২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভারতের প্রতারণা

পাকিস্তানে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা কূলভূষণ যাদব -

বিশ্বের পরাশক্তি রাষ্ট্র আমেরিকা তার এক সেনা কর্মকর্তাকে পাকিস্তান থেকে বের করে নিয়ে যেতে চাচ্ছিল, কিন্তু পাকিস্তান ওই আমেরিকান কর্মকর্তাকে পাকিস্তান ত্যাগের অনুমতি দেয়নি। কেননা, তিনি একজন স্থানীয় নাগরিকের মৃত্যুর জন্য দায়ী। ওই ঘটনার পর পাকিস্তান ও আমেরিকার সম্পর্কের মাঝে টানটান উত্তেজনা আরো বেড়ে যায়। উভয় দেশের পক্ষ থেকে একে অপরের রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে এমন কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে যে, অতীতে এর দৃষ্টান্ত খুব কমই পাওয়া যায়। এক দিকে পাকিস্তান ও আমেরিকার সম্পর্কের মাঝে টানাপোড়েন বাড়ছে, অপর দিকে ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য নতুন নতুন যুদ্ধের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

এমন অবস্থায় জাতীয় নিরাপত্তার ব্যাপারে পাকিস্তানে ঐকমত্য জরুরি। বাহ্যত প্রশাসনিকভাবে বিদ্যমান একটি জাতীয় নিরাপত্তা কমিটিতে রাজনৈতিক ও সামরিক নেতারা সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত পরস্পর পরামর্শেরভিত্তিতে গ্রহণ করেন, কিন্তু রাজনৈতিক অজুহাতের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী শাহেদ খাকান আব্বাসী ও তার মন্ত্রীদের আচরণ জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির ভেতরে ও বাইরে অন্যরকম। নির্বাচন নিকটে চলে এসেছে। আর এ জন্য রাজনীতিবিদদের বক্তব্যে একে অপরের হাঁড়ি উজাড় করে দেয়া হচ্ছে।
গরমের মওসুমে গরম গরম বক্তৃতা প্রদানকারীদের একে অন্যের রক্তের পিপাসু মনে হচ্ছে। একে অন্যের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোদের নিজেদের আশপাশের অবস্থা সম্পর্কে একেবারে অসচেতন মনে হচ্ছে। আর পাকিস্তানের শত্র“ এ অসচেতনতা থেকে পুরোপুরি ফায়দা উঠিয়ে নিচ্ছে। সম্প্রতি ইসরাইল বংশোদ্ভূত জার্মান ইহুদি এলিস ডেভিডসনের গ্রন্থ ভারতে প্রকাশ হয়েছে। এতে মুম্বাই হামলার ব্যাপারে ‘ভারতের প্রতারণা’ উন্মোচন করে দেয়া হয়েছে। ডেভিডসন ইসরাইলে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তিনি ইহুদিবাদের বিরোধী। মুম্বাই হামলায় কিছু ইসরাইলি নাগরিকও মারা গেছিল। এ কারণে ইসরাইলি মিডিয়ায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বেশ সমালোচনা করা হয়। ডেভিডসন মুম্বাই হামলার ব্যাপারে তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পারেন, ভারত সরকার প্রমাণ নষ্ট করে ফেলেছে। এ বই পড়ে জানা যায়, মুম্বাই হামলায় হয়তোবা পাকিস্তানি নাগরিককে ব্যবহার করা হয়েছে, তবে এ হামলা মূলত একটি নাটক ছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বপরিমণ্ডলে পাকিস্তানের বদনাম করা। ডেভিডসন লিখেছেন, মুম্বাই হামলার দশ অপরাধীর মধ্যে শুধু একজন অপরাধী আজমল কাসসাব জীবিত ধরা পড়ে। তবে তাকে ২৬ নভেম্বর, ২০০৮ নয়, বরং ৬ নভেম্বর, ২০০৮ গ্রেফতার করা হয়েছিল। ডেভিডসন কোনো নতুন কথা বলেননি। মুম্বাই হামলার এক বছর পর ২০০৯ সালে ভারতে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা এস এম মোশাররফের বই প্রকাশ হয়েছিল।

যেখানে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, মুম্বাই পুলিশের এন্টি-টেররিস্ট স্কোয়াডের প্রধান হেমন্ত কারকারেকে ২৬ নভেম্বর, ২০০৮-এ কে মেরেছে? এস এম মোশাররফ মহারাষ্ট্রের সাবেক আইজি। তিনি তার ডযড় শরষষবফ কধৎশধৎব নামের বইয়ে লিখেছেন, আজমল কাসসাব মূলত নেপালে গ্রেফতার হয়েছিল। নেপালের পুলিশ তাকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করে। আর ভারত মুম্বাই হামলার পর আজমল কাসসাবকে একজন পাকিস্তানি সন্ত্রাসী বানিয়ে উপস্থাপন করে। ওই গ্রন্থেই বলা হয়েছে, হেমন্ত কারকারে এমন কিছু হিন্দু উগ্রপন্থীর বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করে ফেলেছিলেন, যারা ভারতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিজেরা করায় এবং মুসলমানদের ওপর দোষ চাপিয়ে দেয়। ২৬ নভেম্বর, ২০০৮-এর রাতে ওই হেমন্তকে গুপ্তভাবে হত্যা করে দাবি করা হয়, তিনি মুম্বাই হামলায় মারা গেছেন।

এস এম মোশাররফের বই নিয়ে ভারতে বহু দেন-দরবার হয়েছে। ২০১৩ সালে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি আর ভি এস মানির পক্ষ থেকে ইশরাত জাহান মামলায় গুজরাট হাইকোর্টে এক বক্তব্য দেয়া হয়। যেখানে বলা হয়, ২০০১ সালের ডিসেম্বরে ভারতের পার্লামেন্টে এবং ২০০৮ সালের মুম্বাইয়ে হামলা মূলত ভারত সরকারের সাজানো ষড়যন্ত্র ছিল। মানি আদালতে দাখিলকৃত হলফনামার বক্তব্যে বলেন, তাকে স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিমের (এসআইটি) আইজি সতীশ চন্দ্র ভার্মা বলেছিলেন, পার্লামেন্টে হামলার উদ্দেশ্য ছিল পোটা আইন পাস করানো এবং মুম্বাই হামলার উদ্দেশ্য ছিল ইউএপিএ আইন পাস করানো। যাতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থ জোগানদাতার বিরুদ্ধে কঠোরভাবে হস্তক্ষেপ করা যায়। সতীশ চন্দ্র ভার্মা গুজরাটের অধিবাসী এবং আইপিএস অফিসার ছিলেন। তিনি ২০১৩ সালে জুনাগড় পুলিশ ট্রেনিং কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। তিনি মানির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তবে ওই অভিযোগের পেছনেও এক নাটক ছিল, যা সতীশ চন্দ্র ভার্মা কয়েক বছর আগে ফাঁস করে দিয়েছেন।

