২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শহীদ জিয়ার বিরুদ্ধে অপপ্রচার

জিয়াউর রহমান ও বেগম জিয়া - ফাইল ছবি

জাতীয় জীবনে এক সন্ধিক্ষণে জিয়াউর রহমানের অকস্মাৎ ও উজ্জ্বল আবির্ভাব। জাতীয় জীবনের দুর্যোগ মুহূর্তে দু-দুবার তিনি জাতিকে দিশা দিয়েছেন। প্রথমবার, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে তার বজ্রকণ্ঠ বিভ্রান্ত ও দিশেহারা জাতিকে দিশা দিয়েছে। আরেকবার, ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারীদের এবং তাদের বিদেশী প্রভুর হিংস্র কবল থেকে সিপাহি জনতার বিপ্লব দেশকে রক্ষা করে জিয়াউর রহমানকে যখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেন, তখন তিনি একজন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবেও দেশের সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। এরপর দেশ গঠনে মনোনিবেশ করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধন করেন। যে কারণে তাকে ‘আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার’ বলা হয়।

শহীদ জিয়ার বিরুদ্ধে প্রথমে যে অপবাদ দেয়া হচ্ছে তা হলো- বঙ্গবন্ধু হত্যায় তার হাত ছিল, নয় তিনি আগেই জানতেন। এ ধরনের অভিযোগ ধোপে টেকে না। কেননা বঙ্গবন্ধু হত্যার সময় সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল কেএম সফিউল্লাহ, আর জিয়াউর রহমান ছিলেন উপ-সেনাপ্রধান। সামরিক বাহিনীতে ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেস (ডিজিএফআই) নামে একটি এবং মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স নামে আরেকটি গোয়েন্দা সংস্থা আছে। এসব গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন সেনাপ্রধানের কাছে দাখিল করা হয়। সুতরাং বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরিকল্পনা সম্পর্কে যদি এসব সংস্থার কোনো প্রতিবেদন থেকে থাকে তাহলে তা সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল সফিউল্লাহরই জানার কথা। আর যদি এসব সংস্থার এ বিষয়ে কিছু জানা না থাকে তাহলে তা গোয়েন্দার ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচিত হবে এবং তার দায়-দায়িত্বও সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল সফিউল্লাহর ওপরই বর্তায়। এ ক্ষেত্রে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে দোষারোপ করার অবকাশ কোথায়? এ ছাড়া, বঙ্গবন্ধু স্বয়ং তার বাড়ি আক্রমণের খবর জেনারেল সফিউল্লাহকে টেলিফোনে জানানোর পরও তিনি বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেননি। এটাকে কীভাবে দেখা হবে?

শহীদ জিয়ার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় যে অপবাদ দেয়া হচ্ছে, তা হলো তিনি সামরিক আইন জারি করেন এবং গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করেন। এটাও সত্যের অপলাপ। বাস্তব সত্য হলো, ’৭৫-এর আগস্ট অভ্যুত্থানকারীরা আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা খোন্দকার মোশতাক আহমদকে প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত করেন এবং তাকে দিয়ে সামরিক আইন জারি করানো হয়। খোন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্ট হয়ে যে মন্ত্রিসভা গঠন করেন তার সব সদস্যই ছিলেন তার আওয়ামী লীগের সহকর্মী। তিনি কিছুকাল সংসদও বহাল রেখেছিলেন। আর গণতন্ত্রের কবর তো আসলে আগেই দেয়া হয়েছিল একদলীয় বাকশাল গঠন তথা সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে। জিয়াউর রহমান বরং বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেন এবং বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন। ফলে সমাজে আবার গণতন্ত্রের প্রাণতুল্য বহুত্ববাদ প্রতিষ্ঠিত হয়।

জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে আরেকটা অভিযোগ হলো, তিনি ‘সংবিধান ক্ষতবিক্ষত করে গেছেন’। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ’৭২-এর সংবিধানকে ‘আদর্শ সংবিধান’ বলে কোনো কোনো মহল দাবি করলেও এর ত্রুটিগুলো চোখ এড়িয়ে যায় না। তৎকালীন গণপরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সম্বন্ধে বলেছিলেন ৭০ অনুচ্ছেদের মধ্যে এমন একটি অগণতান্ত্রিক বিধান রাখা হয়েছে যা পৃথিবীর আর কোনো সংবিধানে নেই। একে গণতন্ত্রের ‘টুঁটি টিপে হত্যা’ বলে তিনি মন্তব্য করেছিলেন। ’৭২-এর সংবিধানে দেশের নাগরিকদের পরিচয় বাঙালি করার বিধানও বিভ্রান্তিকর, ভ্রমাত্মক ও বিতর্কিত। এসব কারণে গণপরিষদের তৎকালীন সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মো. আজিজার রহমান ও জালাল আহমেদ সংবিধানে সই দান করা থেকে বিরত ছিলেন। এ ছাড়া, ওই সংবিধানে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বিশ্বাস এবং আশা-আকাক্সক্ষার সঠিক প্রতিফলন ঘটেনি। উল্লেখ্য, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ছিল না এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রবাসী সরকারের বক্তৃতা-বিবৃতিতে কিংবা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এ দু’টি মৌলিক নীতির কথা কখনো শোনা যায়নি। এ দু’টি মূলনীতি কার্যত বিজয় দিবস পরবর্তীকালের ভাবনা। স্মর্তব্য, সংবিধান স্বাক্ষরিত হওয়ায় সময় গণপরিষদের সদস্য ছিলেন ৪০৩ জন। গণপরিষদের একমাত্র বিরোধীদলীয় সদস্য সংবিধান বিলটি জনমত যাচাইয়ের জন্য দেয়ার প্রস্তাব করলে তা কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়।

যা হোক, জিয়াউর রহমান জনগণের আকাক্সক্ষা আবেগ-অনুভূতি ও নাড়ির স্পন্দন উপলব্ধি করে সংবিধানের প্রারম্ভে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র পরিবর্তে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস এবং বাস্তবতার নিরিখে সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার’ এর নীতি সংযোজন করেন।
১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এবং পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমেদ কর্তৃক দিল্লিতে স্বাক্ষরিত সমঝোতা চুক্তির ১৪ ও ১৫ ধারার অধীনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার রহিত করা হয়। চুক্তির ১৪ ধারার অংশবিশেষ এরূপ : একইভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পরিচালিত নৃশংসতা এবং ধ্বংসকাণ্ডের ব্যাপারে তিনি চান যে, জনগণ অতীত ভুলে যাবে এবং নতুন করে শুরু করবে এবং বাংলাদেশের জনগণ জানে? কিভাবে ক্ষমা করতে হয়।’ আর ১৫ ধারার এক স্থানে বলা হয়েছে : সম্মত সিদ্ধান্ত হচ্ছে, দিল্লি চুক্তির শর্তাধীনে পাকিস্তান যুদ্ধবন্দী প্রত্যর্পণের যে কাজ চলছে, তাদের সাথে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকেও প্রত্যর্পণ করা যেতে পারে।

মূল আসামিদের বিচার না করে দালাল বা সহযোগীদের বিচার করতে চাওয়া ন্যায়বিচারের দৃষ্টিকোণ থেকে সঙ্গত কিনা সে প্রশ্ন সচেতন মহল তুলতে পারেন। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে দালাল আইনের কার্যকারিতা হারিয়ে যাওয়া এবং দেশ-বিদেশে এসব ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর Bangladesh Collabrators (Special Tribunal) (Repeal) Ordinance ১৯৭৫ জারি করেন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সম্মিলিতভাবে দেশ গড়ার এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতির স্বার্থে বিভাজনের নীতির পরিবর্তে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির পলিসি গ্রহণ করেন এবং রাজনীতিতে ভারসাম্য আনয়ন করেন। উল্লেখ্য, গণতন্ত্রকে বলা হয় ‘আর্ট অব কম্প্রমাইজ’। এ ছাড়া, তিনি বহির্বিশ্বে ‘সকলের প্রতি বন্ধুত্ব এবং কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়’ নীতি অনুসরণ করেছেন। তার দৈশিক ও বৈশ্বিক নীতির ফলে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক সাহায্য ও অনুদান পায়। ফলে ‘তলাহীন ঝুড়ি’র বদনাম ঘুচে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ‘I shall make politics difficult’ কথাটিকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তার সমালোচনা করা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে তিনি দুর্নীতিবাজ, বাগাড়ম্বরকারী, শঠ ও সুবিধাবাদী রাজনীতিকদের প্রতি ইঙ্গিত করে এ কথা বলেছেন। ‘শত ফুল ফুটতে দেয়া’র নীতি এবং পরমতসহিষ্ণুতা ছিল তার বিশ্বাসের অঙ্গ, যার প্রমাণ মেলে বহুদলীয় গণতন্ত্রে এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ধারা পুনরুজ্জীবনে। যারা জিয়ার ওই উক্তির সমালোচনা করেন তারাই বিরোধী জোট বিশেষ করে চরম ও অব্যাহত দমনপীড়ন এবং মামলা-মোকদ্দমার মাধ্যমে বিএনপির জন্য রাজনীতি কঠিন করে ফেলেছেন।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদী এই নেতাকে ঘাতকের বুলেটে অকালে প্রাণ দিতে হলো। ১৯৮১ সালের এই দিনে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে তিনি শাহাদত বরণ করেন। বাংলাদেশে তার জানাজা মতো এত বড় জামাত আজ অবধি হয়নি। এটাই প্রমাণ করে, তার জনপ্রিয়তা হিমালয়ের চূড়ো ছুঁয়ে ফেলেছিল। তাই কবির ভাষায় বলতে হয়- নিঃশষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই।’ তার রুহের মাগফিরাত কামনা এবং তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। হ

লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার


আরো সংবাদ



premium cement

সকল