১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

তিউনিসিয়ায় আরব বসন্তের ৮ বছর : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

-

মধ্যপ্রাচ্যে আলোচিত আরব-বসন্তের একমাত্র সাফল্য হিসেবে তিউনিসিয়ার নাম উল্লেখ করা হয় এবং এর ভালো কিছু কারণও রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২০১১ সাল থেকে উত্তর আফ্রিকার এ দেশটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনে অংশ নেয়া, মেয়াদ শেষে শান্তিপূর্ণভাবে নেতাদের ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়া এবং উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারীদের সমান অধিকার প্রদানের আইন করা, ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু আরব বসন্তের আট বছরের মাথায় এসেও তিউনিসিয়া সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। অথচ সমাজের এসব সমস্যা দূর করার দাবিতেই তিউনিসিয়ায় সর্বপ্রথম শুরু হয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যের গতি-প্রকৃতি পাল্টে দেয়া অভূতপূর্ব এ আন্দোলন। দেশটির অর্থনৈতিক দুর্বলতা আরব বসন্তের সেই সাফল্য পুরোপুরিভাবে উপভোগ করতে দেয়নি।
কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক লারবি সাদিকি বলেন, রাজনৈতিক পর্যায়ে যে নাটকীয় রূপান্তর ঘটেছিল তা অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে প্রতিফলিত হয়নি। কারণ প্রথমত, ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া এ আন্দোলন থেকে প্রাতিষ্ঠানিক স্থানান্তরের পথটি মসৃণ ছিল না এবং দ্বিতীয়ত, তিউনিসিয়দের এ ত্যাগের ফলে দেশটির কিছু কিছু অঞ্চলমাত্র এর ফল ভোগ করতে সক্ষম হয়।
২০১১ সালে আরব বসন্তের আগে বেন আলীর বাজেটে দেশের অভ্যন্তরীণ অংশের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল ১৮ শতাংশ। বাকি ৮২ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছিল উত্তরাঞ্চলের উপকূলীয় শিল্প শহরগুলোর জন্য। দীর্ঘ দিন ধরেই উত্তরাঞ্চলীয় শিল্প এলাকা এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় গ্রাম এলাকায় এ ধরনের বৈষম্য অব্যাহত ছিল। বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে সংবিধানে এ বৈষম্য কিছুটা হ্রাস করা হয়। ফলে বঞ্চিত এলাকাগুলো কিছুটা উন্নয়নের ছোঁয়া পেয়েছিল। কিন্তু তার পরও বিদ্যমান বৈষম্য, ব্যাপক বেকারত্ব এবং সরকারগুলোর ধারাবাহিক ব্যর্থতা তিউনিসিয়দের আবারো রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছে।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় শহর ক্যাসেরাইনে বেকার একজন ফটোসাংবাদিক নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করতে চাইলে অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতার বিষয়টি আবারো সবার নজরে আসে। গত মাসে মারা যাওয়ার পূর্বে ফেসবুকে এক ভিডিওবার্তায় আবদুল রাজ্জাক জরগুই নামের ৩২ বছরের ওই যুবক বলেন, আমি নিজেকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে গিয়েছিলাম। আমরা ক্যাসেরাইনে বসবাসকারীরা কি মানুষ নই? এই শহরে কী হচ্ছে, তা নিয়ে সরকারের আগ্রহ থাকা উচিত। ২০১১ সালে জরগুইয়ের মতোই মোহাম্মদ বুয়াজিজ নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে দিলে তা থেকেই সূত্রপাত্র হয়েছিল আরব বসন্তের।
সহজ কোনো সমাধান নেই
কার্নেগির মধ্যপ্রাচ্য প্রোগ্রামের ফেলো সারাহ ইয়ার্কস বলেন, তিউনিসিয়ার সরকার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে কিছু নীতি বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। ২০১৪ সালে প্রণীত সংবিধানের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই হচ্ছে বৈষম্যের ইতিবাচক ধারণা, যাতে ঐতিহ্যগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। তবে এর জন্য যে বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়ন করা আবশ্যক সেটি বেশ কয়েকবার পিছিয়ে গেছে। ইয়ার্কস বলেন, এটি বাস্তবায়নে যে তহবিল ও জনবল দরকার তাতে বেশ ঘাটতি রয়েছে।
এ দিকে বিকেন্দ্রীকরণ নিয়েও বেশ প্রশ্ন রয়েছে। কারণ এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ঋণদাতারা লোকসানে পড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ছেড়ে দেয়া, সরকারি কর্মচারীদের বেতন কমানোসহ যেসব শর্তজুড়ে দিচ্ছেন, সেগুলো বাস্তবায়ন করা সরকারের পক্ষে কতটুকু সম্ভব তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। যেমন রফতানি বৃদ্ধির উৎসাহ দিতে তিউনিসিয়ার দিনারের দর কমানোর অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় দেশটির বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। কারণ তিউনিসিয়ার খাদ্য ঘাটতি পূরণে বিদেশ থেকে প্রচুর খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়। ফলে প্রথম আট মাসে দেশটির আমদানি বিল আগের বছরের চেয়ে ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। একই সময়ে বেতন বৃদ্ধির দাবি পূরণ না হলে তিউনিসিয়ার প্রভাবশালী ইউজিটিটি শ্রমিক ইউনিয়ন দেশজুড়ে ধর্মঘটের হুমকি দেয়। সব মিলিয়ে সেখানে অর্থনীতি বড় একটি সমস্যা হয়ে উঠেছে। ২০১৮ সালে দেশটির বাণিজ্য ঘাটতি ৬৪৪ কোটি ডলারে গিয়ে পৌঁছে।
বড় সমস্যা রাজনৈতিক
আরব বসন্ত যেখানে অন্য দেশগুলোকে বেশ ভুগিয়েছে, সেখানে তুলনামূলক বড় ধরনের সঙ্ঘাত এড়াতে সক্ষম হয়েছে তিউনিসিয়া। এর ফলে একে অন্য আরব দেশগুলোর জন্য মডেল হিসেবে দেখা হয়েছে। ২০১১ সালে বেন আলিকে উৎখাতের পর বেশ কিছু আইনি ও রাজনৈতিক বাধা পেরিয়ে গত বছরের মে মাসে তিউনিসিয়রা প্রথমবারের মতো অবাধে পৌর নির্বাচনে ভোট দেয়।
তবে এত কিছুর পরও সেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে কয়েকটি নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে, দেশটির মূল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধের কারণে সেখানকার গণতন্ত্র হুমকির মুখে রয়েছে। পাশাপাশি লেবানন সীমান্তে সন্ত্রাস ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে এ সঙ্কট আরো গভীর হচ্ছে। এ অবস্থায় যদি অভ্যুত্থান বা তৃতীয় কোনো পক্ষের মাধ্যমে তিউনিসিয়ার রাজনৈতিক সমাধানের পথ খুঁজতে হয় তাহলে দেশটিতে আবারো বড় ধরনের একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
সূত্র : আলজাজিরা ও ডেইলি সাবাহ


আরো সংবাদ



premium cement