১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ সৌভাগ্যের না দুর্ভাগ্যের?

মানুষই পরিবেশ নষ্ট করার জন্য প্রধানত দায়ী - ছবি : সংগ্রহ

যেসব জিনিস বা বস্তুর ওপর আমাদের বেঁচে থাকা নির্ভর করে যেমন নিঃশ্বাসের জন্য অক্সিজেন বা দূষণমুক্ত বাতাস, দৈহিক বিকাশ বা শক্তির জন্য খাদ্য ও পানীয় সংগ্রহের উৎস, গাছপালা, পশুপাখি ইত্যাদি হচ্ছে পরিবেশ। এক কথায় পরিবেশ ছাড়া মানুষের জীবন-জীবিকা কল্পনা করা যায় না। কিন্তু বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন মানুষই পরিবেশ নষ্ট করার জন্য প্রধানত দায়ী। পরিবেশের ভারসাম্য যখন হারিয়ে যায় তখন বায়ুদূষণ, খরা, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, এসিড বৃষ্টিসহ বহুমুখী সমস্যার সৃষ্টি হয়, যা আমাদের জন্য খুবই বিপজ্জনক। প্রাকৃতিক পরিবেশ অবশ্যই মানুষের সৃষ্টি নয়, কিন্তু তা রক্ষা করার ক্ষেত্রে মানুষের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবী ও এর প্রাকৃতিক উপাদান যেমন ভূমি, পানি, উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের অপরিসীম সৌন্দর্য রক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্কতা ও কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এসব উপাদান বিনষ্ট বা বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এর ফলে সমগ্র পরিবেশ দূষণের কবলে পড়তে বাধ্য। পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রে বাতাস, পানি এবং মাটি দূষণ ছাড়াও আলো, দৃষ্টি, তাপ ও শব্দসহ সাত ধরনের দূষণকে চিহ্নিত করা যায়।

আলোক দূষণ এমন একটি দূষণ যার ফলে গ্রহ, নক্ষত্র, চাঁদ ও ছায়াপথ দৃশ্যমান হতে দেয় না। আমাদের অনুচিত ও অতিরিক্ত আলোকসজ্জার কারণে রাতের আকাশ উজ্জ্বল হয়ে উঠে বলে এমনটি হয়। সড়কবাতিতে ঢাকনা দেয়া হয় যাতে আলো নিচের দিকের সড়ক আলোকিত করে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় বাতির আলো বিকিরণ ছড়াচ্ছে। অনেক বাড়ির চতুর্দিকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাতি জ্বালানোর কারণে আলোক দূষণের সাথে সাথে অনেক বেশি শক্তিরও অপচয় হচ্ছে। বিকিরণের ফলে বাড়তি আলো মানব দেহে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।

আকাশচুম্বী অট্টালিকা এবং বিলবোর্ড বা শীর্ষ নেতৃত্ব্রে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য টাঙ্গানো ব্যানার দিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য ঢেকে ফেলার ফলে দৃষ্টি দূষণের সৃষ্টি হয়। সবুজ বৃক্ষরাজি, সাগর, ভূমি ও পর্বতমালার অপরূপ দৃশ্য আড়াল হয় এমনি কিছু যেমন পরিত্যক্ত বাড়ি, পুরনো লোহার স্তূপ, নষ্ট জিনিসপত্র ও আবর্জনা দৃষ্টি দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দুর্গন্ধযুক্ত ময়লার স্তূপ খুবই বিরক্তিকর এমনকি মানুষেরর মনকেও বিষণœ করে তোলে।
শব্দ দূষণ একটি আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক বন্ধনও বিনষ্ট করে দিচ্ছে। অতিরিক্ত ও উচ্চমাত্রার শব্দের কারণে এ দূষণের সৃষ্টি। এটি শুধু মানুষ নয়, পশুপাখির জন্যও ক্ষতিকর। উড়োজাহাজ, হেলিকপ্টার, মোটরগাড়ি, নির্মাণকাজ, স্থাপনা ভাঙা, গান-বাজনা, খেলাধুলা ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে অতিরিক্ত মাইক ব্যবহার শব্দ দূষণের জন্য দায়ী। এটি মানসিক চাপের স্তরকে বিশৃঙ্খল করে তোলার পাশাপাশি স্মায়ুচাপকে অতিমাত্রার উচ্চতায় নিয়ে যায়। মানুষের শ্রবণশক্তি লোপ পাওয়ার অন্যতম কারণও শব্দদূষণ। যার ভয়াবহ ক্ষতির শিকার অনাগত শিশুরা।

তিন বছরের কম বয়সী শিশুর কাছাকাছি দূরত্বে ১০০ ডেসিবল মাত্রার শব্দ হলে তার শ্রবণ ক্ষমতা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞজনের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, একজন সুস্থ মানুষকে ৬০ ডিবি মাত্রার শব্দ সাময়িক বধির করে দিতে পারে। শব্দের মাত্রা ৪৫ ডিবি হলে মানুষের ঘুমের ব্যাঘাত হয়। শয়নকক্ষে শব্দের মাত্রা হতে হবে ২৫ ডিবি। অফিস, হাসপাতাল, শ্রেণিকক্ষ ও গ্রন্থাগারে শব্দের মাত্রা ২০-৪০ ডিবি হওয়া বাঞ্ছনীয়। অথচ আমরা দেখছি, এসব স্থানে শব্দের মাত্রা ৮৫-১০০ ডেসিবল। শব্দ দূষণ আইন ও বিধিমালা Environmental Conservation Act 1995; Environmental Conservation Rules 1997; এবং Nose pollution regulation and control Rules 2006 থাকলেও শব্দদূষণের মাত্রা রোধে কোনো সংস্থার কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়নি। শব্দদূষণের মাত্রা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরকার উৎসব পালন করলেও সত্যিকার অর্থে গ্রাহকেরা চাহিদানুযায়ী বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। এর ফলে আবাসিক-অনাবাসিক যেমন শপিং মল, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, ক্লিনিক, হাসপাতাল সর্বত্র জেনারেটর ব্যবহারের কারণে শব্দদূষণের সৃষ্টি হয়। যানবাহনের হর্ন, উচ্চস্বরে মাইক, লাউড স্পিকার বা এমলিফায়ারে অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার জনজীবনে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। যেকোনো ধরনের উৎসব সামাজিক রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে পূর্বানুমতি সাপেক্ষে পাঁচ ঘণ্টার জন্য শব্দযন্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন থাকলেও তা কেউ মানছে না। শব্দের মাত্রা ক্ষতিকর পর্যায়ে রেখে বেলা-অবেলা, সকাল সন্ধ্যা, দিন-রাত বিরামহীন মাইক বা লাউড স্পিকারের যন্ত্রণা বেড়েই চলেছে। অথচ শব্দ দূষণ আইন বা নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী রাত ১০ টার পর শব্দদূষণ হয় এমন কোনো কিছু ব্যবহার নিষিদ্ধ। এখানে প্রশাসনিক শৈথিল্য (Slackness) বহুলাংশে দায়ী বলে মত দিচ্ছেন বিশিষ্টজনেরা। বর্তমানে যেকোনো অন্যায় বা বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে মানুষ ভয় পায়। তার কারণ হিসেবে এ বছর জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহে ওয়ারীতে খুন হওয়ার ঘটনাটি উল্লেখ করার মতো। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে উচ্চস্বরে গান বাজানোর প্রতিবাদ করতে গিয়ে ওই অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা খুন হন।

বাতাস বা বায়ুদূষণ: এটি বায়ুর সংক্রমণ যা ধুলাবালু ক্ষতিকর বাষ্প, কার্বন, সালফার ও নাইট্রোজেন থেকে নির্গত ধোঁয়া, জলন্ত জীবশ্ম হিসেবে কয়লা, তেলের ধোঁয়া বা বাষ্প, ক্ষতিকর গন্ধযুক্ত বস্তু যেমন রং ও নমনীয় বস্তু এবং উপচে পড়া বিকিরণ অথবা পারমাণবিক দুর্ঘটনা থেকে সৃষ্টি হয়। তবে এর জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী হচ্ছে ইটভাটা। বায়ুদূষণের কারণে হাঁপানি, খোসপাঁচড়া এবং শ্বাস-প্রশ্বাস সম্বন্ধীয় রোগের জন্ম দেয়। আরো একটি কঠিন প্রভাব হচ্ছেÑ ফুসফুসে ক্যান্সার। বিজ্ঞান সাময়িকী ‘ল্যানসেট’র প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৭ সালে বিশ্বে এক কোটিরও বেশি মানুষ এ ধরনের দূষণের কারণে মারা গেছে। দূষণে মৃতের সংখ্যা ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। বায়ু দূষণের ফলে প্রতি বছর ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। যা জিডিপির এক শতাংশের সমান। যুক্তরাষ্ট্রের Environmental Protection Agency বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের মধ্যে দ্বিতীয় বায়ুদূষণের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম লিপিবদ্ধ করেছে। প্রথম দেশ নেপাল। ২৩ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। আরো একটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছেÑ ২০০৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ১২ বছরে বাংলাদেশ বায়ুদূষণ রোধে কোনো সফলতা দেখাতে পারেনি। তাই ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১২৫ নম্বর থেকে ৫৪ ধাপ নিচে নেমে বর্তমানে ১৭৯ নম্বরে অবস্থান করছে।

উন্নত বিশ্বের কার্বন নিঃসরণ আর মানুষ দ্বারা সংঘটিত ক্রিয়া কলাপের ফলে পরিবেশের তাপমাত্রা অধিক হারে বেড়ে যাওয়াটাই তাপমাত্রা দূষণ। কার্বন গ্যাস নিঃসরণের ফলে বায়ুমণ্ডলীর ওজন স্তর যা সূর্যের ক্ষতিকর অতি বেগুনি রশ্মিকে পৃথিবীতে সরাসরি আসতে বাধা দিত তা মারাত্মকভাবে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, অতিরিক্ত বরফ গলে সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার ফলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ক্ষতির সাথে আমাদের দেশেরও অকল্পনীয় ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। উপরন্তু সমুদ্রে অনেকাংশ ভূমি চলে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ু উষ্ণতা সমুদ্র জলের উচ্চতাকে যুগ প্রতি এক ফুটের অধিক বাড়ানোর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের অন্যতম হবে বাংলাদেশ। দেশের কোস্টাল এরিয়াতে বসবাসরত মানুষ ঝুঁকিতে রয়েছে।

পানির উৎস বা উৎসের স্থান দূষিত হয় বিভিন্ন কারণে। কাঁচা ময়লা-আবর্জনা, বেআইনি কোনো বস্তু বা উপাদান, শিল্পকারখানার বর্জ্য নদ-নদী, খাল, হ্রদ ও ঝরনা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পানি দূষিত করে। এ ছাড়া পানিতে জীবণু বেড়ে যাওয়া, উপচে পড়া বিকিরণ বা পারমাণবিক দুর্ঘটনাও দূষণের কারণ হয়। মানুষ, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ এবং উদ্ভিদকুলের স্বাস্থ্য নির্ভর করে দূষণমুক্ত পানির ওপর। পানি দূষণ মানুষ, পশুপাখি ও গাছপালার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। দূষণের ফলে পান করার পানিতে বিষাক্ত টক্সিক মিশ্রিত হয়। এ ক্ষেত্রে মানুষের ঝুঁকিতে পড়ার কারণ নির্ণয়ে দেখা গেছে পানিত তেল ছড়ানো, কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য এবং ড্রেনের ময়লা অন্যতম দায়ী। দেশের অনেক শিল্পকারখানা বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা বা ইটিপি ছাড়াই তাদের বর্জ্য নিয়মিত হারে নদীতে ফেলে পানি দূষণ করছে। অন্য দিকে, শহরের যেসব আবর্জনা বাড়ির আঙিনা, নালা-নর্দমা, খাল ও উন্মুক্ত জায়গায় ফেলা হয় অনেক দিন জমে থাকার ফলে পচা দুর্গন্ধময় হয়ে ওঠে। বর্ষা মওসুমে ওই আবর্জনাই নদীতে গিয়ে মিশে। এভাবে অব্যাহত বর্জ-আবর্জনা জমা হওয়ার কারণে নদীগুলো নাব্যতা হারিয়েছে। ফলে দেখা যাচ্ছে- বাংলাদেশে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস বহুলাংশে বেড়েছে। বন্যাকবলিত মানুষ তাদের জমির ফসল, গবাদি পশু এমনকি ঘর-বাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে চলেছে। এমনি অবস্থায় সরকার মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষায় দূষণমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারলে সৌভাগ্যের ‘চ্যাম্পিয়ন অফ দ্য আর্থ’ এ দেশের জনগণের কাছে দুর্ভাগ্যের বিষয় হিসেবেই বিবেচিত হবে।
লেখক: রাজনীতিক ও প্রাবন্ধিক


আরো সংবাদ



premium cement