২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে আসিয়ান মন্ত্রীদের বৈঠকে অস্পষ্টতা

জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্থোনিও গুতেরেস -

গত বছর ডিসেম্বরে মিয়ানমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর আঞ্চলিক জোট আসিয়ানকে সাথে নিয়ে ধাপে ধাপে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে। তবে শুক্রবার থাইল্যান্ডে শেষ হওয়া আসিয়ানের দুই দিনের বৈঠক থেকে প্রত্যাবাসন নিয়ে সুস্পষ্ট করে কিছু জানানো হয়নি। বৈঠক থেকে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা সঙ্কটের নেপথ্য কারণ উদঘাটন করে বাস্তুচ্যুতদের ফিরিয়ে নেয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে। জানানো হয়েছে, প্রত্যাবাসন উদ্যোগে সহায়তা দিতে আসিয়ানের যে প্রতিনিধিদলের রাখাইনে যাওয়ার কথা ছিল, ‘অস্থিতিশীল পরিস্থিতি’র অবসান না হলে তারা সেখানে যাবেন না। ঠিক করে নাগাদ প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়া শুরু হবে, তার দিনক্ষণও জানাতে পারেনি তারা।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সন্ত্রাসবিরোধী শুদ্ধি অভিযানের নামে শুরু হয় সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূল অভিযান। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার মানবতাবিরোধী অপরাধ সঙ্ঘটিত হতে থাকে ধারাবাহিকভাবে। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে রাখাইন ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয় প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা।
১,থ৭ ও ১৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে আসিয়ানের পক্ষ থেকে বলা হয়, মিয়ানমারের উচিত রোহিঙ্গা সঙ্কটের মূল কারণ খুঁজে বের করা এবং তার সমাধানে সহযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করা, যাতে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফিরে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে পারে। আসিয়ানের বর্তমান সভাপতি রাষ্ট্র থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডন প্রামুদিনি সমাপনী সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে আসিয়ান জাতিসঙ্ঘের কাছে সহযোগী হওয়ার প্রস্তাব পাঠিয়েছে।
২০১৮ সালের নভেম্বরে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত আসিয়ান সম্মেলনের আলোচনায় প্রাধান্য পায় রোহিঙ্গা সঙ্কট। ডিসেম্বরে মিয়ানমার সফরে যান আসিয়ানের মহাসচিব। সংস্থাটির পক্ষ থেকে ‘নিডস অ্যান্ড অ্যাসেসমেন্ট টিম’ নামে একটি প্রতিনিধিদল পাঠানোর ব্যাপারে নেপিদোর সাথে তাদের আলোচনা হয়। সে সময় সু চি সরকারের সমাজ কল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসনবিষয়ক মন্ত্রী ইউ উইন মিয়াত আইমিয়ানমার জানিয়েছিলেন, আসিয়ানের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে ৭ লাখেরও বেশি শরণার্থী প্রত্যাবর্তন পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করবে।
কথা ছিল ১২ জানুয়ারি থেকে ২৬ জানুয়ারি আসিয়ানের ওই টিম রাখাইনে থেকে সেখানকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করবে। তবে সেখানের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে কারণ দেখিয়ে সেই সফর স্থগিত রাখা হয়েছে। সম্মেলনে থাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, কেবল তখনই ওই কাজ শুরু করা সম্ভব, যখন রাখাইনে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিরাজ করবে। প্রত্যাবাসনের জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নেই বলে স্বীকার করেছেন তিনি। আসিয়ানের ‘মানবিক সহায়তা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র-এএইচএ’ থেকে রাখাইনে প্রতিনিধিদল পাঠানোর ব্যাপারে জোর দেয়া হয়েছে। ডন প্রামুদিনি আশা প্রকাশ করেন, এএইচএ মিয়ানমার সরকারকে তাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করবে। আমাদের আশা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এটি সম্ভব হবে।
ডন প্রামুদিনি বলেন, প্রত্যাবাসন নিয়ে সুনির্দিষ্ট সময়সীমা না থাকলেও রাখাইনবাসীর কল্যাণে প্রত্যেক আসিয়ান দেশ তাদের নিজেদের মতো করে বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে। রাখাইনকে প্রত্যাবাসনে প্রস্তুত করার পাশাপাশি সেখানকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বার্থে বেশ কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে তারা। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে স্কুল প্রতিষ্ঠা ও চালের মিল স্থাপনসহ কৃষিভিত্তিক উন্নয়নের কথা ভাবছে আসিয়ানের সদস্য দেশগুলো।
শত শত ধরে রাখাইনে বসবাস করে এলেও ’৮০-এর দশকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে মিয়ানমার। মিয়ানমারের অধিবাসী হলেও রোহিঙ্গাদের বেশির ভাগ রাখাইন বৌদ্ধ বাংলাদেশ থেকে সেখানে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী বলে দাবি করে থাকে। উগ্র বৌদ্ধবাদকে ব্যবহার করে সেখানকার সেনাবাহিনী ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে স্থাপন করেছে সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাসের চিহ্ন। বিদ্বেষী প্রচারণার মধ্য দিয়ে রাখাইনের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সেখানকার রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ ঘৃণার চাষাবাদ করেছে দীর্ঘ দিন। বিদ্বেষের শেকড় তাই দিনকে দিন আরো শক্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের সাম্প্রতিক অনুসন্ধান অনুযায়ী, সেনা নিধনযজ্ঞের শিকার হয়ে ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পর তাদের জায়গাজমিতে বৌদ্ধ পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে রাখাইনকে রোহিঙ্গা শূন্য করা হচ্ছে।
হতাশ জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব
রয়টার্স জানায়, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নৃশংস গণহত্যা ও জাতিগত নির্র্মূল অভিযানের শিকার হয়ে রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের ভূমিকা অত্যন্ত ধীরগতির বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্থোনিও গুতেরেস। যে অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল তা না হওয়ার কারণে হতাশা ব্যক্ত করেছেন তিনি। শুক্রবার নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘের সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেছেন মহাসচিব।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। শুরু হয় সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূল অভিযান। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে রাখাইন ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয় প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা। এদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের একটি সমঝোতা হয়েছে। পরে জাতিসঙ্ঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার সাথেও রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার বিষয়ে সহযোগিতার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে মিয়ানমার। কিন্তু এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়া হয়নি।
সংবাদ সম্মেলনে রয়টার্সের সাংবাদিক মহাসচিবের কাছে জানতে চান, সঙ্কট শুরুর দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো উল্লেখযোগ্য শরণার্থী রাখাইনে ফেরত যায়নি। নিরাপত্তা পরিষদ পরিস্থিতি মোকাবেলার বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছে। মিয়ানমারের ডি ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সু চির সাথে এ বিষয়ে সর্বশেষ কবে কথা হয়েছে? সু চিকে কী বলেছেন তিনি?
এ প্রশ্নের জবাবে মহাসচিব বলেন, সর্বশেষ কথা বলার পর বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে গেছে। আমার কথা সব সময়েই এক। আস্থা ও বিশ্বাসের পরিবেশ সৃষ্টির গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। এটা যে শুধু ‘ফিজিক্যাল’ পুনর্গঠনের বিষয় তা নয়, এটা হলো সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে পুনর্জাগরণের বিষয়। সরকারের শক্তিশালী প্রতিশ্রুতির বিষয়, যেটা হলো সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে যতটা সম্ভব পুনরেকত্রীকরণ ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিরাপত্তা দেয়া।
মহাসচিব হতাশা প্রকাশ করে বলেন, কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য হলো, পরিস্থিতি যেমন হওয়ার কথা ছিল এখনো তেমন হয়নি। বিশেষ করে, চরম, অত্যন্ত চরম অবস্থার মধ্যে এখন বাংলাদেশে বসবাস করছেন এ সম্প্রদায়ের বিপুলসংখ্যক মানুষ। আমি তাদের ভুলে যেতে পারি না।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement