২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

খাশোগি হত্যার দায় স্বীকার অতঃপর হত্যার নির্দেশদাতা

-

অক্টোবরের ২ তারিখে ইস্তাম্বুলের সৌদি কন্স্যুলেট থেকে নিখোঁজ হয়ে যান সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগি। প্রথম বেশ কিছু দিন ধরে সৌদি কর্তৃপক্ষ খাশোগির নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটিকে একরকম উপেক্ষাই করে চলছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা স্বীকার করে যে খাশোগি নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন সৌদি কন্স্যুলেটেই। এখন পর্যন্ত তারা এ ঘটনায় অভিযুক্ত হওয়া থেকে যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানকে আড়াল করেই রেখেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ জানিয়েছে, তারা স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, মুহাম্মদ বিন সালমানই সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছানির্বাসিত জামাল খাশোগি ছিলেন সৌদি সরকারের কঠোর সমালোচক। ওয়াশিংটন পোস্ট ছাড়াও ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক অনুষ্ঠানগুলোতে কন্ট্রিবিউটর হিসেবে কাজ করতেন খাশোগি। তিনি একসময় সৌদি রাজপরিবারের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন।
২ অক্টোবর খাশোগি তার বাগদত্তা হ্যাতিস সেনগিজকে বিয়ে করতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করার জন্য তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কন্স্যুলেটে গিয়েছিলেন; কিন্তু অনেকক্ষণ পরও খাশোগি বের না হলে বাইরে অপেক্ষারত হ্যাতিস তুরস্কের উচ্চপর্যায়ের কিছু ব্যক্তিকে বিষয়টি জানান।
বিভিন্ন প্রমাণের ভিত্তিতে তুরস্ক প্রথম থেকেই বলে আসছিল, খাশোগিকে ১৫ সদস্যের একটি সৌদি দল হত্যা করেছে; কিন্তু রিয়াদ দাবি করেছিল, খাশোগি ওই দিনই কন্স্যুলেট ভবনে কাজ সেরে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ফলে এ ব্যাপারে তাদের আর কোনো দায় নেই। তবে তুরস্ক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত চাপের মুখে কয়েক দফায় সৌদি কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে যে, কন্স্যুলেট ভবনে ওই দিনই খাশোগি খুন হন এবং তার লাশ টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়।
বৈপরীত্যে ভরা বিবৃতি
খাশোগি নিখোঁজ হওয়ার দিন থেকেই বিপরীতমুখী বিবৃতি দিয়ে আসছে রিয়াদ। প্রথমে যেখানে তারা খাশোগির কন্স্যুলেট ছেড়ে যাওয়ার দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিল, সেখানে আন্তর্জাতিক চাপ ও তুরস্কের দেয়া প্রমাণের কারণে ২০ অক্টোবর তারা জানায়, খাশোগি ধস্তাধস্তিতে জড়িয়ে মারা গেছেন। নিহত হওয়ার দেড় মাস পার হওয়ার পর তারা আরেক বিবৃতিতে স্বীকার করে, প্রাণঘাতী ইঞ্জেকশন পুশ করে তাকে হত্যা করা হয় এবং টুকরো টুকরো করে তাকে কন্স্যুলেটের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়।
বের হওয়ার রেকর্ড নেই
খাশোগির বাগদত্তা শুরু থেকেই দাবি করে আসছিলেন, খাশোগি কন্স্যুলেট থেকে বের হননি। এ বিষয়ে যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানও বিবৃতিতে বলেন, কিছু সময় বা এক ঘণ্টা পরেই তিনি বের হয়ে গিয়েছিলেন; কিন্তু কোনো ক্যামেরাতেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তুর্কি কর্মকর্তারা কন্স্যুলেট ও কন্সাল জেনারেলের বাসভবনে তল্লাশি চালাতে চাইলেও সৌদি বেশ কিছু দিন পর এর অনুমতি দেয়। সৌদি আরব এ ব্যাপারে তাদের লুকানোর কিছু নেই বললেও তুর্কি কর্মকর্তারা জানান, কন্স্যুলেটের কিছু কিছু জায়গায় নতুন রঙ করা হয়েছে এবং বেশ কিছু স্থানে এসিডের নমুনা পাওয়া গেছে, যা খাশোগির লাশ নিশ্চিহ্নে ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে।
ধস্তাধস্তিতে নিহত
নিখোঁজ হওয়ার ১৮ দিন পর সৌদি স্বীকার করে খাশোগি কন্স্যুলেট ভবনেই নিহত হয়েছেন। তবে ধস্তাধস্তিতে জড়িয়ে পড়ার কারণেই খাশোগিকে এ পরিণতি ভোগ করতে হয়। তবে কোনোভাবেই এ হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত ছিল না। সৌদি আরব এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৮ জনকে গ্রেফতার করে এবং ঊর্ধ্বতন পাঁচ কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করে। তবে সৌদির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল জুবের জানান, যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান কোনোভাবেই এ হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে জ্ঞাত ও দায়ী নন।
পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড
তুরস্ক অব্যাহতভাবে দাবি জানাতে থাকে, তাদের কাছে যেসব প্রমাণ রয়েছে তাতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, এটি ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কয়েক দফা অস্বীকার করার পর রিয়াদ ২৫ অক্টোবর এসে স্বীকারোক্তি দেয় যে, খাশোগি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
স্থানীয় সহযোগীর তথ্য নেই
প্রথম দিকে সৌদির প্রধান কৌঁসুলির কার্যালয় থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছিল, এ হত্যাকাণ্ডের সাথে স্থানীয় এক সহযোগী জড়িত আছে। খাশোগির লাশ টুকরো করার পর তা স্থানীয় সহযোগীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল; কিন্তু পরবর্তী সময়ে তুর্কি কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকের সময় রিয়াদ আগের বিবৃতি অস্বীকার করে জানায়, স্থানীয় সহযোগীর কথা কোনো বিবৃতিতে বলা হয়নি।
যে প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা
রিয়াদের স্বীকারোক্তির মাধ্যমে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলেও এ হত্যার নির্দেশদাতা কে, খাশোগির লাশ কোথায় এবং স্থানীয় সহযোগী কেÑ এসব প্রশ্নের উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি। তবে গতকাল মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ জানিয়েছে, সৌদি যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমানই খাশোগিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন বলে মনে করছেন। তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তারা এ উপসংহারে পৌঁছেছে।

 

যেভাবে খাশোগি হত্যার দায় স্বীকার
তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কন্স্যুলেটে নিহত হয়েছিলেন জামাল খাশোগি। প্রথমে পুরোপুরি অস্বীকার করলেও শেষ পর্যন্ত তাকে হত্যার কথা স্বীকার করে সৌদি কর্তৃপক্ষ।
খাশোগিকে হত্যার দেড় মাস পর তুরস্কসহ আন্তর্জাতিক চাপ ও প্রমাণের মুখে রিয়াদ স্বীকার করে, খাশোগিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং কন্স্যুলেটের মধ্যেই তাকে টুকরো টুকরো করা হয়।

অস্বীকার
অক্টোবর ৫

খাশোগির হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি অস্বীকার করে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান জানান, খাশোগি জীবিত অবস্থায়ই কন্স্যুলেট থেকে বেরিয়ে গেছেন।

প্রথম স্বীকারোক্তি
অক্টোবর ২০

পরে রিয়াদ স্বীকার করে খাশোগি কন্স্যুলেটের মধ্যেই মারা গেছেন। ধ্বস্তাধ্বস্তির একপর্যায়ে তিনি নিহত হন। কোনোভাবেই ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত ছিল না।

দ্বিতীয় স্বীকারোক্তি
অক্টোবর ২৫

সৌদি আরবের প্রধান কৌঁসুলি সৌদ আল মুজিব বলেন, তুরস্ক থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বোঝা যাচ্ছে, এটি একটি পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।

অক্টোবর ২

ইস্তাম্বুলে সৌদি কন্স্যুলেটে প্রবেশের পর থেকে খাশোগি নিখোঁজ।

অক্টোবর ৩১

প্রথম দিকে সৌদি আরব গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল, এ হত্যাকাণ্ডের সাথে স্থানীয় এক সহযোগী জড়িত আছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তুর্কি কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকের সময় আগের বিবৃতি অস্বীকার করে জানায়, স্থানীয় সহযোগীর কথা কোনো বিবৃতিতে বলা হয়নি।

তৃতীয় স্বীকারোক্তি
নভেম্বর ১৫

রিয়াদ এক স্বীকারোক্তিতে জানায়, লাশকে কন্স্যুলেটের মধ্যেই টুকরা টুকরা করা হয়েছে। সৌদি কৌঁসুলি জানান, খাশোগিকে বাঁধা হয়েছিল এবং বিষাক্ত ইঞ্জেকশন পুশ করে তাকে হত্যা করা হয়। পরে লাশ টুকরো টুকরো করে স্থানীয় সহযোগীর হাতে হস্তান্তর করা হয়।

আনাদোলু অবলম্বনে

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল