৪০ বছর পর সিনেমার গল্প হয়েছে বাস্তব
- রফিকুল ইসলাম খান, গফরগাঁও (ময়মনসিংহ)
- ১৮ জুলাই ২০১৮, ১৮:২৯
অভাবের তাড়না আনোয়ারাকে ৪০ বছর আগে হতদরিদ্র বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বজনদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল। কিন্ত বদলে যায়নি শিকড়ের টান, মাতৃভূমির প্রতি ভালবাসা ও মা-বাবার প্রতি মমত্ববোধ। গত ২৬ বছর ধরে তারা বাবা-মা শিকড়ের সন্ধানে চেষ্টা ছিল বিরামহীন। মা-বাবা মারা গেছে অনেক বছর আগেই ।
বাংলায় কথা বলতে না পারলেও হারানো ভাই-বোনকে ফিরে পেয়ে তাদের জড়িয়ে ধরে বাবা, মা বলে চিৎকার করে কাঁদছিল। আর হারানো মেয়েকে ফিরে পেয়ে শত গ্রামবাসি ভিড় জমিয়েছে। এ ধরনের ঘটনার অবতারনা হয় ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার রাওনা ইউনিয়নের খারুয়ামুকুন্দ গ্রামে। বিষয়টি গোটা এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যে সৃষ্টি হয়েছে।
গফরগাঁও উপজেলার খারুয়া মুকুন্দ গ্রামের ইন্তাজ আলী ও সমতা খাতুন দম্পত্তির অভাবী সংসার। ইন্তাজ আলী ও সমতা খাতুন রোগে-শোকে আক্রান্ত। কাজ-কর্ম করতে পারে না। শত চেষ্টা করেও তিন মেয়ে ও এক ছেলেসহ ৬ জনের সংসারে খাবার যোগাড় করতে পারে না।
১৯৭৮ সালের কোন এক সকাল বেলা ইন্তাজ আলী ও সমতা বুকে পাহাড় সমান কষ্টে নিয়ে গফরগাঁও রেলওয়ে ষ্টেশনে রাজধানী ঢাকাগামী লোকাল ট্রেনে তুলে দেন আড়াই বছর কন্যা শিশু মল্লিকা ও পাঁচ বছর বয়সী শিশু কন্যা মাজেদাকে। পরে হৃদয়বান কোন মানুষের সহযোগিতায় ক্ষুধার্ত দুই শিশুর আশ্রয় মিলে টঙ্গীর দত্তপাড়ার এক মাতৃসদনে।
মাতৃসদনে মাজেদার নাম পরিবর্তিত হয় আনোয়ারা। সেখান থেকে ১৯৭৮ সালে নেদারল্যান্ডের নিঃসন্তান দম্পতি এর্ভাট বেকার ও মেরিয়্যান্ট রেজল্যাগান্ট ৫ বছর বয়সী আনোয়ারাকে দত্তক নেন। আনোয়ারার ছোট বোন মল্লিকাকে (পরিবর্তিত নাম শম্পা ) দত্তক নেয় নেদারল্যান্ডসের অপর একটি নিসন্তান দম্পত্তি। এর পর থেকেই দুই বোনও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
দেখতে দেখতে সময় পেরিয়ে যায়। আনোয়ারা নেদারর্যান্ডসে নাসিং-এ স্নাতক ডিগ্রী নিয়ে একটি হাসপাতালে সেবিকার কাজ করেন। ছোটবেলায় নেদারল্যান্ডে গিয়ে পালক পিতা-মাতার কাছে অতি যত্ন সহকারে বড় হতে থাকে আনোয়ারা। নেদারল্যান্ডের একটি এলাকায় একটি মেয়েকে দেখে তার মনে হয়েছিল তার ছোট বোন।
১৫ বছর চেষ্টার পর পালক বাবা-মা সহযোগিতায় ডিএনএ টেষ্টের মাধ্যমে তার হারানো বোন শম্পাকে খুজেঁ পায় আনোয়ারা। ১৯৯২ সাল থেকে আনোয়ারা বাংলাদেশে এসে তার বাবা-মা, ভাই-বোন, শিকড়ের খোঁজ করছিল। এই সময়ে নিসন্তান আনোয়ারাও বাংলাদেশ থেকে আজিয়া ও মুন নামে দুই কন্যা শিশুকে দত্তক নেয়।
আনোয়ারা প্রতিবারই বাংলাদেশে এসে তার শিকড়ের সন্ধানে টঙ্গী ও আশেপাশের এলাকায় পোষ্টারিং করে এবং দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করে। প্রতিবারই ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান । এ বছর জানুয়ারী মাসে বাংলাদেশে এসে বাবা-মা, স্বজনদের খোজেঁ ব্যর্থ হয়ে অবশেষে যোগাযোগ করেন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদির পরিচালক হানিফ সংকেতের সাথে।
গত ৩০ মার্চ এ সংক্রান্ত একটি মর্মস্পর্শী প্রতিবেদন বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে প্রচারিত হয়। অনুষ্ঠানটি দেখছিলেন খারুয়া মুকুন্দ গ্রামের দলিল লেখক শ্যামল কুমার দত্ত। তিনি ইত্যাদির পচিালক হানিফ সংকেতের সাথে যোগাযোগ করে আনোয়ারার ভাই ছুতু মিয়া (৫৫) এবং ছুলেমান নেছার (৬০) ডিএনএ রির্পোট নেদারর্যান্ডস পাঠান। আনোয়ারা বেগম নিশ্চিত হন ছুতু মিয়া ও ছুলেমান নেছাই তার ভাই ও বোন।
গত রোববার রাতে নেদারল্যান্ডস থেকে স্বামী থমাস, দত্তক দুই কন্যাসহ বাংলাদেশে আসেন আনোয়ারা। সোমবার দুপুরে দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান হয় তার ভাই ছুতু মিয়া ও ছুলেমান নেছার সাথে দেখার মাধ্যমে । আনোয়ারা জানায়, মা-বাবা নেই খারাপ লাগছে। তবে আমি আমার শিকড়ের সন্ধান পেয়েছি । এতে আমি অনেক খুশি ।
রাওনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহাবুল আলম বলেন, বিষয়টি খুবই আবেগের। সিনেমায় ছবিতে দেখা যায়,হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে বহু বছর পর ফিরে পেতে। কিন্তু বাস্তবে এমন ঘটনা বিরল । ভাবলে অবাক লাগে।