২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

দুই কোরীয় নেতার মহামিলন ও বিশ্বের প্রত্যাশা

১৯৬৯ সালে সরকারের দেয়া জমিতে গড়ে ওঠে সিউল কেন্দ্রীয় মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার - ছবি : সংগ্রহ

এবার দুই কোরীয় নেতার ঐতিহাসিক মিলনে বিশ্ববাসী স্বস্তি পেয়েছে। উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং উন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বাগযুদ্ধে যে শঙ্কায় ভুগছিল সবাই, তা থেকে আপাতত রেহাই মিলেছে। বেশ কয়েকবার দক্ষিণ কোরিয়ায় যাতায়াতে আমি নিজে দেশটির প্রতি মুগ্ধ। দেশটি সম্পর্কে জানতে চেয়েছি। উত্তর কোরিয়ার অনেক ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক তথ্যও মাথায় রাখার চেষ্টা করেছি।

উত্তর কোরিয়া উত্তর-পূর্ব এশিয়ার একটি রাষ্ট্র, যা উপদ্বীপের উত্তর অর্ধাংশ নিয়ে গঠিত। উত্তরে গণচীন, উত্তর-পূর্বে রাশিয়া, পূর্বে জাপান সাগর, দক্ষিণে দক্ষিণ কোরিয়া এবং পশ্চিমে পীত সাগর। দেশটির আয়তন এক লাখ ২০ হাজার ৫৩৮ বর্গকিলোমিটার। উত্তর কোরিয়া ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৫০-এর দশকের কোরীয় যুদ্ধের পর থেকে এটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। উত্তর কোরিয়ার রাজধানী ও বৃহত্তম শহর হচ্ছে পিয়ংইয়ং। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যখানে রয়েছে কোরীয় সেনামুক্ত অঞ্চল। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী কোরিয়া এবং কোরিয়া প্রজাতন্ত্র নামের দু’টি সার্বভৌম রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটার মাধ্যমে অঞ্চলটি বিভাজিত হয়। এ সময়ই সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র কোরিয়াকে সমান্তরাল রেখা অনুযায়ী বিভক্ত করে দেয়, যার উত্তর ভাগ পড়ে সোভিয়েতদের আওতায় আর দক্ষিণ ভাগ মার্কিনের নিয়ন্ত্রণে। দক্ষিণ কোরিয়া পর্যটকের কাছে যে কারণে পছন্দের তা হচ্ছে- আধুনিক বিশ্বে নাগরিক সুবিধা ও উন্নত জীবনধারার জন্য দেশটির সুখ্যাতি অনেক। দেশটি কোরীয় উপদ্বীপের দক্ষিণ অংশ নিয়ে গঠিত। সিউল দক্ষিণ কোরিয়ার বৃহত্তম শহর ও রাজধানী। এটি বিশ্বের শীর্ষ ১০টি ধনী শহরের একটি।

১৯১০ সালে জাপান কোরিয়া উপদ্বীপের ওপর দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করলে এক মিলিয়নের বেশি কোরিয়ান নাগরিক প্রতিবেশী রাষ্ট্র চীনে আশ্রয় নেয়। সেখানে চীনা মুসলিমদের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়। কয়েক দশক চীনে অবস্থানের ফলে কিছু কোরিয়ান ইসলাম ধর্মও গ্রহণ করেছিলেন। কোরিয়া স্বাধীনতা অর্জন করলে ১৯৪৫ সালে তারা নিজ দেশে ফিরে আসেন। আবার ১৯৫০-১৯৫৩ সালে কোরিয়া যুদ্ধের সময় তুরস্ক দক্ষিণ কোরিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছিল এবং পাঁচ সহস্রাধিক সেনা পাঠিয়েছিল। সাম্প্রতিক আদমশুমারিতে দেখা যায়, দক্ষিণ কোরিয়ায় দুই লক্ষাধিক মুসলমানের বসবাস। তন্মধ্যে ৫০ সহস্রাধিক স্থায়ী কোরিয়ান মুসলিম।

জানা যায়, রাজধানী সিউল, বুসান প্রভৃতি অঞ্চলে বর্তমানে ১৫টি মসজিদ এবং শ’খানেক নামাজঘর রয়েছে। ১৯৬৯ সালে সরকারের দেয়া জমিতে গড়ে ওঠে সিউল কেন্দ্রীয় মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার। এই মসজিদের মিনার দু’টি মুসলিম স্থাপত্যের প্রতীক হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদটি দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম মসজিদ। কয়েকটি মুসলিম দেশের অর্থায়নে এর নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছিল ১৯৭৬ সালের ২১ মে। প্রতি শুক্রবার মসজিদ পূর্ণ হয়ে পাশের রাস্তাঘাটে মুসল্লিদের উপচে পড়া ভিড় থাকে। এটি বিশ্বের অনন্য সুন্দর মসজিদ হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে।

মুসলমানদের জন্য বিশেষভাবে হালাল গোশত ও হালাল ফুডের ব্যবস্থাও রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। শুধু ইতোয়ান শহরেই হালাল রেস্টুরেন্ট, হালাল গোশত ও ফুডের দোকান গড়ে উঠেছে বহু। এখানে তাবলিগ জামাতের তৎপরতাও ব্যাপক। সিউল সেন্ট্রাল মসজিদে প্রতি বছর তাবলিগের ইজতেমা হয়ে থাকে। এখানে কয়েকটি ইসলামিক ফাউন্ডেশনও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কোরিয়ান ভাষায় পবিত্র কুরআনের অনুবাদ বের করাসহ বেশ কিছু প্রকাশনার কাজও করেছেন তারা। হয়তো এসব কারণে কোনো মুসলিম সিউলে গেলে অনুকূল পরিবেশ সহজেই খুঁজে পান।

দক্ষিণ কোরিয়া চাইছে, দেশটিতে আরো বেশি পরিমাণে মুসলিম পর্যটক ও ছাত্র আসুক। এ লক্ষ্যে কোরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত খাদ্য সংস্থা সম্প্রতি একটি মোবাইল অ্যাপ চালু করেছে। এর মাধ্যমে জানা যাবে কোরিয়ার কোন কোন রেস্তোরাঁয় হালাল খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। সেই সাথে হালাল পণ্য পাওয়া যায়- এমন বিপণিবিতানও সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে। অ্যাপটির মাধ্যমে মুসলিম ক্রেতারা কোনো পণ্যের বারকোড স্ক্যান করে সেটি ‘হালাল’ সনদপ্রাপ্ত কি না তাও জানতে পারবেন। জানা যাবে, মুসলিম পর্যটকদের পছন্দের জায়গা কোনগুলো, কোথায় রয়েছে নামাজের ব্যবস্থা। কম্পাসের সাহায্যে কেবলা নির্ণয়ের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।

যা হোক, দুই কোরিয়ার যুদ্ধংদেহী মনোভাব অনেক পর্যটকদের কাছে আতঙ্ক। ৬৮ বছরের দ্বন্দ্বের অবসানে উপদ্বীপের দুই নেতার ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ, একে অপরের সাথে করমর্দন এবং আলিঙ্গন দেখে নিঃসন্দেহে অনেকেই মুগ্ধ হয়েছেন। দুই কোরিয়ার সীমান্তবর্তী গ্রাম পানমুনজমে ঐতিহাসিক বৈঠকে কিম জং উন আর মুন জে ইন ঘোষণা দিলেন আর নয় যুদ্ধ। তারা ঘোষণা দিলেন কোরিয়া যুদ্ধের সমাপ্তির। সম্মেলন শেষে কিম এবং মুন কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি, সমৃদ্ধি ও একীভূতকরণ সংক্রান্ত পানমুনজম যৌথ ঘোষণায় স্বাক্ষর করলেন। মিডিয়ায় এসব দৃশ্যে আপ্লুত হলো বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ। তবে ভয় রয়েই গেছে। কারণ, যা ঘটেছে তা অবিশ্বাস্য ও সিনেমাটিক। আমার মতো অনেকেই চোখ কপালে তুলে নিজেকে প্রশ্ন করেছেন- যা দেখছি তা কি সত্যি?

