২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পুতিনের বিশ্বকাপ কূটনীতি

বিশ্বকাপ ফুটবলের উদ্বোধন করেছেন ভ্লাদিমির পুতিন - ছবি : সংগ্রহ

ক্রমেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাশিয়ার বিচ্ছিন্নতা যখন বাড়ছিল, তখনই বিশ্বকাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দেখালেন ব্যাপক কূটনৈতিক সফলতা। পশ্চিমা নানা অবরোধ আর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সফলভাবে বিশ্বকাপ আয়োজন করে পুতিন তার বিরোধীদের এই বার্তাই দিলেন যে, কোনো কিছুই রাশিয়ার পথ চলা রুখতে পারছে না। খেলার এই মহাযজ্ঞের আড়ালে পুতিন অনেক কূটনৈতিক গেমপ্ল্যান নিয়ে মাঠে নেমেছেন। রাশিয়ার ১১টি স্টেডিয়ামে ৩২টি দেশ যখন শিরোপার লড়াইয়ে ব্যস্ত, ভ্লাদিমির পুতিন তখন সময় পার করেছেন সারা বিশ্বে নিজের ইমেজকে নতুন মাত্রা দিতে। সিরিয়া থেকে উত্তর কোরিয়া, তেল উৎপাদন থেকে পশ্চিমাদের সাথে সম্পর্ক- এমন অনেক ইস্যুতেই পুতিন সুনির্দিষ্ট ছকে অগ্রসর হয়েছেন বিশ্বকাপ উপলক্ষে।

বিশ্বকাপের সফল আয়োজন করে পুতিন নিজের ভূরাজনৈতিক ইমেজ অনেকগুণ বাড়িয়েছেন। সারা বিশ্বের এক ডজনেরও বেশি হাই প্রোফাইল অতিথিকে তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তার দেশে। এই অতিথিদের নিয়ে কখনো নিজে গ্যালারিতে বসে খেলা উপভোগ করেছেন, কখনো বৈঠক করেছেন দ্বিপক্ষীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে। গত সপ্তাহে মস্কোয় যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন পুতিনের প্রশংসা করেন। পুতিনের কাছ থেকে বিশ্বকাপ আয়োজনের কলাকৌশল নিজেদের দেশে নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। ‘এত কিছুর মধ্যেও পুতিন কিভাবে বড় ইভেন্টটির সফল আয়োজন করলেন’ সেটি নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করা গেছে মার্কিন উপদেষ্টার মধ্যে। প্রসঙ্গত, ২০২৬ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের সহ-আয়োজক যুক্তরাষ্ট্র। মেক্সিকো ও কানাডার সাথে মিলে তারা আতিথ্য দেবে ফুটবল খেলুড়ে দেশগুলোকে।

বিশ্বকাপকে ঘিরে ভ্লাদিমির পুতিনের এসব কর্মকাণ্ড শুধু কূটনীতি নয় বরং তার চেয়েও বেশি কিছু। সোচি শীতকালীন অলিম্পিক গেমসের পর থেকে আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও ক্রীড়াঙ্গনে যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন পুতিন, তার থেকে বেরিয়ে আসার দারুণ একটি পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্বকাপ ফুটবল। ২০১৪ সালে রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় কৃষ্ণসাগর উপকূলীয় শহর সোচিতে শীতকালীন অলিম্পিক সমাপনী অনুষ্ঠানের পরপরই রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে। এ ঘটনায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় সমগ্র বিশ্ব। আন্তর্জাতিকভাবে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয় মস্কোর ওপর। এরপর পূর্ব ইউক্রেনে মালয়েশিয়ার যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করা কিংবা সিরিয়া যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে হস্তক্ষেপের মতো বিষয়গুলোয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাশিয়া অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল।


