২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সর্বাত্মক অর্থনৈতিক যুদ্ধ ও ইরানের প্রস্তুতি

ইরানের একটি গ্যাসক্ষেত্র - ছবি : সংগ্রহ

মাশহাদ শহরের রাস্তায় পা রাখলেই বাতাসে জাফরানের সুবাস, পর্বতমালা থেকে আসছে মৃদুমন্দ হাওয়া; এটা আপনাকে দোলা দেবে। আপনি এখন প্রাচীন সিল্করোড বা রেশমপথের কেন্দ্রস্থলে। এটা নতুন ‘বেষ্টনী ও সড়ক উদ্যোগ’ (বিআরআই)-এরও হৃৎপিণ্ড। মাশহাদ থেকে পূর্ব দিকে আফগান সীমান্ত মাত্র ঘণ্টা তিনেকের পথ, যেখানে যাওয়া যায় চমৎকার একটি মহাসড়ক ধরে। উত্তরে তুর্কমেনিস্তানের সীমানায় পৌঁছতে লাগে ৪ ঘণ্টার কম। উত্তর-পশ্চিম দিকে কাস্পিয়ান সাগর। ভারত মহাসাগর আর চাবাহার বন্দর এখান থেকে দক্ষিণ দিকে। এই বন্দর হলো রেশমপথের ভারতীয় সংস্করণের প্রবেশবিন্দু। এ দিকে, চীন বানিয়ে দিচ্ছে তেহরান-মাশহাদ রেললাইন।
আমরা ক’জন মাশহাদে একত্র হয়েছি মুক্তমনা চিন্তাবিদদের ‘নবদিগন্ত সম্মেলন’ উপলক্ষে। আমাদের মধ্যে যারা মার্কিন বন্ধু, তাদের ভিসার অনুমোদন দিয়েছেন ইরান সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। একটা ঝড় হয়ে যাওয়ার পরপরই ভ্যানে চড়ে চললাম ইমাম রেজার আকর্ষণীয় দরগাহে। সাথে আছেন আলেকসান্দর দুগিন। ‘দুষ্ট’ লোকেরা তাকে দুনিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক দার্শনিক কিংবা পুটিনের রাসপুটিন হিসেবে অভিহিত করতে ভালোবাসে।

বিতর্ক ও বিশ্লেষণ
আমরা বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কে ডুবে যাই। নিছক ভূরাজনীতি নয়, ম্যাকিয়াভেলিসহ নানা বিষয়। পারস্যের ঐতিহ্য রয়েছে গুরুতর বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার ক্ষেত্রে। উপরিউক্ত সম্মেলনে মধ্যাহ্নভোজনের বিরতির পর ক’জন মিলে ঠিক করলাম, আমাদের নিজেদের ভূরাজনীতি নিয়ে বিতর্ক শুরু করা হবে। সেখানে থাকবে না কোনো ক্যামেরা কিংবা মাইক্রোফোন। দুগিন বললেন, বহুপাক্ষিকতা আসলে কী; ‘বিশ্বজনীন’ বলে কিছু থাকবে; বিশ্বের বহু মেরুর প্রতিটি হবে সার্বভৌম। আমাদের আলোচনায় উঠে আসে ইউরেশিয়ান পরিচিতির প্রচ্ছন্ন প্রতারণার বিপদ, ইসলামি পরিচিতির প্রসঙ্গ, ভারত, ইউরোপ, আফ্রিকা প্রভৃতি। ইরানের একজন পণ্ডিত ব্যক্তি লিখে থাকেন Blake Archer williams নামে। তিনি ‘শিয়া ইসলামের পবিত্র জনগোষ্ঠী এবং এর বিস্তারিত পরিচয়’ প্রসঙ্গে গভীর আলোচনায় অবতীর্ণ হলেন।

কারাজ হচ্ছে তেহরান থেকে ১ ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত ব্যস্ত নগরী, যেখানে বাস করেন ৩০ লাখ লোক। একদিন প্রত্যুষে সেখানে একটি হাওজা বা ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি রুমে ঢুকে পড়লাম। এর আগে ইরানে এসে কোম নগরীর হাওজা সফর করেছিলাম। তবে শুধু মেয়েদের কোনো স্কুলে যাইনি। এবার যে প্রতিষ্ঠানে গেলাম, সেখানে পড়ে দুই হাজার ২৭৫ জন শিক্ষার্থী। ওরা আল বোর্জ প্রদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছে। এখানে পড়াশোনা করা যায় পিএইচডি পর্যন্ত। পড়ানো হয় দর্শন, মনস্তত্ত্ব, অর্থনীতি ও রাজনীতি। গ্র্যাজুয়েট হয়ে কিছু শিক্ষার্থী মুসলিম কিংবা অমুসলিম অধ্যুষিত দেশে যায় শিক্ষক হিসেবে।

প্রশ্নোত্তর ছিল প্রাণবন্ত ও আনন্দদায়ক। যারা আমার সাথে কথা বলেছেন, তাদের অনেকে ইতোমধ্যে শিক্ষক হয়েছেন। বেশির ভাগই পণ্ডিত বা স্কলার হবেন আগামী দিনে। তাদের প্রশ্ন ছিল তীক্ষè। কয়েকজনের জ্ঞান ছিল বেশ ব্যাপক। পাশ্চাত্যের জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত জানার খুব আগ্রহ দেখা গেল।
পরদিন গেলাম ইসলামি আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ যাবৎ ৪০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী এখানে জ্ঞানার্জন করে বিদায় নিয়েছেন। এখন ছাত্রসংখ্যা ১৪ লাখ; শিক্ষক আছেন ২৯ হাজার। বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাস ও গবেষণাকেন্দ্র ৪৭২টি। এর সাথে সংযুক্ত হাইস্কুল আছে ৬১৭টি। ইরানের ভার্সিটি ক্যাম্পাসগুলোর মাঝে কারাজ ক্যাম্পাস গুরুত্বের দিক দিয়ে দ্বিতীয়। সেখানে অভিজ্ঞতা হলো অসাধারণ। পাহাড়ের পাশে অবস্থিত ক্যাম্পাসটি হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি নয়। তবে ইউরোপের মর্যাদাপূর্ণ অনেক ভার্সিটির চেয়ে অগ্রবর্তী। বার্ষিক ফির পরিমাণও বেশি নয় কারাজে। গড়ে মাত্র এক হাজার ডলার। নিষেধাজ্ঞার কথা তুলবেন? কী হবে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে? ইরানের এ ভার্সিটিতে বেশির ভাগ যন্ত্রপাতি আশির দশক থেকে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে যা যা দরকার, সব কিছুই আছে সেখানে। প্রাণবন্ত ব্যক্তি আলী কাজেমি একজন প্রখ্যাত স্থপতি। গ্র্যাজুয়েশন নিয়ে প্যারিসে কাটিয়েছেন ১৬ বছর। তার কথা হলো, কারাজের একাডেমিক স্ট্যান্ডার্ড খুব উঁচু। সেখানকার আজাদ ভার্সিটির রেক্টর মোহাম্মদ হাসান বোরহানিফার আগে ছিলেন কিরগিজস্তানের রাজধানী বিশকেকের বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি ক্যাম্পাসের সব দ্বার উন্মুক্ত করে দিলেন। ল্যাঙ্গুয়েজ ফ্যাকাল্টির মোহাম্মদ হাশামদার আমাকে সব কিছু ঘুরিয়ে দেখালেন। সব ফ্যাকাল্টির ডিনদের সাথে কথা হলো। প্রশ্নোত্তর অনুষ্ঠান হলো ছাত্রদের নিয়ে, যার বেশির ভাগই ছিল আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়ে। (আমেরিকা কর্তৃক) ‘ইতিহাসের কঠোরতম নিষেধাজ্ঞা’ ঘোষণার আগেই প্রত্যেকে বিস্তারিত জানতে চাইলেন মার্কিন অর্থনৈতিক যুদ্ধের নতুন ধরন সম্পর্কে। এ লড়াই উত্তপ্ত যুদ্ধের চেয়েও বেশি মারাত্মক। দুই মাসের কিছু বেশি সময়ের মধ্যে মার্কিন ডলার, ইস্পাত, কয়লা ও দামি ধাতু কেনা নিষিদ্ধ হয়ে যাবার কথা। ইরান থেকে কোনো কিছু আমদানি করা যাবে না আমেরিকায়। বিমান চলাচল এবং কার নির্মাণ শিল্পেও নিষেধাজ্ঞা আঘাত হানবে। এয়ারবাস কোম্পানিকে হয়তো ইরান থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার মূল্যের অর্ডার বাতিল করতে হবে। আইটির একজন অধ্যাপক আমাকে জানান, এয়ারবাসের বদলে চমৎকার সুখোই যাত্রীবাহী বিমান ইরান কিনতে পারে। (ফরাসি কার ব্র্যান্ড) পুজো থাকবে না? ‘আমরা তাহলে হিউন্দাই কিনব।’

যাদের সাথে কথা হয়েছে, তারা সর্বশেষ তথ্য দিলেন- টোটাল, এয়ারবাস, বিএএসএফ, সিমেন্স এবং এনির শাখা সাইপেম ন্যাশনাল ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানির সাথে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে। এই চুক্তি মোতাবেক তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহ করা হবে। নিশ্চিত হয়ে তারা জানালেন, ‘টোটাল’ যদি দক্ষিণ পার্স গ্যাসফিল্ডের একাদশ পর্যায়ের উন্নয়নের কাজ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়, চীনের ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম কোম্পানি সে কাজ পেয়ে যাবে। ইরানের যত জ্বালানি তেল রফতানি হয়, এর শতকরা ৭০ ভাগই যায় চীনে এবং এশিয়ার আর কয়েকটি দেশে; ২০ শতাংশ যায় ইউরোপে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো ইরান থেকে যত পণ্য আমদানি করে থাকে, এর ৯০ শতাংশই হলো তেল। এই জ্বালানির বেশির ভাগ কিনে স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, গ্রিস, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডস। (আমেরিকার) ডিক চেনি ভালো করেই জানতেনÑ ইরান মানে বিগ প্রাইজ। কারণ, দেশটির কাছে তেল-গ্যাসের বিস্ময়কর ভাণ্ডার রয়েছে; এর মূল্য ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার।

কারাজে কথা হলো জুমার জামাতের ইমামের সাথেও। তিনি সেখানে আয়াতুল্লাহ খামেনির আসল প্রতিনিধি। পুরনো রেশমপথ বৌদ্ধধর্মকে পথ করে দিয়েছিল, যাতে চীনা সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হতে পারে। একইভাবে ইরান, ভারত ও চীন আবার পরস্পরকে সমৃদ্ধ করে তুলতে বাধ্য। কল্পনা করুন, ইউরেশিয়া (ইউরোপ+এশিয়া) জুড়ে ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ ল্যাবরেটরিতে সুশিক্ষিত তরুণেরা সৃজনশীল গবেষণায় লিপ্ত।
তেহরান থেকে কারাজ মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে। অবর্ণনীয় ট্রাফিক জ্যামে যেতে লেগে গেল ৩ ঘণ্টা। এর তুলনায় লস অ্যাঞ্জেলেসের জ্যাম অনেক কম দুঃসহ। একটি ফারসি কথা আমার শব্দভাণ্ডারে শামিল করেছিÑ ‘খারাব বেশে’। এর অর্থ, ‘কোথাও যাচ্ছে না’। তেহরান ভার্সিটির প্রফেসর মারানদির সাথে প্রয়োজনীয় ডিনার মিস করলাম। পরে তার সাথে ভূরাজনীতি নিয়ে আলাপ হলো হোয়াটসঅ্যাপেÑ যেমনটা আলাপ করেন মোহাম্মদ বিন সালমান আর জ্যারেড কুশনার।
১৭ মিলিয়ন মানুষ তেহরানে ঠাসাঠাসি করে আছে। তাদের দৈনন্দিন জীবন মধ্যপর্যায়ের উদীয়মান একটি জাতির প্রতিচ্ছবি। সবার আছে একটি করে প্রাইভেট কার। স্মার্টফোন আর ওয়াইফাই আছে ঘরে ঘরে। সর্বত্র পারস্য সভ্যতার ছোঁয়া ইরানে ইসলামের আগমনের আগে থেকে, অন্তত হাজার বছরের অবিশ্বাস্য ইতিহাসের জন্য সভ্যতাটি গর্ব করে থাকে। সেকুলার হয়ে যাওয়া এলিট বুদ্ধিজীবীদের সাথে আলাপে স্পষ্ট, তারা মনে করেন- ‘আরব’ মানে যন্ত্রণা ছাড়া কিছু নয়। ইরানে যেখানেই যাই, ফিরে যেতে হয় ’৭০-এর দশকে। ইরানের অবকাঠামো কয়েক দশক পুরনো হলেও আজো ব্যবহারযোগ্য। ইরান যেন ‘জাদুবাস্তবতা’র নজির, যেখানে সব আশা ত্যাগ করা হলে অপ্রত্যাশিত কিছু একটা ঘটে যায়।

স্মার্ট তরুণ জেনারেশন
মাশহাদে আমি ছিলাম খোরাসান টিভির রাজনৈতিক আলোচনা অনুষ্ঠানের একজন অতিথি। সেখানে স্টুডিওটি সেই ’৭০-এর দশক থেকে নিখুঁতভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। হ্যাঁ, এই সেই রূপকথার খোরাসানের প্রাণকেন্দ্র। বলা হতো, ‘এখান থেকে সূর্যের আগমন ঘটে।’ আলোকজান্ডার দ্য গ্রেট এটা শুনে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। যা হোক, সেই টিভিতে আধা ঘণ্টা ধরে পরমাণু চুক্তির যৌথ সামগ্রিক কর্মপরিকল্পনা (ঔঈচঙঅ)-এর বিশ্লেষণ করলাম। আমার কথার অনুবাদক ছিলেন একজন আমদানি-রফতানি বিশেষজ্ঞ, যাকে বলা যায় ‘খুব বেশি যোগ্য’। খোরাসান টিভি চ্যানেলের বিস্ফোরকতুল্য প্রোগ্রাম হচ্ছে আমেরিকান স্টাইলের একটি ‘কপ শো’, যা সরাসরি ও বিশেষভাবে সম্প্রচার করে থাকে সড়ক দুর্ঘটনাগুলো। তবে অপরাধের হার নগণ্য। ইরানের প্রকৃত মুদ্রাস্ফীতি এযাবৎ বছরে ১৬ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষেত্রে এটা অনেক বেশি। যুবসমাজের বেকারত্ব একেবারে চরমে, ৩০ শতাংশ। এটা হচ্ছে আট কোটি মানুষের দেশে, যেখানে গড় বয়স ২৯ বছর। ইরানে ৪০ শতাংশ মানুষের বয়স ২৪-এর নিচে। কারাজে আমার দোভাষীদের একজনের নাম আলী (২৪)। সে বেকার, ডিভিডি দেখে ইংরেজি শিখে নিয়েছে। আয় কম বলে নিজের জন্য ঘর ভাড়া নেয়ার সামর্থ্য নেই।

রিয়ালের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে নতুন করে। ফলে আঞ্চলিক পর্যায়ে গড় বেতন এক লাফে মাসে ২৫০ মার্কিন ডলারের সমান হয়েছে। আজাদ ভার্সিটির কাছে ৪০ বর্গমিটারের একটি অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া মাসে ২০০ ডলারের কম নয়। মাশহাদে একবার গভীর রাতে পিজা খেতে দোকানে ঢুকলাম। বিল এসেছিল অস্বাভাবিক রকম চড়াÑ দুই লাখ রিয়াল! আসলে এটা তিন ডলারের সামান্য বেশি। এক ইউরোর দাম কালোবাজারে উঠেছে প্রায় ৮০ হাজার রিয়ালে।

সামাজিক মাধ্যম
টেলিগ্রামে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। তবুও প্রত্যেকে টেলিগ্রাম আর হোয়াটসঅ্যাপ- দুটোই ব্যবহার করে থাকে। ভিপিএন কিছু সচল; কিছু অচল। গত জানুয়ারি মাসে রাস্তায় বিক্ষোভের সময় সরকারবিরোধী গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। এর সূচনা হয়েছিল এই মাশহাদেই। সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবন্ধকতার কারণ এটা নয়। ইরানের সব কিছু নিয়ে পাশ্চাত্যের মিডিয়া যে ‘উদ্ভট’ কভারেজ দিয়ে থাকে, এতে এটা বিনোদন দিচ্ছে ইলাহেহ, বোজান, আয়ুবদেরকে। ইলাহেহ ফ্রান্স ভাষার ওপর মাস্টার্স করেছেন; বোজান সান দিয়েগো রাজ্যে অর্থনীতির বিষয়ে ডক্টরেটধারী। আয়ুব ফারখোন্দেসহ তারা হাবিলিয়ান রিসার্চ ইনস্টিটিউটে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে পড়াশোনা করছেন।

মাশহাদ ও তেহরান- দুই জায়গারই সুশিক্ষিত মহলের অভিমত, সরকারবিরোধী সাম্প্রতিক বিক্ষোভকে অবশ্যই ‘আইএমএফ রায়ট’ বলা যায়। তাদের মতে, যখন ওয়াশিংটন থেকে বিভিন্ন দেশের সরকারকে চাপ দেয়া হলো ভর্তুকি কমাতে, তখন এই বিক্ষোভ ঘটেছে। ইরানের প্রকৃত বিপ্লবে আলেম, মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী ও ‘বাজারি’রা জড়িত থাকেন। এবার জোর দেয়া হয়েছিল তৃণমূলপর্যায়ে অংশগ্রহণের ওপর। তার মানে, ক্ষুদ্র শহরগুলোর মেহনতি মানুষের সম্পৃক্ততা। ইরানে কয়েক মিলিয়ন মানুষ সরকারের দেয়া বেতন ও ভর্তুকির ওপর নির্ভরশীল। এর বিপরীতে প্রেসিডেন্ট রুহানি ও তার সহযোগীরা অবশ্যই নব্য উদারপন্থী। সরকারের সমালোচনা যতটা না উদারপন্থীদের বিরুদ্ধে, এর চেয়ে বেশি আলেমদের ব্যাপারে। ব্যবসায়ীরা আমাকে জানান মন্ত্রীপর্যায়ে দুর্নীতির কথা। তবে এসব কিছুর সত্যতা যাচাই করা কার্যত অসম্ভব। ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীকে বলা হয় ‘পাসদারান।’ তারা অর্থনীতির বড় এক অংশ নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। জনকল্যাণের একটি সিস্টেমও তারা পরিচালনা করায় লাখ লাখ লোক তাদের ‘অনুগ্রহ’ পেয়ে থাকে। পাসদারান সমাজে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে রেখেছে।

ওয়াশিংটনে বসে জানালাবিহীন কোনো ছোট রুম থেকে ইরানকে ‘দেখা’ নয়; সরেজমিন গিয়ে বোঝা যায়Ñ যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের উপদেষ্টা জন বোল্টন ইরানে রঙিন বিপ্লব ঘটাতে ‘মুজাহেদিনে খালক’কে পুনরুজ্জীবিত করার যে পরিকল্পনা এঁটেছেন, তা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হবে। এ সংগঠনটি সমগ্র বিশ্বে ঘৃণিত। ইরানের সমাজ আসন্ন অর্থনৈতিক যুদ্ধের জন্য খামেনি কিংবা রুহানিকে দায়ী করবে না।

মাঠে এখন ইউরোপ
পারস্যের বিনম্রতা, আতিথেয়তা ও মহত্ত্ব সব সময়ই একজন বিদেশীকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। এর সাথে যোগ হয়েছে ইরান সম্পর্কে পাশ্চাত্যের বদ্ধমূল ধারণা। ইরান ‘বিচ্ছিন্ন’ হয়ে থাকতে চায় না। ওয়াশিংটনের রাজনীতি চায়, ইরান বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকুক। অতএব, অবাক হওয়ার কিছু নেই ইউরোপকে মাঠে নামতে দেখে। ১৯৯৬ সালের একটি আইনকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কার্যকর করবে। এই আইনে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মান্য না করতে বলা হয়েছে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোকে এবং তাদের রক্ষাকবচ দেয়া হয়েছে ‘তৃতীয় কোনো দেশের উদ্যোগে বিদেশী ভূখণ্ডে আইন প্রয়োগের ক্ষতি’ থেকে। তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, ইরানিদের মনে ‘ইউরোপিয়ানরা কি আমাদের পক্ষে থাকবে, না আমেরিকার পক্ষ নেবে?’

এটাও বলতে হয়, ইরানিরা পাশ্চাত্যের মতো হতে চায় না। ইমাম রেজার মাজারে বারবার গেলে এটা সবচেয়ে ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায়। সেখানে ভোরে গিয়েছি, অপরাহ্লে ঝড়ের পর গিয়েছি এবং গিয়েছি রাতের বেলায়ও। এই মাজারকে বলা হয় ‘আস্তান কোদস-এ-রাজাভি’। সোনালি গম্বুজ আর ব্যয়বহুল মিনারে শোভিত এই মাজার। সেখানে ১২টি আঙিনার পরিসর ১০ লাখ বর্গমিটারেরও বেশি। সেখানে ইরানের বৃহত্তম এনজিও রয়েছে। এর প্রশাসন ভবন শত শত বছরের প্রাচীন। এতে আছে আটটি ডিরেক্টরেট; শিল্প, কৃষি ও পরিবেশ সম্পর্কিত অর্ধশতাধিক কোম্পানি; ১৫টির অধিক সাংস্কৃতিক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং ১২ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী।

মাজারে দ্বাদশ শতকের লাইব্রেরিটি বিশ্বের প্রাচীনতম গ্রন্থাগারগুলোর একটি। আলেকজান্দ্রিয়া, ভ্যাটিকান আর তোপকাপির (ইস্তাম্বুল) লাইব্রেরির সাথে এটিও একই সারিতে শামিল। আয়াতুল্লাহ খোমেনি আলী রেজার মাজারের গ্রন্থাগার সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। জনগণের জন্য উন্মুক্ত এই গ্রন্থাগারে আছে ৯০টি ভাষার চার মিলিয়ন বই। এমনকি একটি ল্যাবরেটরি রয়েছে, যেখানে ‘বইপুস্তকের বিমারি’র চিকিৎসা চলে। মাশহাদের মাজার কর্তৃপক্ষ ভারতে একটি লাইব্রেরি ও একটি ডকুমেন্টেশন সেন্টার পরিচালনা করে থাকে। এখানে ১৮ মিলিয়নের বেশি আইটেম রয়েছে। এর মধ্যে আছে হজরত আলী রা:-এর সাথে সংশ্লিষ্ট তেরো শ’ বছরের প্রাচীন একটি ডকুমেন্টও।
রাতে (কাতারের রাজধানী) দোহার উদ্দেশে যাত্রার আগে ইতালির দুই নাগরিককে নিয়ে শেষবারের মতো মাজারটি দেখতে গেলাম। ওই দু’জন হলেন ইতিহাসে নিমগ্ন, সুদক্ষ সাংবাদিক গিউলিয়েট্টো চিয়েসা এবং লেখক রবার্টো কুয়াগলিয়া। দিনটি ছিল পয়লা রমজান। মাজারের সৌন্দর্য, আধ্যাত্মিক আলোকসজ্জা আর সাদামাটা পুরনো কৌতুকের মাঝে আমরা ছিলাম নির্বাক।

দেখলাম, গোটা পরিবার মিলে বনভোজন করছে; গল্পগুজব করছে, তুলছে সেলফি; এ দিকে শিশুরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, খেলাধুলা করছে। কোনো বিগব্রাদার সম্পর্কিত কোনো অসৎ ভাষ্যের প্রতি তাদের আসক্তি নেই। পাশ্চাত্যের বেশির ভাগ লোক এটাই করে থাকে।
ইতোমধ্যে চীনের একটি ট্রেন সূর্যমুখী বীজ নিয়ে মঙ্গোলিয়া থেকে সাপের মতো এঁকেবেঁকে আসছে তেহরানের দিকে। যুদ্ধোন্মাদ কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করছে। অপর দিকে, প্রাচীন ও নবীন ‘রেশমপথ’ চিরকালের জন্য চালু রয়েছে। 

লেখক : এশিয়া টাইমসের প্রতিনিধি ও কলামিস্ট
ভাষান্তর : মীযানুল করীম


আরো সংবাদ



premium cement