আবেগাপ্লুত কিম জং উন বললেন, ‘দুই কোরিয়া একদিন একক দেশ হবে।’ সমঝোতা স্মারকে বলা হলো- কোরীয় উপদ্বীপকে পরমাণুমুক্ত করার প্রয়াসে ধাপে ধাপে নিরস্ত্রীকরণ করা হবে। যুদ্ধ বন্ধের জন্য দুই কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন একটি বৈঠকে বসবে। সব প্রতিকূল আইন বাতিল করা হবে এবং সামরিক কর্মকাণ্ডমুক্ত অঞ্চল পানমুনজমকে এখন থেকে ‘শান্তি অঞ্চল’ নামে ডাকা হবে। এই বছরের ১৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত হবে যুদ্ধে আলাদা হয়ে যাওয়া পরিবারগুলোর পুনর্মিলনী। সীমান্তের কাছের অর্থনৈতিক অঞ্চল কেসিয়ংয়ে স্থাপন করা হবে সম্মিলিত লিয়াজোঁ অফিস। সরকারের সব পর্যায়ে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা হবে। দুই দেশ এশিয়ান গেমসসহ আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানগুলোতে পাঠাবে যৌথ দল। দুই দিন আগের কিম জং উনের সাথে নতুন কিম জং উনের যেন আকাশ-পাতাল ফারাক!

দুই নেতার এই মহামিলনে দৃশ্যত ছিল আন্তরিকতা, ছিল হৃদ্যতা। তারা একত্রে নৈশভোজে অংশ নিয়েছেন। নৈশভোজে দুই কোরিয়ার ঐতিহ্যবাহী খাবার এবং এর পর সুইজারল্যান্ডের মিষ্টান্ন পরিবেশিত হয়। কিম একবারও পরমাণু কর্মসূচি বন্ধের কথা না বললেও ‘পানমুনজম ঘোষণা’ দূরপ্রাচ্যে শান্তির বার্তাই দিচ্ছে বলে আশা করা যায়। কিম বললেন, ‘সব সময়ই মনে করি, আমরা একই পরিবারের সদস্য। আমরা দুই দেশই একে অপরকে সাহায্যের ব্যাপারে নতুন নীতিমালা অনুসরণ করব। এত বছরের বিরোধের পরও বলছি, আজ থেকে কোনো কিছুই আর আমাদের আলাদা করতে পারবে না।’ দক্ষিণ কোরিয়ার নেতা মুনও বললেন, ‘কিম এবং আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, কোরিয়ায় আর কোনো যুদ্ধ হবে না। আজ থেকে আমাদের নতুন যুগের শুরু।’

এক দেশের সীমান্তে শান্তির পায়রা উড়ল তো অন্য সীমান্তে গুলির শব্দ। ছয় দশক ধরে দুই কোরিয়ার সম্পর্কটা এ রকম। প্রতীয়মান হয়, দীর্ঘ ৬৫ বছরের যুদ্ধংদেহী মনোভাব থেকে সরে এসে শান্তির নতুন যুগে প্রবেশ করছে দুই কোরিয়া।
দুই কোরিয়ার সামরিক সীমারেখায় দুই নেতার হাতে হাত মেলানো, পরে মুন জে ইনের হাত ধরে দক্ষিণ কোরিয়ার মাটিতে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতার পা রাখা, এরপরই কিমের অনুরোধে উত্তর কোরিয়ার মাটিতে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়ানো- এসব দৃশ্যত নিষ্ফল হতে পারে না। এই মহামিলনের মধ্য দিয়ে রচিত হোক একটি সুন্দর আগামীর পথ। হয়তো একদিন বার্লিন প্রাচীরের মতো ৩৮ ডিগ্রি উত্তর অক্ষরেখার সীমানা দেয়ালও ভেঙে দিয়ে
উত্তর-দক্ষিণ ভুলে কোরীয়রা নিজেদের মাঝে স্থায়ী ঐক্য গড়ে তুলবে। 

e-mail : bbskp71@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement