২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মেধাবী ও দক্ষ প্রশাসন সময়ের দাবি

মেধাবী ও দক্ষ প্রশাসন সময়ের দাবি - ছবি : সংগ্রহ

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আর সরকারের মেরুদণ্ড হলো প্রশাসন। একটি মেধাবী, দক্ষ ও গতিশীল প্রশাসনের ওপর সরকারের সফলতা বহুলাংশে নির্ভরশীল। এ কারণে সব দেশেই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে অত্যন্ত মেধাবীদের নিয়োগ দিয়ে সুপ্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা হয়। পাকিস্তান আমলে সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস (সিএসএস) নামে উন্মুুক্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন সার্ভিসে মেধাবী প্রার্থীদের নিয়োগ দেয়া হতো। সবচেয়ে বেশি মেধাবীরা সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে যোগ দিতেন, যা ছিল পদোন্নতি, বেতন-ভাতা প্রভৃতি দিক দিয়ে অন্য সব চাকরির চেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। আর এসব কারণে এটি অন্যান্য সার্ভিস থেকে বেশি মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত এবং নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা রাখত। এটি ছিল গ্রেড-১-এর প্রথম সার্ভিস এবং পাকিস্তান ফরেন সার্ভিস ছিল ওই গ্রেডের দ্বিতীয় সার্ভিস। আর পাকিস্তান পুলিশ সার্ভিস ছিল দ্বিতীয় গ্রেডভুক্ত একমাত্র সার্ভিস এবং অন্যান্য কেন্দ্রীয় সুপিরিয়র সার্ভিস ছিল তৃতীয় গ্রেডভুক্ত।

মেধা, দক্ষতা, প্রজ্ঞা ও উৎকৃষ্ট প্রশিক্ষণ পুরো প্রশাসন ব্যবস্থাকে বিশেষ করে সিভিল সার্ভিসকে আলাদা আভিজাত্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করত। আমলাতন্ত্রের নিরপেক্ষতা, উন্নত নৈতিকতা ও মূল্যবোধ এবং আইনের শাসনের প্রতি আনুগত্য ছিল ক্যাডার কর্মকর্তাদের আচরণের নিয়ামক। মেধা, যোগ্যতা ও প্রশিক্ষণের ফলে তাদের মধ্যে সঞ্চারিত মূল্যবোধের নির্যাস ছিল সততা, নিরপেক্ষতা, বিশ্বস্ততা, দক্ষতা ও কর্তব্যনিষ্ঠা। তাদের কর্মকাণ্ডে এসব গুণ ও বৈশিষ্ট্য প্রতিভাত হতো বিধায় তারা বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত হতেন। মান্যতা ও সম্ভ্রম ছিল তাদের কাজের প্রেরণাসঞ্চারী। উদ্দীপনা বিস্তারি উদ্ভাবন এবং সৃজনশীলতা ছিল তাদের জীবনকৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ কারণে রাজনৈতিক পর্যায়ের ব্যর্থতা ও ভুলভ্রান্তি সত্ত্বে¡ও প্রশাসন সুষ্ঠুভাবে চালানো সম্ভব হতো।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, স্বাধীন বাংলাদেশে এ অবস্থা টিকিয়ে রাখা হয়নি। সরকারপরম্পরায় তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করতে ব্যর্থ হওয়ায় উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সুবিন্যস্ত প্রশাসনিক কাঠামোর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায়নি। দলীয়করণ ও দুর্নীতির কারণে প্রশাসন অদক্ষ ও অযোগ্য হয়ে পড়েছে। সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর একই অবস্থা। মেধা ও দক্ষতার ঘাটতির কারণে সমস্যার স্বরূপ বিশ্লেষণ কিংবা অনুধাবনে অক্ষমতাহেতু সিদ্ধান্তহীনতায় সামগ্রিকভাবে প্রশাসনে স্থবিরতা বিরাজ করছে। প্রশাসনে অদক্ষতা ও অক্ষমতা নেমে আসায় জনগণ কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছে না।

