২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড - নয়া দিগন্ত

সঙ্ঘবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল জীবন, সব নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করাসহ জনজীবনে সার্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এমন ধারণা থেকেই রাষ্ট্রচিন্তার উন্মেষ ঘটে। আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তকেরা বিষয়টির আরো সাবলীল ও গতিশীল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ফলে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা হয়ে উঠেছে জনবান্ধব, সৃজনশীল ও কল্যাণমুখী। এ কথা অনস্বীকার্য, মানুষের প্রয়োজনেই রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে উঠেছে। কালের বিবর্তনে ও সময়ের প্রয়োজনে এই কাঠামোতে ক্রমবিবর্তন, পরিবর্তন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন ঘটেছে। বস্তুত মানব জীবনের সামগ্রিক কল্যাণই রাষ্ট্রের কাজ এতে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই।
আধুনিককালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, রাষ্ট্র প্রধানত দু’ ধরনের ভূমিকা পালন করে। নিয়ন্ত্রণমূলক ও কল্যাণমূলক। এ দু’ ধরনের ভূমিকার ভিত্তিতে আধুনিক রাষ্ট্রের কার্যাবলিকে দু’টি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যেমন, অপরিহার্য বা মুখ্য কার্যাবলি এবং কল্যাণমূলক বা ঐচ্ছিক কার্যাবলি। সার্বিক বিবেচনায় রাষ্ট্র কল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান, যার ব্যাপ্তি ও পরিসর সঙ্কীর্ণ বৃত্তে আবদ্ধ নয়, বরং সর্বব্যাপী ও সর্বজনীন। তাই রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে শ্রেণী তোষণ ও গোষ্ঠী তোষণের কোনো সুযোগ নেই। মূলত রাষ্ট্র একটি বৃহদায়তন সংগঠন। এই কার্যাবলিও বৃহৎ পরিসরের। আর আইনশৃঙ্খলা প্রতিটি রাষ্ট্রের প্রাণ।

রাষ্ট্রের প্রধান কাজই হলো ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন’ করা। সর্বোপরি নাগরিকেরা যাতে তাদের সব মৌলিক অধিকার নির্বিঘেœ ভোগ করতে পারে, তার নিশ্চয়তা বিধানের দায়িত্বও রাষ্ট্রের ওপর ন্যস্ত। রাষ্ট্র যদি এসব দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, তবে সে রাষ্ট্রকে সফল বলার কোনো সুযোগ থাকে না। মূলত রাষ্ট্রকে পুরোপুরি সফল করার দায়িত্ব সরকারের। তাই রাষ্ট্রের সফলতার সাথে সরকারের সফলতার বিষয়টিও ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। অবশ্য সরকারের নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও কর্মদক্ষতার ওপরই নির্ভর করে প্রতিটি রাষ্ট্রের সাফল্য-ব্যর্থতা।
রাজনৈতিক পক্ষেগুলোর ক্ষমতা রক্ষা ও আত্মপূজা যখন রাজনীতির ধ্যানজ্ঞান হয়ে ওঠে, তখন তাদের পক্ষে জনগণের জন্য সুশাসন উপহার দেয়া সম্ভব হয় না। বরং সেখানে স্থান করে নেয় অপশাসন ও দুঃশাসন। নাগরিকেরা প্রচলিত আইন ও সাংবিধানিক শাসন থেকে বঞ্চিত হন। ক্ষমতাসীনেরা ক্ষমতা রক্ষার জন্য এসবকে শুধু বৈধই মনে করে না, বরং তা তাদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় হয়ে ওঠে। আর আমাদের চারপাশে এমন অনাকাক্সিক্ষত দৃশ্যই প্রতিফলিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই আমাদের দেশে সুশাসনের সূচক বেশ নিম্মগামী হয়েছে। দেশে আইন ও সাংবিধানিক শাসনের দুর্বলতা জনজীবনকে একেবারে দুর্বিসহ করে তুলেছে। হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, গুম, অপহরণ ও গুপ্তহত্যা এখন অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ফলে দেশের মানুষ রাষ্ট্রের ওপর ক্রমেই আস্থা হারাচ্ছেন। এ কথা অজানা আতঙ্ক নাগরিকদের সবসময় তাড়া করছে। এই দুর্বিসহ অবস্থার মধ্যে স্থান করে নিয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। যা শুধু দেশে নয়, বরং বহির্বিশ্বেও আমাদের সব অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে, যা দেশে আইন ও সাংবিধানিক শাসনের প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখা হচ্ছে।

দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অনেক আলোচনা-সমালোচনা থাকলে সরকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হয় না এবং সরকারের দায়িত্বহীনতার কারণেই তা এখন রীতিমতো অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি জাতীয় একটি দৈনিকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১ জানুয়ারি থেকে চলতি এপ্রিল মাসের ১১ তারিখ পর্যন্ত ৪৮ জন মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। বছরের প্রথম তিন মাসেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৪২ জন মানুষ। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার জানায়, ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে ৪৪টি। যার বেশির ভাগকেই বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অন্য দিকে, আরেক মানবাধিকার সংস্থা ‘আইন ও শালিস কেন্দ্র’ সূত্রে জানা গেছে, তিন মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৪৬ জন মানুষ। যার মধ্যে ১৩ জন আটক হওয়ার পর নির্যাতনের কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছে, বাংলাদেশে বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের নামে প্রতি দুু’দিনে একজন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন। ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত হারেই এই ভয়ঙ্কর অপকর্মটি সংঘটিত হচ্ছে। মূলত এই ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটনার পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয় না বা এই বিষয়ে তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই যা তাদের আরো বেপরোয়া করে দিয়েছে। মূলত বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার কারণে আমাদের দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না। মহল বিশেষের নেপথ্যের পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই এমন সব গর্হিত কাজ বন্ধ হচ্ছে না, বরং ক্রমেই তা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। আসলে যারা এইসব হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছে, তারাই যে এই অপকর্মের নেপথ্যের শক্তি এতে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।
দেশের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বেশ সরব হলেও সরকার সেসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। এমনকি সরকারের পক্ষে দাবি করা হচ্ছে, বাংলাদেশে কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি। এগুলো সবই বন্দুকযুদ্ধ, যা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তা ছাড়া এ ধরনের প্রতিটি অভিযোগেরই তদন্ত হয়েছে। যারা এসব বন্দুকযুদ্ধের সময় উপস্থিত থাকে, তাদেরকে তদন্তের স্বার্থে একজন ম্যাজিস্ট্রেট দীর্ঘসময় নিয়ে জেরাও করে থাকেন। কিন্তু ঘটনার ধারাবাহিকতা ও প্রেক্ষাপট সরকারের এই দাবির পক্ষে যায় না, বরং রাজনৈতিক মহলে অভিযোগ আছে, সরকার বিরোধী মহলে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য পরিকল্পিতভাবে এসব কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার মাধ্যমে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সরকার রাজনৈতিক বিরোধীদের অভিযোগ খণ্ডনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এ বিষয়ে সরকারের সরকারের সব কর্মকাণ্ডই একেবারে দায়সারা গোছের। যা সরকারের দায়িত্বহীনতার পরিচয় বহন করে।

মানবাধিকার কমিশন অবশ্য ২০০৯ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ ধরনের প্রতিটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে তদন্ত করার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করেছিল। তৎকালীন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি আমিরুল কবির সেই প্রতিবেদন প্রকাশের সময় এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছিলেন ‘প্রতিটি ঘটনাই অন্তত তিন সদস্যের পৃথক তদন্ত কমিটি দিয়ে তদন্ত করা উচিত। এই তিনজন সদস্যের একজন ন্যূনতম উপসচিব পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা হওয়া বাঞ্ছনীয়। আরেক সদস্য হবেন পুলিশের এসপি সমমর্যাদার এবং তৃতীয় সদস্য হবেন সিভিল সোসাইটির কোনো প্রতিনিধি, যাকে ভিকটিম পরিবারের সদস্যরা পছন্দ করে দেবেন। আজ পর্যন্ত অবশ্য সেই সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে সরকারের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অন্য দিকে, ২০০৬ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত হাইকোর্ট এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তিন দফা রুল ইস্যু করেছিল যা অদ্যাবধি মীমাংসিত হয়নি। বেশ কয়েকদফা হাইকোর্ট সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং র‌্যাবকে কারণ দর্শাতে বলেছিলেন- কেন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে তারা অবৈধ ঘোষণা করবেন না। কিন্তু এগুলোর কোনোটা দিয়েই আসলে কোনো কাজ হয়নি। সাম্প্রতিক সময় অবশ্য পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে।

মূলত আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রের কার্যাবলি ও দায়িত্ব বেশ বিস্তৃত। কিন্তু রাষ্ট্রচিন্তকেরা আধুনিক রাষ্ট্রে আইনশৃঙ্খলার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। কারণ, আইনশৃঙ্খলায় প্রতিটি রাষ্ট্রের সাফল্যের মাপকাঠি। আর এম ম্যাকাইভার তার ''The Modern State' গ্রন্থে বলেছেন,‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা রাষ্ট্রের প্রাথমিক কাজ বা দায়িত্ব।’ নাগরিকদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার নিশ্চয়তা থেকে রাষ্ট্র নামক সংগঠনের সৃষ্টি হয়। জনসাধারণকে আইন মেনে চলতে বাধ্য করা, আইন ভঙ্গকারীদের শাস্তির বিধান করা এবং সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা রাষ্ট্রের প্রধান কাজ। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্র স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে থাকে। সব রাষ্ট্র আইন ও সংবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে স্বেচ্ছাচারি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কোনো গণতান্ত্রিক ও সভ্যসমাজে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ, সব রাষ্ট্রই সংবিধিবদ্ধ আইন দিয়েই পরিচালিত হয়। তাই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ যেকোনো আইনবহির্ভূত কাজ রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার পরিচয় বহন করে এবং রাষ্ট্রের উপস্থিতিকে অস্বীকার করে। কারণ, সার্বভৌমত্বও আইন ও সংবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে উড্রো উইলসন বলেন, A state is a people organized for law within a definite territory.’ অর্থাৎ কোনো নির্দিষ্ট ভূ-ভাগের মধ্যে আইনের মাধ্যমে সংঘঠিত জনসমূহকে রাষ্ট্র বলে’। তাই রাষ্ট্রকে সফল ও সার্থক করতে হলে আইন ও সাংবিধানিক শাসনের কোনো বিকল্প নেই।


আরো সংবাদ



premium cement