এ নাটক ১৪ জুন, ২০০৪ সালে আহমদাবাদে হয়েছিল। যেখানে স্থানীয় পুলিশ উনিশ বছর বয়সী ছাত্রী ইশরাত জাহানসহ চার জন ব্যক্তির পুলিশের সাথে লড়াইয়ে মারা যাওয়ার দাবি করা হয় এবং বলা হয়, চারজনই লশকরে তয়্যেবার সদস্য। এরা গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। গুজরাট পুলিশ দাবি করে, মৃতদের মধ্যে আমজাদ আলী রানা পাকিস্তানের ভালওয়াল শহর ও জীশান জওহার গুজরানওয়ালার অধিবাসী। সিবিআই তদন্ত করলে জানা যায়, এটা এক সাজানো পুলিশি লড়াই ছিল। সতীশ চন্দ্র ভার্মা সিবিআইয়ের রিপোর্ট আদালতে পেশ করেন এবং আদালত পুলিশের সাথে লড়াইকে সাজানো বলে অভিহিত করেন। সতীশ এ দাবিও করেন, ওই সাজানো পুলিশি লড়াইয়ে কোনো পাকিস্তানি নাগরিক মারা যায়নি। গুজরাট পুলিশ আমজাদ আলী রানা ও জীশান জওহারের নকল পরিচয়পত্র বানায়। তারা দু’জন মূলত মহারাষ্ট্রের অধিবাসী ছিল। ওই নাটককে সামনে রেখে সতীশ চন্দ্র ভার্মা মুম্বাই হামলাকেও সন্দেহের চোখে দেখেন এবং হয়তোবা এমনই সন্দেহ হেমন্ত কারকারের মাথাতেও দানা বাধে। কিন্তু তাকে অতি দ্রুত মৃত্যুর ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হয়। মুম্বাই হামলাকে সন্দেহের চোখে দেখা ব্যক্তি আজমল কাসসাবের পাকিস্তানি নাগরিক হওয়াকে অস্বীকার করেননি। তাদের দাবি, আজমল কাসসাব মুম্বাই হামলার কমপক্ষে বিশ দিন আগে গ্রেফতার হয়। মূল হামলাকারী যেখান থেকেই এসে থাকুক, তবে আজমল কাসসাব তার সঙ্গী ছিল না। আজমল কাসসাবের পাকিস্তানি নাগরিক হওয়ার ব্যাপারে সর্বপ্রথম ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য অবজারভার ৭ ডিসেম্বর, ২০০৮ সালে দাবি করেছিল এবং এরপর নওয়াজ শরিফের এক বক্তব্য সামনে এলো যে, আজমল কাসসাব ওকাড়ার ফরিদকোট গ্রামের অধিবাসী। এরপর বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রীও আজমল কাসসাবের নাগরিকত্ব স্বীকার করেছেন। তবে আসল কথা হচ্ছে, পাকিস্তান মুম্বাই হামলার কিছু অভিযুক্ত অপরাধীকে পাকিস্তানে গ্রেফতার তো করেছিল, কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে তদন্তে পাকিস্তানকে সহযোগিতা করা হয়নি।

নওয়াজ শরীফ তার সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে আরো একবার আজমল কাসসাবকে পাকিস্তানি বলে অভিহিত করেছেন। তবে ভালো হতো, যদি তিনি আজমল কাসসাবের সাথে রবীন্দ্র কৌশিক, কাশ্মির সিং, সর্বজিত সিং ও কুলভুশনের নামও উল্লেখ করতেন, যাদেরকে ভারত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করার জন্য পাকিস্তানে পাঠিয়েছিল। নওয়াজ শরীফের বক্তব্যকে ভারতের মিডিয়া তাদের পক্ষে বেশ ব্যবহার করছে। আমাদের একে অপরের সাথে লড়াইয়ের পরিবর্তে নিজেদের ঘর ঠিক করা প্রয়োজন। কয়েক বছর আগে দু’জন পাকিস্তানির হত্যাকারী রেমন্ড ডেভিসকে রক্তপণের নামে মুক্তি দেয়া হয়েছিল। এখন আরো একজন আমেরিকান কর্নেল জোসেফকে বের করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে, যিনি একজন পাকিস্তানি নাগরিকের মৃত্যুর দায়ে অভিযুক্ত। আমাদের রাজনীতিবিদরা প্রতিদিন একে অপরকে গাদ্দার আখ্যায়িত করছেন। নওয়াজ শরীফ, আসিফ জারদারি ও ইমরান খান কি এ কথা বলতে আগ্রহী হবেন, পাকিস্তানি নাগরিক ডক্টর আফিয়া সিদ্দিকী ২০০৩ সালে করাচি থেকে অপহৃত হন এবং বর্তমানে আমেরিকার কারাগারে রয়েছেন? আজকাল আমাদের এ বড় বড় রাজনীতিবিদের অগ্নিঝরা বক্তব্যে ডক্টর আফিয়ার কথা কেন উচ্চারণ হয় না?

হামিদ মীর : পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ১৪ মে, ২০১৮ থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব


আরো সংবাদ



premium cement