কিন্তু বাংলাদেশে প্রশাসন আকর্ষণীয় করার লক্ষ্যে এ যাবত কোনো বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে। যদিও মাঝে মধ্যে অপূর্ণাঙ্গ ও বিচ্ছিন্ন কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আর এ কারণে সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা (সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) এ ক্যাডারে যোগ দিতে উৎসাহিত হচ্ছে না। অতীতে সব সরকারই প্রশাসন তথা প্রশাসন ক্যাডারকে টেনেহিঁচড়ে কত নিচে নামানো যায়, সে চেষ্টাই করেছে। ফলে একটা স্বাধীন দেশে যে মানের প্রশাসন থাকা আবশ্যক, বাংলাদেশে সেই মানের প্রশাসন গড়ে ওঠেনি। এর মূলে রয়েছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা ও সদিচ্ছার অভাব। দুর্বল প্রশাসন দিয়ে তাদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা সহজ।
দূষিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে প্রশাসনে নিরাপত্তাবোধের অভাব দেখা দেয়ায় চাকরি নিরাপদ করতে অনেকে পেশাদারিত্ব বিসর্জন দিয়ে সুবিধাবাদ ও চাটুকারিতার আশ্রয় নিচ্ছেন। চাকরিতে যোগ্যতা ও দক্ষতা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। প্রশাসনে এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে, যা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে শ্লথ গতিসহ প্রশাসনের দৈনন্দিন কাজকর্মে ও জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রতিফলিত হচ্ছে। আন্তঃবিভাগ কাজকর্মের সুষ্ঠু সমম্বয়ের ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হচ্ছে এর প্রভাব। এ অবস্থা একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জন্য আদৌ সুসংবাদ নয়। প্রশাসনকে দক্ষ ও গতিশীল করা সময়ের দাবি। প্রশাসন দক্ষ ও গতিশীল হলে এবং প্রশাসন ক্যাডারে প্রণোদনা সৃষ্টির মাধ্যমে সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করা গেলে কাজের মান ও গতি বাড়বে। এর ফলে দেশ ও জনগণ উপকৃত হবে। সুতরাং কালবিলম্ব না করে সত্বর বিদ্যমান অবস্থার প্রতিকার আবশ্যক।

এ লক্ষ্যে নিম্নে  কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করছি :
পাবলিক সার্ভিস কমিশনে (পিএসসি) দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ না দিয়ে অত্যন্ত মেধাবী ও সুনামের অধিকারী অফিসারদের চেয়ারম্যান ও মেম্বার হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে এবং মৌখিক পরীক্ষায় বিষয়-বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের দলনিরপেক্ষ স্বনামধন্য অধ্যাপকদের আমন্ত্রণ জানাতে হবে। এ ব্যবস্থা বিভিন্ন ক্যাডারে মেধাবীদের নির্বাচনে মান নির্ধারণের ত্রুটি নিবারণে সহায়ক হবে।

বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যম ও সিলেবাস পূর্বতন সিএসএস পরীক্ষার আদলে হওয়া আবশ্যক। উল্লেখ্য, বিসিএস পরীক্ষার মান এখন অত্যন্ত নি¤œ, যে কারণে প্রতিবারই বিপুলসংখ্যক প্রার্থী পরীক্ষা দেয়া সহজ মনে করে। পরীক্ষার মান বাড়িয়ে এই প্রবণতা রোধ করা যায়।
বিসিএসে কোনো কোটা থাকবে না। শতভাগ নিয়োগ হবে মেধার ভিত্তিতে। নন-ক্যাডার সার্ভিসে এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর পদে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য ০-৫ শতাংশ করে কোটা রাখা যায়।
সাবেক সিএসপির মতো প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের উচ্চতর প্রারম্ভিক বেতন নির্ধারণ করতে হবে। পাকিস্তান আমলে সিএসপি অফিসারদের প্রারম্ভিক বেতন ছিল ৫০০ টাকা এবং অন্যান্য কেন্দ্রীয় ক্যাডারের প্রারম্ভিক বেতন ছিল ৪৫০ টাকা। প্রশাসন ক্যাডারকে গ্রেড-১-এর প্রথম সার্ভিস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে এ ব্যবস্থা করা যায়। উল্লেখ্য, উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি মেধাবীদের বাংলাদেশ প্রশাসন সার্ভিসের জন্য নির্বাচিত করা হলে অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের আপত্তি থাকার কিংবা ঈর্ষাবোধ করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। তাদের পরবর্তী প্রজন্মের মেধাবীরা এই ব্যবস্থার সুফল লাভ করতে পারবে। দেশ ও জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়ার মানসিকতা সবার কাছে প্রত্যাশিত।

চার বছরের মধ্যে সিনিয়র স্কেল, আট বছরের মধ্যে উপসচিব, ১৫ বছরের মধ্যে যুগ্মসচিব, ১৮ বছরের মধ্যে অতিরিক্ত সচিব এবং ২২ বছরের মধ্যে সচিব পদে পদোন্নতি নিশ্চিত করতে হবে। পদোন্নতি হবে জ্যেষ্ঠতা বিবেচনা ও মেধার ভিত্তিতে; অন্য কোনো বিবেচনায় নয়।
এক ব্যাচে অধিক সংখ্যক কর্মকর্তা না দিয়ে স্পল্প সংখ্যক কর্মকর্তাকে নিয়োগের বিধান করতে হবে, যাতে উল্লিখিত সময়সীমার মধ্যে যোগ্য ব্যক্তিদের পদোন্নতি সম্ভব হয়। এতে ক্যাডারে কর্মকর্তাদের সংখ্যা কম হলেও গুণগতমান সম্পন্ন কর্মকর্তা পাওয়া যাবে বলে কাজের মান ও পরিমাণ বাড়বে বৈ কমবে না।
লাহোর সিভিল সার্ভিস অ্যাকাডেমির প্রশিক্ষণের আদলে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের মেয়াদ ও মডিউল বিন্যাস করতে হবে, যাতে তারা দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার ও দ্রুততার সাথে পালন করতে পারেন। বিদেশেও অধিক হারে উচ্চশিক্ষা (এমএস/পিএইচডি)/প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য সরকার প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ প্রকল্প/কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে। পররাষ্ট্র, পুলিশ, অডিট, অ্যাকাউন্টস, ট্যাক্সেশন ও কাস্টমসসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্যাডারের প্রশিক্ষণও পাকিস্তান আমলের মতো হওয়া উচিত। স্বল্প মেয়াদে প্রশিক্ষণে চৌকস ও দক্ষ অফিসার তৈরি হয় না।

উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে উপজেলা পরিষদের সাংগঠনিক কাঠামোর বাইরে নিয়ে আসতে হবে এবং তার জন্য স্বতন্ত্র সাংগঠনিক কাঠামো ও অফিস ভবনের ব্যবস্থা করে তাকে স্বতন্ত্র মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে হবে। তার কাজের পরিধি পুননির্ধারণ করতে হবে। তার কাজের পরিধি হবে জেলা প্রশাসনের কাজের অনুরূপ।
ভূমি অফিসের দুর্নীতির সংক্রমণ থেকে নবীন অফিসারদের দূরে রাখতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে নিয়োগের বিধান বাতিল করে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাংগঠনিক কাঠামোতে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসম্পন্ন সহকারী কমিশনারের একটি পদ অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। উল্লেখ্য, সহকারী কমিশনার (ভূমি) একজন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট হওয়া সত্ত্বেও জনমনে তার ইমেজ কিন্তু সেরকম নয়।
প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে মর্যাদার সাথে টিকে থাকতে, স্বল্পতম সময়ে বাংলাদেশকে একটি উচ্চ মধ্যম আয়ের ও আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার প্রত্যয়ে প্রশাসনকে দক্ষ ও গতিশীল করার লক্ষ্যে, প্রশাসন ক্যাডারে মেধাবী শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে সরকার সৎ সাহস নিয়ে প্রস্তাবগুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে বলে আশা করছি।হ
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার


আরো সংবাদ



premium cement