উদ্বোধনী ম্যাচের দিনই ভ্লাদিমির পুতিনের আমন্ত্রণে খেলা দেখতে মস্কোর লুঝনিয়াকি স্টেডিয়ামে উপস্থিত ছিলেন সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। উদ্বোধনী ম্যাচে এবার মুখোমুখি হয়েছিল রাশিয়া ও সৌদি আরব। মাঠে রুশ ফুটবলাররা সৌদিদের প্রতি নির্দয় হলেও (রাশিয়া ৫ : ০ সৌদি আরব) দর্শক সারিতে পুতিন সর্বোচ্চ খাতির করেছেন বিন সালমানকে। টিভি পর্দায় বারবারই দু’জনের হাস্যোজ্জ্বল ও আন্তরিক মুহূর্তগুলো ভেসে উঠেছে। খেলার মাঝবিরতিতে স্টেডিয়ামে এক টেবিলেই নাশতা করেছেন দু’জন। এই সফরকালে পুতিন-সালমান বৈঠকে তেল উৎপাদনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র সৌদি আরব, আবার সৌদির বৈরী প্রতিবেশী ইরানের সাথে দারুণ সম্পর্ক রয়েছে রাশিয়া। তাই স্বাভাবিকভাবেই রিয়াদ-মস্কো সম্পর্ক ততটা আন্তরিক নয়। তবু পুতিনের এই বিশ্বকাপ কৌশল মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের পথ প্রশস্ত করবে বলেই মনে হচ্ছে। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মধ্য এশিয়ার আরো কয়েকটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন। আজারবাইজান, রুয়ান্ডা, বলিভিয়া, পানামা, সেনেগাল, লেবাননের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরা উপস্থিত ছিলেন লুঝনিয়াকি স্টেডিয়ামে।

উদ্বোধনী ম্যাচের পরদিন থেকে ক্রমেই ভারী হয়েছে পুতিনের আমন্ত্রিত অতিথিদের তালিকা। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সফর করেছেন রাশিয়া। জাপানের প্রিন্স তাকামাদো নিজ দেশের খেলা দেখেন সারনস্কের গ্যালারিতে বসে। ১৯১৬ সালের পর এই প্রথম জাপানি রাজপরিবারের কোনো সদস্যের রাশিয়া ভ্রমণ। বিশ্বকাপ উপলক্ষেই ১৯৯৯ সালের পর প্রথম কোনো দক্ষিণ কোরীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে মুন জায়ে ইন রাশিয়া সফর করেছেন। রোস্তভ শহরে তিনি মেক্সিকোর বিরুদ্ধে তার দেশের ম্যাচ দেখেছেন মাঠে উপস্থিত থেকে। বলা বাহুল্য যে, কয়েক যুগ ধরেই পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র দক্ষিণ কোরিয়া। শুধু মিত্রই নয়, সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপরই অনেকাংশে নির্ভরশীল দেশটি। তাই এমন একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের রাশিয়া সফর ও পুতিনের সাথে আন্তরিক বৈঠক অবশ্যই নতুন কিছু। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে পুতিন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টকে জানিয়েছেন, কোরীয় উপদ্বীপের বৈরিতা নিরসনে ভূমিকা রাখতে চায় মস্কো।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন দল রিপাবলিকান পার্টির সিনেটরদের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল আগামী সপ্তাহে রাশিয়া সফরে যাচ্ছে। বিশ্বকাপের মধ্যে এটি আরো একটি উচ্চপর্যায়ের রাষ্ট্রীয় সফর রাশিয়ায়। এখানেই শেষ নয় আগামী ১৫ জুলাই বিশ্বকাপ ফাইনালের দিন শিরোপাজয়ী দলের হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন পুতিন। এই ফাইনাল ম্যাচ নিয়েও অন্যরকম একটি কূটনৈতিক পরিকল্পনা নিয়েছেন তিনি। ফাইনাল খেলা দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে। মাহমুদ আব্বাস পুতিনের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে উপস্থিত থাকার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন ইতোমধ্যে। নেতানিয়াহু উপস্থিত থাকলে সেটি হবে নতুন কিছু। ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হতে পারে কিংবা আব্বাস-নেতানিয়াহু বৈঠকের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। কিংবা সেসব যদি নাও হয়, আব্বাস ও নেতানিয়াহুকে দুই পাশে নিয়ে স্টেডিয়ামের প্রেসিডেন্ট বক্সে বসে খেলা দেখছেন পুতিন- এমন দৃশ্য পুতিনের রাজনৈতিক ইমেজকে কতখানি উজ্জ্বল করবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সবচেয়ে বড় দিক পরিবর্তন হয়েছে রাশিয়ার সাথে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুই ইউরোপীয় মিত্রের সাথে সম্পর্কের তিক্ততা নিরসনে বিশ্বকাপকে উপলক্ষ বানিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ঘোষণা দিয়েছেন, ফ্রান্স সেমিফাইনালে যেতে পারলে তিনি রাশিয়া যাবেন খেলা দেখতে। কোয়ার্টার ফাইনালে উরুগুয়ের মোকাবেলা করবে ফ্রান্স। আর জিতলেই হয়তো ফরাসি প্রেসিডেন্টের পা পড়বে রাশিয়ায়।

আবার ফাইনাল ম্যাচের ঠিক পরদিন হেলসিঙ্কিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে বৈঠক করবেন পুতিন। ট্রাম্পের উপদেষ্টা জন বোল্টন জানিয়েছেন, দুই রাষ্ট্রনেতার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সব বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। এমনকি ক্রিমিয়া দখল নিয়েও, যদিও ভ্লাদিমির পুতিন মনে করেন ক্রিমিয়া ইস্যুটি অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের বৈরিতার অনেক কারণ রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের অভিযোগ। অন্য দিকে, পুতিন অভিযোগ করছেন পশ্চিমা শক্তিগুলো তার দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে। কাজেই সম্পর্ক উন্নয়ন বা বৈরিতার অবসান হোক বা না হোক, রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের এই কর্মসূচিগুলো মস্কোকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে সহায়তা করবে।

রাজনীতির পাশাপাশি ২০১৪ সালের সোচি শীতকালীন অলিম্পিক রাশিয়ার ক্রীড়াঙ্গনের জন্য ছিল এক অভিশাপ। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ওই ইভেন্টে অংশ নেয়া রুশ ক্রীড়াবিদরা শক্তিবর্ধক মাদক নিয়েছিল বলে প্রমাণিত হয়েছে। এই ঘটনার জের ধরে দুই মাস আগে দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত এবারের শীতকালীন অলিম্পিকে রাষ্ট্র হিসেবে নিষিদ্ধ ছিল রাশিয়া। দেশটির কিছু অ্যাথলেট ওই অলিম্পিকে অংশ নিলেও তারা রুশ জাতির প্রতিনিধিত্ব করতে পারেনি, অংশ নিয়েছে অলিম্পিকের পতাকা নিয়ে।

এবারের বিশ্বকাপ তাই রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনের সেই অন্ধকার অধ্যায় থেকেও বের করে এনেছে। রাশিয়াজুড়ে এখন উৎসবের আমেজ। প্রধান প্রধান নগরীগুলো এখন ফুটবলময়। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন এই পরিস্থিতিকে শুধুই পুতিনের বিজয় বলে আখ্যায়িত করেছে। সংবাদমাধ্যমটি বলছে, কূটনীতির এই এ খেলায় প্রকৃতপক্ষে পুতিনই জয়ী।

বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে সারা বিশ্বে ২৫ লাখ টিকিট বিক্রি করা হয়েছে। এই লোকগুলো রাশিয়ায় এসেছে ফুটবল উপভোগ করতে। সারা বিশ্বের শতাধিক দেশের নাগরিকদের সম্মিলন ঘটছে মস্কো, কাজান, রোস্তভ অন ডন, সেন্ট পিটার্সবাগসহ রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে। নতুন মাত্রা পেয়েছে রাশিয়ার পর্যটন শিল্প। তাহলে কি রাশিয়া আর বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র থাকছে না? এ ছাড়া রাশিয়ার ফুটবল দলও বিশ্বকাপে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক ভালো করছে। তাই একসাথে অনেক প্রাপ্তি যে যোগ হয়েছে রাশিয়ার ভাণ্ডারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বিশ্বকাপের আগেই রুশ প্রেসিডেন্টের দফতর ক্রেমলিন ঘোষণা করেছিল, এবারের বিশ্বকাপ শুধু মাঠেই নয়, মাঠের বাইরেও রুশ কূটনীতির অন্যতম উপলক্ষ হবে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছিলেন, বিভিন্ন ম্যচের সময় অনেক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান উপস্থিত থাকবেন। শুধু ক্রীড়া উৎসবই হবে না, সর্বোচ্চপর্যায়ের অতিথিদের পদচারণায় মুখর হবে রাশিয়া। বাস্তবে হয়েছেও তাই। ভ্লাদিমির পুতিন তার ভূরাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের দারুণ এক উপলক্ষ বানিয়েছেন বিশ্বকাপকে। খেলার উৎসবে মেতে থাকা বিশ্বের সাধারণ দর্শক কিংবা রাজনীতিক সবাইকেই কাছে টানতে পেরেছেন সুনিপুণ দক্ষতায়।


আরো সংবাদ



premium cement