাছ পর্যন্ত যে ব্যবসাচক্র, তাতে হালদাপাড়ের দুই হাজার ৫০০ জেলে ছাড়াও অগণিত মাছ ব্যবসায়ী জড়িত। যেখানে টাকার অঙ্কে চার হাজার কোটিরও বেশি টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে। ভৌতিক, জৈবিক ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হালদায় ডিম সংগ্রহের মওসুমে এক উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
বছরের প্রথম থেকেই ডিম সংগ্রহকারীরা প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। সে সময় চলতে থাকে অংশীদার খোঁজা, ডিঙ্গা বা নৌকা মেরামত, কুয়া খনন ও পুকুর তৈরির কাজ। নিজস্ব পদ্ধতিতে পোনা উৎপাদনকারীদের এই কর্মযজ্ঞ চলতে থাকে ৯-১০ মাস পর্যন্ত। স্থানীয়দের অনেকে যুগ যুগ ধরে বংশানুক্রমিকভাবে এ ঐতিহ্যকে লালন করে চলেছে। হালদা নদী শুধু প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র নয় বরং এটি প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পাশাপাশি জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীরও অভয়ারণ্য। ১৯১২ সালে ওহঃবৎহধঃরড়হধষ টহরড়হ ভড়ৎ ঈড়হংবৎাধঃরড়হ ড়ভ ঘধঃঁৎব কর্তৃক তালিকাভুক্ত অতি বিপন্ন জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী এধহমবং জরাবৎ উড়ষঢ়যরহ বা শুশুকের আদর্শ আবাসস্থল হালদা নদী। সুপেয় পানির উৎস হালদা নদী পানিসম্পদ হিসেবেও বিবেচিত। বন্দর নগরী চট্টগ্রামের ৭০ লাখ মানুষের জন্যে সুপেয় পানির চাহিদা পূরণ করে আসছে প্রতিনিয়ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ)-এর মানদণ্ডে হালদার পানিতে হেভি মেটালের পরিমাণ কম হওয়ায় নদীটির গুরুত্ব অপরিসীম। হালদা আমাদের জাতীয় সম্পদ। মিঠা পানির মৎস্য উৎপাদনে হালদার পোনার জুড়ি নেই এমন। আর্থিক, প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আধার হালদার গুরুত্বের কথা বিবেচনায় নিয়ে সাড়ে চার বছর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া জাতীয় নদী হিসেবে হালদার নাম প্রস্তাব করেছিলেন।
স্নিগদ্ধশীতল মোহনীয় হালদা আজ বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত। বিপন্ন হয়ে পড়েছে মিঠা পানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রটি। দখল আর দূষণে হালদা নদী বিপর্যস্ত। ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলনের কারণে নদীর পরিবেশ সাঙ্ঘাতিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছিল। সম্প্রতি ডলফিন মৃত্যুর ঘটনাও ওই ড্রেজারের আঘাতে ঘটেছে বলে অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। হালদা পাড়ের অসচেতন কিছু নাগরিকের বর্জ্য ফেলার কারণে যেমন পানি দূষিত হচ্ছে, তেমনি হালদাসংশ্লিষ্ট এলাকার কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্যওে নদীটির প্রাণ যায় যায় অবস্থা। প্রজনন মওসুমের আগে লঞ্চ, স্টিমার বা ইঞ্জিনচালিত বোট নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও শিল্প বর্জ্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। যার ফলে বর্তমানে হালদার পানিতে অক্সিজেনের চেয়ে কার্বনডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বহুলাংশে বেড়ে গেছে। হালদা নদীতে প্রতি লিটার পানির দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ৫ মিলিগ্রাম। কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্ববদ্যালয়ের হালদা গবেষণা পরীক্ষাগার ও পরিবেশ অধিদফতরের যৌথ দল নদীটির দশ পয়েন্টে পানির নমুনা পরীক্ষা করে দেখেন পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজনের মাত্রা নেমে গেছে ২ মিলিগ্রামের নিচে। এর কারণে প্রতিদিন শত সহস্র মাছ মারা গেছে। জোয়ার-ভাটার নদী বলে হালদার ফটিকছড়ি অংশ দূষিত হলে তা পুরো নদীকেই দূষিত করে তোলে। উপরন্তু হাটহাজারী, রাউজান উপজেলাসহ মহানগরীর অক্সিজেন এলাকার বেশকিছু কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য অবিরাম হালদায় এসে পড়ছে সংযুক্ত শাখা খালের মাধ্যমে।
জুনের ১১ তারিখ থেকে শুরু হওয়া প্রবল বর্ষণের কারণে সৃষ্ট বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের স্রোতে সেখানে যত দূষিত পানি ও ময়লা আবর্জনা ছিল সবগুলো এসে পড়েছে হালদা নদীতে। হাটহাজারীর শিকারপুর, মাদার্শা ইউনিয়নের আটটি ও রাউজান উপজেলার কয়েকটি খালসহ চট্টগ্রাম নগরের বামনশাহী খাল দূষণের শিকার। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা খন্দকিয়া ও বামনশাহী খালের। খালগুলোর পানির রঙ কুচকুচে কালো হয়ে গেছে। এসব পানির ডিও নেমে গেছে এক দশমিক শূন্যতে। অনন্যা আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার সময় সিডিএ বামনশাহী খালে বাঁধ নির্মাণ করে। বাঁধের কারণে পানি নিষ্কাশন বন্ধ হওয়ার ফলে শহরের বিশাল শিল্প ও আবাসিক বর্জ্য বিকল্প পথে হালদায় গিয়ে পড়ছে। এর মধ্যে বামনশাহীর বাকি অংশ, কৃষ্ণখালী, কুয়াইশ ও খন্দকিয়া খাল অন্যতম। উল্লিখিত অবস্থাকে হালদা নদী রক্ষা কমিটি ‘স্মরণকালের ভয়াবহ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত পদক্ষেপের মাধ্যমে হালদার দূষণ নিয়ন্ত্রণ না করলে বাংলাদেশ মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা