২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

অ্যা শো মাস্ট গো অন : জেমস

অ্যা শো মাস্ট গো অন : জেমস - সংগৃহীত

দেশের কিংবদন্তি ব্যান্ডসংগীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর সময় তার অন্যতম ঘনিষ্ঠজন ও প্রথিতযশা সংগীতশিল্পী জেমস ছিলেন বরগুনায় একটি উন্নয়ন কনসার্টে। বৃহস্পতিবার (১৮ অক্টোবর) ঢাকায় যখন সংগীতভক্তদের মধ্যে শোকের গভীর ছায়া তখন জেমস গান করছেন দূরের এক মঞ্চে। গানতো নয় যেনো কান্নার আসর! মঞ্চে উঠে এই ‘নগর বাউল’ ভেজা গলায় বললেন, ‘আজকের… আজকের এই অনুষ্ঠানটা উৎসর্গ করছি… বাংলাদেশের কিংবদন্তি গায়ক আইয়ুব বাচ্চুকে।’

‘আজকে এই অনুষ্ঠানটা করার একদম ইচ্ছা ছিলো না। কিন্তু, বহু বছর আগের একটা গল্প বলি… তখন আমি আর বাচ্চু ভাই একসঙ্গে আড্ডা মারতাম। তখন আমরা হাসতে হাসতে বললাম, আমাদের এই শিল্পীদের একটা প্রবাদ আছে ইংরেজিতে… যে, অ্যা শো মাস্ট গো অন। তো তাই চেষ্টা করবো…।’

কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় জেমসের কণ্ঠরোধ হয়ে আসছিল। এরপর গিটার বাজাতে শুরু করেন।  মুখের এক্সপ্রেশন আঙুলের মধ্য দিয়ে গিটারের তারে আছড়ে পড়ছিল। গিটার থেকে ছিটকে বেরোচ্ছিল কান্না। জেমস কান্না আড়াল করতে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন, গিটার আড়াল করতে দেয়নি, ছটি তার কেঁদে যাচ্ছিল... গিটার কাঁদতে জানে... 

এরপর, তিনি কয়েক মিনিট গিটারে তোলেন বেদনার সুর। ‘কবিতা’ গানের কয়েকটি লাইন ভেঙ্গে ভেঙ্গে গাওয়ার পর দর্শকদের কাছে ১০ মিনিটের জন্যে ছুটি চেয়ে নেমে আসেন মঞ্চ থেকে।

বাংলা ব্যান্ড জগতে আইয়ুব বাচ্চুর খুব কাছের মানুষ হিসেবে জেমসের নাম চলে আসে। আইয়ুব বাচ্চুর নাম উচ্চারিত হলে জেমসের নাম উচ্চারিত হয়, জেমসের নাম উচ্চারিত হলে আইয়ুব বাচ্চুর নাম উচ্চারিত হয়। দুজনই একটা সময়ে ছিলেন ফিলিংসে। আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে জেমসের পরিচয় ১৯৮০ সালের শুরুর দিকে। এরপর দীর্ঘ ৪০ বছরের সম্পর্ক। এক সঙ্গে করেছেন অনেক কনসার্ট, অনেক অনুষ্ঠান। প্রিয় মানুষ আইয়ুব বাচ্চুর বিদায় যেন মেনে নিতে পারছিলেন না জেমস। 

জেমস বলেন,আমাদের সম্পর্কের এই গভীরতার কথা কখনো বোঝাতে পারব না। কেউ হয়তো জানবেও না যে আমাদের একের হৃদয়ে অপরের জন্য কতটা জায়গা রাখা আছে। আমাদের মধ্যে একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা ছিল। 

আরো পড়ুন :  আইয়ুব বাচ্চুকে উৎসর্গ করে জেমসের কনসার্ট
আলমগীর কবির ১৯ অক্টোবর ২০১৮, ১১:২৫

বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতে জেমস- আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন প্রতিযোগী। সব সময় দুজন একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার লড়াই করতেন। সেই প্রতিযোগীতে হঠাৎ হারিয়ে থমকে গিয়েছেন জেমস।   একটি কনসার্টে অংশ নিতে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে জেমস অবস্থান করছেন বরগুনায়। সেখানে থেকেই শোনলেন আইয়ুব বাচ্চু আর নেই। তাৎক্ষনিকভাবে তিনি বন্ধ করে দেন অনুষ্ঠানের সাউন্ডচেক আর প্র্যাকটিস পর্ব। নিরবে এক কোনে গিয়ে বসে থাকেন কিছুক্ষণ। 

বিকেলে মোবাইলে জেমস বলেন, ‘আমি এখন বরগুনা আছি। এটা আমার জন্য দুর্ভাগ্যজনক। ঢাকায় থাকলে ছুটে যেতে পারতাম। বরগুনা স্টেডিয়ামে আজ(বৃহস্পতিবার) সন্ধ্যায় একটি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে গাইতে হচ্ছে। আমি খবরটি পেয়েই মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের (আসাদুজ্জামান নূর) সাথে কথা বলেছি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আজকের কনসার্টটি উনাকে (আইয়ুব বাচ্চু) ডেডিকেটেড করে করবো। কতটা প্রাণখুলে গাইতে পারবো জানি না।’


স্বাভাবিক, কারণ বাংলাদেশে রক ইতিহাসের দ্বৈরথ বলা হয় আইয়ুব বাচ্চু-জেমসকে। প্রায় তিন দশক তারা দুজনে মিলে শাসন করেছেন দুই বাংলার রক কিংবা ব্যান্ড সংগীত। দুজনার শুরুটাও চট্টগ্রাম থেকেই। চার দশকে একসঙ্গে অসংখ্য শো আর অ্যালবাম করেছেন তারা।

বরগুনা থেকে মুঠোফোনে জেমস বলেন, ‘তিনি বাংলা সংগীতের কিংবদন্তি। ১৯৮০ সালের শুরুর দিকে আমাদের পরিচয়। এরপর দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর আমরা একে অপরের সুখে-দুঃখে মানে-অভিমানে কাটিয়েছি। একসঙ্গে প্রচুর শো করেছি, গান করেছি, দেশ-বিদেশে ঘুরেছি। উনি অকস্মাৎ এভাবে আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে যাবেন, খবরটা শুনে মানতে পারছি না। রক সংগীতে তার যে অবদান সেটা এই জাতি চিরদিন মনে রাখবে বলেই বিশ্বাস করি।’

একটু থেমে আর্দ্রকণ্ঠে জেমস বলেন, ‘উনি অত্যন্ত উদার মনের মানুষ ছিলেন। প্রচণ্ড রসাত্মবোধ ছিল তার মধ্যে। ওনার সাথে আমার যে সম্পর্কটা সেটা আসলে বলে বোঝানো যাবে না। বিভিন্ন সময়ে কারণে-অকারণে আমরা একজন আরেকজনের পাশে ছিলাম। সম্পর্কের এই গভীরতার কথা কখনও বোঝাতে পারবো না। কেউ হয়তো জানবেও না আমাদের হৃদয়ে একে অপরের জন্য কতটা জায়গা।’

এ পর্যায়ে মাহফুজ আনাম জেমসের প্রতি জিজ্ঞাসা ছিল, মিডিয়ায় কিন্তু আপনাদের দুজনকে প্রতিযোগী হিসেবেই দেখে আসছে সবসময়। জবাবে জেমস বললেন, ‘মিডিয়া আমাদের সম্পর্কের বিচার কীভাবে করছে সেটা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। তবে আমি মনে করি আমাদের মধ্যে একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা ছিল। এটা ভালো গান তৈরির প্রতিযোগিতা। এখানে ব্যক্তিগত কোনও জেলাসি ছিল না। আপনারা হয়তো অনেকেই দেখেছেন, আমাদের যখন যেখানে দেখা হয়েছে চারপাশ অগ্রাহ্য করে একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছি পরম ভালোবাসায়। আড্ডায় মেতেছি। এসব টান কিংবা হিডেন সম্পর্কের বিষয়গুলো ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। করতেও চাই না।’

 ১৮ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার)  সকাল সাড়ে ৮টার দিকে নিজ বাসায় হার্ট অ্যাটাক করেন গিটার লিজেন্ড আইয়ুব বাচ্চু। তড়িঘড়ি তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আইয়ুব বাচ্চু। ১৯৭৮ সালে ফিলিংস ব্যান্ডের মাধ্যমে সংগীত জগতে তার পথচলা শুরু হয়। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সোলস ব্যান্ডে লিড গিটারিস্ট হিসেবে যুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৯১ সালে এলআরবি ব্যান্ড গঠন করেন আইয়ুব বাচ্চু।

এর প্রথম অ্যালবাম ‘এলআরবি’ বাজারে আসে ১৯৯২ সালে। এটাই দেশে প্রথম ডাবল অ্যালবাম। এলআরবির অন্য অ্যালবামগুলো হলো ‘সুখ’ (১৯৯৩), ‘তবুও’ (১৯৯৪), ‘ঘুমন্ত শহরে’ (১৯৯৫), ‘ফেরারি মন’ ও ‘স্বপ্ন’ (১৯৯৬), ‘আমাদের’ (১৯৯৮), ‘বিস্ময়’ (১৯৯৮), ‘মন চাইলে মন পাবে’ (২০০১), ‘অচেনা জীবন’ (২০০৩), ‘মনে আছে নাকি নাই’ (২০০৫), ‘স্পর্শ’ (২০০৮), ‘যুদ্ধ’ (২০১২) এবং সর্বশেষ ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’ (২০১৬)।
১৯৮৬ সালে প্রকাশিত ‘রক্তগোলাপ’ হলো তার প্রথম প্রকাশিত একক অ্যালবাম। তার সাফল্যের শুরুটা হয় দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ‘ময়না’র (১৯৮৮) মাধ্যমে। ১৯৯৫ সালে বাজারে আসে তার তৃতীয় একক অ্যালবাম ‘কষ্ট’। এর প্রায় সব গানই জনপ্রিয়তা পায়। বিশেষ করে ‘কষ্ট কাকে বলে’, ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘অবাক হৃদয়’, ‘আমিও মানুষ’ গানগুলো। তার অন্য একক অ্যালবামগুলো হলো ‘সময়’ (১৯৯৮), ‘একা’ (১৯৯৯), ‘প্রেম তুমি কি’ (২০০২), ‘দুটি মন’ (২০০২), ‘কাফেলা’ (২০০২), ‘রিমঝিম বৃষ্টি’ (২০০৮), ‘বলিনি কখনো’ (২০০৯), ‘জীবনের গল্প’ (২০১৫)।
আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া গানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘চলো বদলে যাই’। এর কথা ও সুর তারই। শ্রোতাপ্রিয় গানের তালিকায় আরও রয়েছে ‘শেষ চিঠি কেমন এমন চিঠি’, ‘ঘুম ভাঙা শহরে’, ‘হকার’, ‘সুখ’, ‘রুপালি গিটার’, ‘গতকাল রাতে’, ‘তারা ভরা রাতে’, ‘এখন অনেক রাত’ ইত্যাদি।

রক ঘরানার গানের এই শিল্পী আধুনিক আর লোকগীতিতেও শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন আইয়ুব বাচ্চু। বেশ কিছু চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করেছেন তিনি। চলচ্চিত্রে তার গাওয়া প্রথম গান ‘লুটতরাজ’ ছবির ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’। এছাড়া ‘আম্মাজান’ ছবির শিরোনাম গানটিও পেয়েছে আকাশছুঁই জনপ্রিয়তা।


আরো সংবাদ



premium cement