২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`
ইসরাইলবিরোধী পক্ষপাতের অভিযোগ

জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার পরিষদ ছাড়ল যুক্তরাষ্ট্র

মঙ্গলবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর সাথে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার পরিষদ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়ার সিদ্ধান্ত জানাচ্ছেন জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি ;এএফপি -

জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার পরিষদ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সংস্থাটির বিরুদ্ধে ‘নোংরা রাজনৈতিক পপাত’ ও ‘চরম ইসরাইলবিরোধী বলে অভিযোগ এনে মঙ্গলবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর সাথে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সুইজারল্যান্ডের জেনেভাভিত্তিক এ পরিষদ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়ার এই সিদ্ধান্তের কথা জানান জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি।
ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসরাইল নামের রাষ্ট্র। ১৯৭৬ সালের ৩০ মার্চ ইসরাইলের দণিাঞ্চলে ইহুদি বসতি নির্মাণের প্রতিবাদ করায় ছয় ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়। পরের বছর থেকেই ৩০ মার্চ থেকে ১৫ মে পর্যন্ত পরবর্তী ছয় সপ্তাহকে ভূূমি দিবস হিসেবে পালন করে আসছে ফিলিস্তিনিরা। গ্রেট রিটার্ন মার্চ নামে অনুষ্ঠিত এবারের সেই বিােভ কর্মসূচির শেষ দিনের আগে (১৪ মে) জেরুসালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরকে কেন্দ্র করে বিােভ জোরালো হয়ে উঠলে একদিনেই ৬৫ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে ইসরাইলি বাহিনী। ৪৭ সদস্যবিশিষ্ট জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার প্যানেল গত মাসে গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর ওই হত্যাযজ্ঞের তদন্তের পে অবস্থান নেয়। এ ছাড়া অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে একটি নিন্দা প্রস্তাব পাস হয়। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আর কমিশনের মধ্যকার বিরোধ স্পষ্ট হয়। অন্য দিকে ফিলিস্তিন ইস্যুতে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে তোলা নিজের প্রস্তাবে হেরে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোণঠাসা হয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। এ প্রোপটে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার পরিষদ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলো ট্রাম্প প্রশাসন।
জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার পরিষদকে ‘রাজনৈতিক পপাতিত্বের নর্দমা’ অ্যাখ্যায়িত করেন হ্যালি। ‘ভণ্ডামি ও নিজেদের সেবায়’ নিয়োজিত এ পরিষদ ‘মানবাধিকারের সাথে উপহাস করে আসছিল’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এ পরিষদকে ‘মানবাধিকার সুরায় খুবই দুর্বল সংস্থা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন পম্পেও। জাতিসঙ্ঘে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি হ্যালি এর আগে মানবাধিকার পরিষদকে ‘ইসরাইলবিরোধী ধারাবাহিক পপাতের’ দায়ে অভিযুক্ত করেছিলেন। পরিষদের সদস্য থাকা উচিত হবে কি না, যুক্তরাষ্ট্র তা পর্যালোচনা করে দেখছে বলেও গত বছর জানিয়েছিলেন তিনি। ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতিসঙ্ঘের এ পরিষদ নিয়ে অবশ্য আগে থেকেই সমালোচনা চলছিল। মানবাধিকার পরিস্থিতি প্রশ্নবিদ্ধ, এমন দেশগুলোকেও সদস্য করে নেয়ায় কমিশনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন আছে পশ্চিমা দেশগুলোর।
যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার এ ঘোষণা বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন পরিস্থিতির পর্যবেণ ও সেগুলোর সমাধানের প্রচেষ্টাকে তিগ্রস্ত করবে বলে আশঙ্কা করছেন মানবাধিকার কর্মীরা। মুখপাত্রের মাধ্যমে দেয়া এক বিবৃতিতে জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস যুক্তরাষ্ট্রকে পরিষদের সদস্য হিসেবে দেখতেই ‘বেশি পছন্দ’ করবেন বলে জানিয়েছেন। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিশনার জাইদ রাদ আল হুসেইন যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়া সিদ্ধান্তকে ‘হতাশাজনক খবর’ বলে অভিহিত করেছেন, তবে দেশটির এ সিদ্ধান্তে তিনি ‘বিস্মিত নন’ বলে জানিয়েছেন। ওয়াশিংটনের এ ঘোষণাকে ‘বিবেকবর্জিত’বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
ট্রাম্পের কঠোর অভিবাসন নীতিতে মেক্সিকো থেকে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা ব্যক্তিদের আটক করায় হাজার হাজার শিশু পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার পর বিষয়টি নিয়ে তীব্র সমালোচনার মধ্যেই মানবাধিকার পরিষদ থেকে দেশটির বেরিয়ে যাওয়ার এ ঘোষণা এলো।
যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য অনেক দিন থেকেই মানবাধিকার পরিষদের সংস্কারের বিষয়ে তাগিদ দিয়ে আসছিল। সংস্কার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দাবি-দাওয়া জাতিসঙ্ঘ না মানায় ট্রাম্প প্রশাসন মানবাধিকার পরিষদ থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বলে মানবাধিকার কর্মী ও কূূটনীতিকেরা জানিয়েছিলেন।
প্যারিস জলবায়ু চুক্তি এবং ইরানের সাথে স্বারিত পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে আসার পর এবার জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার পরিষদ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসাটা ট্রাম্পের চরম জোটবিমুখ মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
উল্লেখ্য, মানবাধিকার পরিষদে অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরাইলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি একেবারে নির্ধারিত স্থায়ী আলোচ্য বিষয় হিসেবে রাখা হয়েছে। ওয়াশিংটন চায় এ আলোচ্যসূচি বাদ দেয়া হোক।
গত বছর হ্যালি পরিষদের আলোচ্যসূচিতে ‘ইসরাইলের প্রসঙ্গ থাকলেও, ভেনিজুয়েলার প্রসঙ্গ না থাকায়’ বিস্ময় প্রকাশ করে, একে ‘তেল আবিববিরোধী পপাতদুষ্টতা’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। পপাত দূর করতে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি, এমনটি না হলে যুক্তরাষ্ট্র পরিষদ ত্যাগ করবে বলেও আভাস ছিল তার।
মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনের বদলে ২০০৬ সালে জাতিসঙ্ঘের এ পরিষদ গঠন করা হলেও তৎকালীন রিপাবলিকান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ এটি এড়িয়ে গিয়েছিলেন। ২০০৯ সালে ডেমোক্র্যাট বারাক ওবামা পরিষদে যোগ দেন। ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্র ফের এর সদস্য হয়।
পরের বছর চীন, রাশিয়া, সৌদি আরব, আলজেরিয়া ও ভিয়েতনামকে সদস্যপদ দেয় এ পরিষদ। ‘বিতর্কিত মানবাধিকার পরিস্থিতি বিদ্যমান’ এমন দেশগুলোকে সদস্যপদ দেয়ার সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করে পশ্চিমা দেশগুলো। পরিষদের কার্যকারিতা নিয়েও এর পর থেকেই প্রশ্ন তুলতে থাকে তারা। নিয়মানুযায়ী বছরে তিনবার বসে জাতিসঙ্ঘের সব সদস্য দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকে এ মানবাধিকার পরিষদ। সিরিয়া, উত্তর কোরিয়া, বুরুন্ডি, মিয়ানমার ও সাউথ সুদানের মতো দেশগুলোতে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে আলাদা কমিশন গঠন ও স্বতন্ত্র পর্যবেকও পাঠিয়েছে এ পরিষদ।

 


আরো সংবাদ



premium cement