২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চীনে নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে উইঘুর শিশুরা

উইঘুরের এই হাসিখুশি মুসলিম শিশুরা হারিয়ে যাচ্ছে :ইন্টারনেট -

চীনের পশ্চিমাঞ্চলের জিনজিয়াং প্রদেশের ১০ লাখ বয়স্ক উইঘুর মুসলিমকে বন্দী শিবিরে আটক রাখার পর চীনা কর্তৃপক্ষ উইঘুর শিশুদের ধরে নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালিত অসংখ্য এতিমখানায় পাঠাচ্ছে। অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিশুরাও তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। মুসলিম শিশুদের তাদের পরিবার, ধর্ম ও সংস্কৃতি থেকে দূরে রাখার চীনের সুপরিকল্পিত অপতৎপরতার সর্বশেষ প্রমাণ হিসেবে এসব এতিমখানার কথা প্রকাশ পেলো। উইঘুর মুসলমানেরা আশঙ্কা করছেন, তাদের জাতিগত পরিচিতিকে মুছে ফেলার গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই এক সন্তান গ্রহণ নীতিসহ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী কমিউনিস্ট চীন সরকার এসব অপতৎপরতা চালাচ্ছে।

কোরবানির ঈদের সময় এপির প্রতিনিধি ইস্তাম্বুলে বহু উইঘুর পরিবারের সাথে কথা বলেন। এ দিন বড় পরিবারগুলোর পুনর্মিলনী ঘটে। প্রতিটি বাড়ির খাবার টেবিলগুলো জিনজিয়াংয়ের ঐতিহ্যবাহী নানা খাবারে পরিপূর্ণ থাকে। এর মধ্যে থাকে বাড়িতে তৈরি নুডুলস, সদ্য জবাই করা ভেড়ার গোশতের তরকারি এবং নানরুটি। সরকারের বন্দিত্ব এড়াতে যেসব উইঘুর ইস্তাম্বুলে পালিয়ে আসেন তারা যেসব সন্তানকে দেশে রেখে এসেছিলেন সরকার তাদের ধরে নিয়ে গেছে। এভাবে সরকার পরিবারগুলোকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে।

যাদের সাথে সাক্ষাৎ হয় তাদের অনেকে তাদের পূর্ণ নাম জানাতে রাজি হননি, কারণ এতে জিনজিয়াংয়ের দণিাঞ্চলের হোতান শহরে এখনো অবস্থান করছেন তাদের এমন স্বজনেরা সরকারে রোষানলে পড়তে ও প্রতিহিংসার শিকার হতে পারেন। ডাক্তার আজিজ এই শহরে নিজস্ব মেডিক্যাল কিনিক পরিচালনা করতেন। ৩৭ বছর বয়স্ক এই সার্জন বলেন, তিনি একটি নতুন কার কিনতে যাচ্ছিলেন এমন সময় স্থানীয় থানা থেকে একটি ফোন আসে। তাতে তাকে অবিলম্বে সেখানকার কর্তৃপক্ষের সাথে দেখা করার নির্দেশ দেয়া হয়। ইতোমধ্যে আজিজের প্রতিবেশীদের অর্ধেককেই নয়াদীক্ষা কেন্দ্র বা বন্দী শিবিরে নিয়ে আটক করা হয়েছে। তিনি তাদের মতো বন্দী শিবিরে ধুঁকে ধুঁকে মরার পরিণতি ভোগ করতে চাইলেন না।
ফোনটি বন্ধ করে তিনি সরাসরি বিমানবন্দরে চলে যান। তিনি এ কথা কাউকে, এমনকি তার স্ত্রীকেও জানাননি। কারণ তার সাথে যারাই যোগাযোগ করেছে বলে জানতে পারবে কর্তৃপক্ষ তাদের সবাইকেই আটক করবে। অনেক উইঘুরের মতো সম্প্রতি বছরগুলোতে তিনি চীন থেকে পালিয়ে আসেন। আজিজ ভেবেছিলেন কেবল রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত হওয়া পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এক বছর পার হওয়ার পরও অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি, এখনো তিনি অপেক্ষার পথ চেয়ে রয়েছেন। আজিজ বলেন, তার স্ত্রী ও চার শিশু সন্তানের কোনো খোঁজ এখনো পাননি। তার সন্তানদের মধ্যে চার বছরের একটি ছেলে রয়েছে, যার নাম ইব্রাহীম।

হোতানের একজন তরুণ নার্সিং শিক্ষার্থী হিসেবে মেরিপেত ভালো ফল করেন এবং সহজে লাইসেন্স লাভ করেন। বিয়ের আগ পর্যন্ত তিনি একটি বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করতেন এবং এরপর সন্তানদের মানুষ করার জন্য তার সবকিছু নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেন। মেরিপেতের লক্ষ্য ছিল তার সন্তানদের ‘মানুষের মতো মানুষ’ হিসেবে গড়ে তুলবেন। তিনি যখন তার ছেলেকে নিয়ে স্কুলে যেতেন তখন সেই সুযোগে তাকে কিভাবে সৎ কাজ করতে ও সৎ জীবনযাপন করতে হবে, কিভাবে পরিবারের ভালো করা যাবে, ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। মেরিপেতের বয়স এখন ২৯ বছর। তিনি বলেন, বাড়িতে তারা সফল মুসলিমদের জীবনী ও তাদের লেখা বইপত্র পড়তেন। মেরিপেত আরো বলেন, ‘ তাদের সাথে কাটানো আমার প্রতিটি মুহূর্তের কথা স্পষ্ট স্মরণে রয়েছে।’

এবারের কোরবানির ঈদে মেরিপেত তার ছোট ছেলের জন্য একটি ডেনিম জিন্স ডোরা কাটা একটি ভেস্ট এবং সবুজ ও রৌপ্য রঙয়ের একটি বোটাই কেনেন। ঈদ উৎসবকে সামনে রেখেই এ কেনাকাটা করেন তিনি। কিন্তু বড় কষ্টের মধ্যে সান্ত্বনা হলো, মেরিপেতের ছোট ছেলে এক বছর বয়েসী আব্দু ওয়ালিই কেবল তুরস্কে তার কাছে রয়েছে। বড় অন্য চার সন্তানকে তিনি আর কখনো দেখতে পারেননি। তার বিশ্বাস, চীনের রাষ্ট্র পরিচালিত এতিমখানাগুলোতেই তারা আছে। মেরিপেত বলেন, ‘আল্লাহ যদি আমাকে একটি বার তাদের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দেন, তাহলে তাদের সাথে আমার অনেক কথা বলার আছে। তবে ওদের সাথে আমার সবচেয়ে বড় কথা হবে, ‘আমি দুঃখিত’।’

জিনজিয়াংয়ের উত্তরাঞ্চলের কারামে শহরে রেস্তোরাঁর মালিক কুরবানজান নুর মোহাম্মাদ ও গুলজান মাহমুদ। তাদের বড় ছেলের খবর জানার অর্থ হচ্ছে প্রতারণার কাছে নতিস্বীকার করা। কোরবানজান ও মাহমুদের পুরো পরিবার তাদের পাঁচ সন্তানসহ ২০১৫ সালে ইস্তাম্বুলে চলে আসেন। কিন্তু ২০১৬ সালের প্রথম দিকে অসুস্থ দাদাকে দেখতে তার বড় ছেলে ১৬ বছর বয়েসী পাকজাত কুরবান জিনজিয়াংগামী একটি ফাইটে ওঠে। পাকজাত পরিবারের জন্য গর্ব ছিল। সে দেখতে অত্যন্ত সুন্দর ও একজন এথলেট ছিল। সে ক্যালিয়োগ্রাফি ও মুষ্টিযুদ্ধে বেশ পারদর্শী ছিল। নিজ শহরে এই দু’টি বিষয়েই প্রতিযোগিতায় সে সেরা হয়েছিল।

তার বাবা-মা জানান, উরুমকি বিমানবন্দরে পৌঁছার পরই পাকজাতকে গ্রেফতার করে কর্তৃপক্ষ। ছেলেটি নিখোঁজ হওয়ার দুই মাস পরে এক ব্যক্তি নিজেকে কারামে’র পুলিশ কর্মকর্তা বলে দাবি করে চীনা ম্যাসেজ আপে নুর মোহাম্মাদের সাথে যোগাযোগ করেন। গত তিন বছর ধরে তিনি তার ছেলের ছবি ও বর্তমান অবস্থার খবর দিচ্ছেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যদি তুরস্কে অবস্থিত উইঘুরদের ওপর গোয়েন্দাগিরিতে সহযোগিতা করে তাহলে তিনি তাদের ছেলে সম্পর্কে তথ্য প্রদান অব্যাহত রাখবেন। নুর মোহাম্মাদ বলেন, এই সূত্র এবারের কোরবানি ঈদের আগে একটি ভুতুড়ে বার্তা পাঠায়, ‘আমি আপনার ছেলের সাথে সম্প্রতি কথা বলেছি। সে প্রায়ই আমার সাথে সাক্ষাৎ করে তার সুখ-দুঃখের কথা আমাকে জানায়। এখন আমিই একমাত্র যাকে আপনার ছেলে বিশ্বাস করে ও ভালোবাসে। তাই আপনারা আমার সাথে সহযোগিতা করুণ।’
আদিল বলেন, তার ছেলে এখন কাশগড়ের একজন ব্যবসায়ী হওয়া সত্ত্বেও সে এখন তার জীবন থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। ২০১৪ সালে তার ৯ বছরের ছেলেকে আবাসিক স্কুলের তালিকাভুক্ত করা হয়। সে কেবল সপ্তাহান্তে বাড়িতে আসতে পারত। উইঘুর জেলার শিশুদের জন্য একমাত্র বিকল্প ছিল নতুন নির্মিত সরকারি আবাসিক স্কুল। কোনো বাবা-মা সন্তানকে ওই স্কুলে পাঠাতে না চাইলে আইন ভঙ্গ করার জন্য দায়ী হতেন এবং তা ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এরপর আদিল ও তার স্ত্রীকে বন্দী শিবিরে পাঠানো হয়। কাস বিরতির সময় একবার মাত্র তাদের ছেলেকে দেখার সুযোগ দেয়া হয়। সে সময় তাকে বেশ নার্ভাস দেখায়। স্কুলের লোহার দণ্ডগুলো চিড়িয়াখানার কথা মনে করিয়ে দেয়। আদিল ছেলেকে জিঙ্গেস করেন, তোমার স্কুল কেমন চলছে? পরে দারোয়ানের অনুমতি নিয়ে সে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে। আমি জানতে চাই, ‘তুমি কি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করতে পার?’ এ সময় ছেলেকে বেশ ভীত ও মন মরা দেখায়। আদিল জানতে চান, তিনি কি তার ছেলের শ্রেণিকক্ষে যেতে পারেন? তার ছেলে তাকে বলে, না তুমি যেও না। বাবা-মা’কে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয় না।

মা ও ছেলের জেল
হাল মুরাত ইদ্রিস ও তার স্ত্রী শেষরাত একত্রে কাটান। তার স্ত্রী গুলজার সেলি ও কোলের শিশুটি নিয়ে ইস্তাম্বুল থেকে সেলির মরণাপন্ন মাকে দেখতে জিনজিয়াং যান। ইদ্রিস তাকে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন কারণ তিনি শুনেছিলেন, বিদেশে যেসব উইঘুর রয়েছে তাদের সেখানে গেলেই গ্রেফতার করা হচ্ছে। কিন্তু সেলি তার মাকে দেখতে সেখানে যেতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। কারণ এরই মধ্যে তার বাবাকে হারিয়েছেন। অসুস্থ মার জন্য সেলি প্রায়ই কান্নাকাটি করতেন। এ ছাড়া তিনি যে গ্রেফতারির শিকার হবেন তা ভাবেননি।

সেলি ইদ্রিসকে বলেছেন, আমরা শিশুদের পালন করছি এবং একত্রে কাজ করছি। আমরা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির বিরোধিতা করতে পারি না।’ উরুমকি বিমানবন্দর থেকে সেলিকে গ্রেফতার করা হয়। কয়েকদিন পর তাকে ছেড়ে দেয়া হলেও পুলিশ সব সময় সব জায়গায় তাকে ফলো করত। সেলি ইদ্রিসকে বলেছিলেন, তিনি ইস্তাম্বুল ফিরে যাচ্ছেন না , কারণ সেখানে যাওয়ার মতো কোনো সময় তার হাতে নেই।

সেলি চীনে ফেরার এক মাস পরে নিখোঁজ হন। পরে ইদ্রিস জানতে পারেন, তাকে জেলে পাঠানো হয়েছে। তার ছেলেকেও তার সাথে জেলে রাখা হয়েছে। ইদ্রিস বলেন, এই নিষ্ঠুরতার কথা চিন্তা করলেই আমি অস্থির হয়ে পড়ি। এই পৃথিবীতে ওরা এসব কি করছে?
সূত্র : এপি ও ডেইলি স্টার, লেবানন।

 


আরো সংবাদ



premium cement