২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ঈদ ও সার্বজনীন উৎসব

ঈদ ও সার্বজনীন উৎসব -

যেখানেই মানুষের বাস সেখানেই উৎসব। সব উৎসবের পেছনেই থাকে কোনো না কোনো কারণ। নতুন ফসল ওঠার আনন্দে হয়ে থাকে উৎসব। নতুন রাজা-বাদশাহ বা শাসক ক্ষমতায় বসলেও হয় উৎসব। তেমন দিনকে রাজার শাসনকালজুড়ে প্রতি বছর ঘটা করে পালন করার রেওয়াজও আছে দেশে দেশে। জাপানের মতো উন্নত দেশের মানুষ এখনো নতুন সম্রাট ক্ষমতায় বসার সাথে সাথে বদলে ফেলে বর্ষপঞ্জি। নতুন করে তৈরি করে ক্যালেন্ডার। শুরু করে নতুন সন, নতুন যুগের গণনা। তবে ধর্মভিত্তিক আয়োজনই সবসময় ছিল মানুষের প্রধান উৎসব। এ রকম উৎসবে গণসংযোগ থাকে বেশি, এগুলো স্থ্য়াী হয় দীর্ঘকাল। বহু রাজা-বাদশাহ তাই আধিপত্য বজায় রাখতে ধর্মের সাথে নিজেদের জুড়ে আয়োজন করেছেন বিবিধ উৎসবের। জনগণের ওপর সেগুলো চাপিয়ে দিয়েছেন ‘অবশ্য পালনী’য় হিসেবে।

কারণ বিভিন্ন হলেও উৎসবগুলোর মধ্যে অভিন্ন মিল হলো এগুলোর সবই ছিল ক্ষণস্থায়ী। রাজার আসা-যাওয়ার সাথে, দেবতা বদলের সাথে বদলে গেছে এগুলোর দিন-কাল, বদলেছে আচার-আয়োজন। এমনকি তিন হাজার বছর ধরে চলা, ফেরাউনদের ধর্মভিত্তিক উৎসবগুলোও হারিয়ে গেছে কালের আবর্তে। তারা দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে নিজেদের মমি গড়েছিল পরজগতে নিশ্চিন্তে থাকার আশায়। আচারগুলোকে তারা ধরেই নিয়েছিল শাশ্বত সত্য হিসেবে। কিন্তু তাদের মরদেহগুলো এসে পড়েছে আমাদের হাতে। আমরা এখন নিশ্চিতভাবেই জানি, তাদের সেসব মনগড়া বিশ্বাস ছিল নিতান্তই ভ্রান্তিবিলাস মাত্র। মমিগুলোর সাথে ‘পরকালীন’ আরাম-আয়েশের জন্য দেয়া হয়েছিল যেসব পাইক-পেয়াদা, ধন-সম্পদ তা সবই বৃথা গেছে।

দক্ষিণ আমেরিকার বহুলালোচিত ইনকা জনগোষ্ঠীরও ছিল বিশ্বাসভিত্তিক কঠিন সব আচার-অনুষ্ঠান। বল খেলার নামে রক্তের হোলি খেলা তার অন্যতম। খেলায় হেরে যাওয়া প্রতিদ্বন্দ্বীর কাটা মাথা আর তাজা রক্ত ছিল ‘দেবতার অর্ঘ্য’। সেই অনুষ্ঠানের জন্য তারা দুর্গম পাহাড়ের আট হাজার ফুট উঁচুতে গড়ে তুলেছিল চোখ ধাঁধানো বিশাল এক মণ্ডপ এলাকা, অবিশ্বাস্য ‘মাচুপিচু’। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। রাজ্য ফেলে তাদের পালাতে হয়েছিল হঠাৎ। ভোজবাজির মতোই আশ্চর্যজনক ছিল তাদের সেই হারিয়ে যাওয়া। ১০০ বছরও টেকেনি তাদের রাজত্ব আর ভয়ঙ্কর কালচার।
এমনই ঘটেছে বিশ্বজুড়ে যুগে যুগে। টিকতে পারেনি মানুষের মনগড়া কোনো আয়োজনই। নিজেদের ভ্রান্তবিশ্বাসে সেরা চিন্তা আর উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে মানুষ যা কিছুর আয়োজন করছে, সবই কালক্রমে হারিয়ে গেছে। সেগুলোর যতটুকু উদ্ধার করা গেছে তার বেশির ভাগই বর্জ্য বলে বিবেচিত হয়েছে পরবর্তী মানুষের কাছে। এসব নিশ্চিতভাবেই প্রমাণ করে, মানুষের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয় শাশ্বত ও সার্বজনীন কোনো নিয়ম-পদ্ধতি বা আচার-বিচার প্রবর্তন করা।

কিন্তু অতীত থেকে সাধারণত কেউ শিক্ষা নেয় না, আমরাও নেইনি। এখন আমরাও নিজস্ব ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির নামে আয়োজন করছি ভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানের এবং সৃষ্টি করে চলেছি লেজেগোবরে অবস্থা। এসব উৎসবে প্রাধান্য পাচ্ছে স্থূল আনন্দ, ক্ষণিকের উন্মাদনা। পরিণামে তা সৃষ্টি করছে শারীরিক ও মানসিক অবসাদ আর আর্থিক অপচয়। অন্তঃসারশূন্য হওয়ায় আয়োজনগুলো সীমিত থাকছে মূলত সম্পদশালী ব্যক্তিদের মধ্যে। এরাই হচ্ছে এগুলোর আয়োজক, পৃষ্ঠপোষক, এরাই তুলে নিচ্ছে একতরফা ফায়দা। উৎসবগুলো কোনো অবদান রাখতে পারছে না নিঃস্ব-গরিবদের জীবনে। এসব আয়োজন স্পর্শ করে না রোগে-শোকে কাতর ব্যক্তির জীবনকে। কখনো পৌঁছায় না হাসপাতালে শায়িত রোগগ্রস্তদের কাছে। বরং অসহনীয় হয়ে দেখা দেয় অনেকের জীবনে। তেমন হয়ে থাকে মা দিবস ও বাবা দিবসে। দুনিয়াজুড়ে জনপ্রিয় এই উৎসবগুলো সন্তান লাভে অক্ষম হাজার হাজার দম্পতির জন্য যে কতটা হৃদয়বিদারক ও মর্মবেদনার, তা কেউ ভেবে দেখেছেন বলে মনে হয় না। এমন খণ্ডিত আনন্দ কারো কাম্য হতে পারে না। অথচ এগুলোই নাকি সার্বজনীন বিশ্ব উৎসব। এটা মূলত আমাদের বিচার ও বিবেচনার ভুল। এসব উৎসব আসলে এক ধরনের ব্যবসায়ের ফাঁদ। সেই ফাঁদে আটকা পড়ে গেছি আমরা।
উৎসব সার্বজনীন হবে তখনই, যখন সেই আনন্দে থাকবে সবার সমান হিস্যা। সেখানে ধনী-গরিব থাকবে একত্রে। রোগে-শোকে আক্রান্তরাও থাকবে না সেই খুশির বাইরে। অক্ষম ও সক্ষমে থাকবে না ভেদাভেদ। আলাদা করে দেখা হবে না কাউকেই। এমনকি তা থেকে বাদ যাবে না পরপারে চলে যাওয়া কারো আত্মীয়স্বজনও। একাত্মতার এই বন্ধনই বস্তুত এই সৃষ্টির মূল সূত্র। এটাই সত্য, এটাই শাশ্বত। এই একত্বকে খণ্ডিত-বিখণ্ডিত করে কোনো শাশ্বত উৎসব হতে পারে না। এটাকে পাশ কাটিয়ে কোনো সার্বজনীন আচার-অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়।

একতার পরম এই বোধে মানুষকে ফিরে আসতে হয় বারবার। সেই উপলব্ধি থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল জাতিসঙ্ঘ। সে জন্যই পরিবেশ মেরামত করতে বিশ্বের সব দেশকে কাজ করতে হচ্ছে একত্রে। এতে প্রমাণিত হয় যে, একক এই সৃষ্টি জগৎকে বিভিন্নভাবে ভোগ করা সম্ভব নয়। একত্বের বিবেচনা ছাড়া এ জগতের কোনো কিছুই উপভোগ্য হওয়ার নয়। কোনো ভোগ লাভজনক হয় না। একত্বের দৃঢ় সূত্র ছাড়া সুশৃঙ্খল এই মহাজগতের অস্তিত্ব অসম্ভব। তাই সার্বজনীন কিছু করতে হলে তা করতে হবে একত্ববাদের সনাতন সূত্র মেনে। সর্বজনীনতার এই মূল বৈশিষ্ট্যেরই দেখা মেলে প্রধানত মুসলমানদের ঈদ উৎসবে।
বস্তুত ঈদ পৃথিবীর একমাত্র উৎসব, যা পুরো মহাবিশ্বকে গ্রথিত করে ভ্রাতৃত্বের একক বন্ধনে। একত্বের যে মূল দর্শনের ওপর সৃষ্ট এই মহাবিশ্ব তার সর্বোচ্চ অনুশীলন নিশ্চিত করা হয় এই উৎসবে। ঈদের শুরুতেই তাই গরিবকে বুঝিয়ে দিতে হয় তার ন্যায্য পাওনা। নিজের খাদ্য তুলে দিতে হয় নিঃস্বের মুখে, তাদের জন্য নিশ্চিত করতে হয় পরনের কাপড়। প্রতিবেশীকে সদা রাখতে হয় সাথে। ধর্ম, বর্ণ বা গোত্রের কারণে বিভেদ করা যায় না এ ক্ষেত্রে। রোগীর জন্য নিশ্চিত করতে হয় বিশেষ সেবা। আর কবরে শায়িত আপনজনেরা থাকেন এই আয়োজনের শীর্ষে। শুধু মানুষই নয়, মহাজগতের সুবিশাল প্রকৃতিও ঈদের আনন্দকে উপভোগ করে থাকে। শীত একা ভোগ করতে পারে না এই আনন্দ। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎও পায় না বাড়তি কোনো সুবিধা। বর্ষ পরিক্রমার ধারায় প্রতিটি ঋতুই সুযোগ পেয়ে থাকে ঈদ উৎসব আয়োজনের।

বিশ্ব জগৎকে এমন অনুপম আয়োজনে একীভূত করার এই অসামান্য প্রয়াস সুমহান একক স্রষ্টা ছাড়া আর কারো কাজ হতে পারে না। একত্বের উৎস থেকে না হলে এতে অবশ্যই দেখা যেত বহু অনৈক্য, অনেক অসঙ্গতি। এহেন মহান স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ ছাড়া কী করে হতে পারে কোনো শাশ্বত উৎসব? বস্তুত সেই কাজই অতীব যতেœর সাথে যথার্থভাবে করা হয়ে থাকে পবিত্র ঈদ উৎসবে। ঈদ শুরু হয় মহান স্রষ্টার প্রতি নিঃশর্ত নতজানু আনুগত্যের মাধ্যমে। এই কৃতজ্ঞতা অত্যাবশ্যক, এই আনুগত্য এককভাবে শুধু পরম স্রষ্টারই প্রাপ্য। এমন সৃষ্টিকর্তার একত্বের প্রতি ন্যূনতম অবজ্ঞাও তাঁর প্রতি চরম অকৃতজ্ঞতা। তাঁর একক কর্তৃত্বের ওপর বিন্দুবৎ কলঙ্কও ‘বিশাল পাত্র পূর্ণ দুধের মধ্যে এক ফোঁটা ময়লার’ মতোই বর্জনীয় ও অগ্রহণযোগ্য। তেমন অকৃতজ্ঞতার কোনোই সুযোগ নেই পবিত্র ঈদ উৎসবে।
মহান আল্লাহ তালার প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রকাশের এই ধারা পৃথিবীর বুকে নিরবচ্ছিন্নভাবে টিকিয়ে রেখেছে জগতের মুসলিম জনগোষ্ঠী। সৃষ্টির আদি থেকে এখন পর্যন্ত তারা পরম স্রষ্টা আল্লাহ পাকের নির্দেশ মেনে নিষ্ঠার সাথে পালন করে চলেছে পবিত্র নামাজ, রোজা, হজ, কোরবানি ও তসংশ্লিষ্ট উৎসব। তারই ধারাবাহিকতায় মুসলমানেরা বার্ষিক ভিত্তিতে পালন করে চলেছে দুটি করে ঈদ উৎসব। সময়ের আবর্তে উলট-পালট হয়ে গেছে সবকিছু, সাথে বদলে গেছে বহু উৎসব-আয়োজনও। বদলায়নি শুধু সুমহান এক আল্লাহর নাম। আর বদলায়নি সেই আল্লাহর প্রতি মুমিন মুসলমানদের অনন্য প্রকাশের অবিরাম আয়োজন। প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের ঈদই হলো মানব জাতির একমাত্র সেই মহা উৎসব, যা একাধারে শাশ্বত, সনাতন ও সার্বজনীন। 
লেখক : লস অ্যাঞ্জেলস প্রবাসী

লেখকের বই পেতে : : search 'Mainul Ahsan' at 'amazon.com'


আরো সংবাদ



premium cement