২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চামড়ার দাম নিয়ে তোলপাড়

-

ঈদুল আজহা উপলক্ষে জবাই করা পশুর চামড়ার দাম নিয়ে এবার সারা দেশে তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়েছে। বিক্রি করতে না পেরে অনেকেই চামড়া মাটির নিচে পুঁতে ফেলেছেন। আবার কেউ কেউ খোলা জায়গায় চামড়া ফেলে পরিবেশ দূষিত করেছেন। অভিযোগ উঠেছে, সরকারের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় পরিকল্পিতভাবে চামড়ার দাম কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশের লাখ লাখ মাদরাসা এবং গরিব এতিম মিসকিনদের বঞ্চিত করা হয়েছে। আবার ট্যানারি মালিকদের পক্ষ থেকে সময়মতো চামড়া না কেনায় বিপাকে পড়েছেন মওসুমি ব্যবসায়ীরা। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে চামড়া রফতানির অনুমতি দেয় সরকার। এতে দেখা দেয় নতুন সঙ্কট। শেষ পর্যন্ত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করা হলেও অফুরন্ত ক্ষতির সম্মুখীন হয় সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্প খাত।
এক লাখ টাকা দিয়ে কেনা কোরবানির গরুর চামড়ার দাম ঈদের দিন পাওয়া গেছে তিন থেকে চার শ’ টাকা। ২০ হাজার টাকা দিয়ে কেনা খাসির চামড়ার দাম ৬০ টাকা। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে ঈদের দিন মসজিদ মাদরাসা বা এতিমখানা কর্তৃপক্ষের লোকজনও কোরবানির পশুর চামড়া নেয়ার জন্য তেমন আগ্রহ দেখায়নি। বাড়ির পাশের গরিব লোকেরাও এখন আর সাহায্য বাবদ চামড়ার টাকা দাবি করেন না। কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে এতটা অনাগ্রহ আগে কখনোই ছিল না। আড়তদারদের দাবি, নগদ টাকা না থাকায় তারা এ বছর বেশি দামে চামড়া কিনতে পারেননি। আর ট্যানারি মালিকদের দাবি, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় চামড়ার দাম কমে গেছে। এ ছাড়াও গত বছর যে পরিমাণ চামড়া কেনা হয়েছে, তার অর্ধেকই রয়ে গেছে। যেহেতু চাহিদা কম, সেহেতু চামড়ার দামও কম, যা গত ৩১ বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ।
জানা যায়, ১৯৮৯ সালে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে কেনা গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ৭ শ’ থেকে ৮ শ’ টাকায়। ১৬ শ’ থেকে ১৮ শ’ টাকা দামের একটি খাসির চামড়া বিক্রি হয়েছে দেড় শ’ টাকায়। আর এ বছর এক লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকায় কেনা গরুর চামড়া এক হাজার টাকায় বিক্রি করতে পেরেছেন কোনো কোরবানিদাতা এমন সংবাদই শোনা যায়নি দেশের কোথাও। আর যত টাকা দিয়েই কেনা হোক একটি খাসির চামড়া এ বছর এক শ’ টাকায় কেউ বিক্রি করতে পেরেছেন এমন রেকর্ডও নেই।
চামড়া শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, বিশ্ববাজারে চামড়ার বিকল্প পণ্যের বাজার প্রশস্ত হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়াজাত পণ্যের বাজার ছোট হয়ে গেছে। এ ছাড়া চীনের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্পর্কে সমস্যা তৈরি হওয়ায় চামড়ার বাজারে বড় প্রভাব ফেলেছে। তাই চাহিদা কমে গেছে। গত বছর কেনা চামড়াও আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। সেখান থেকে রয়ে গেছে প্রায় অর্ধেক কাঁচা চামড়া। তাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী আমরা এ বছর কাঁচা চামড়া কিনতে পারব না, যা প্রায় চূড়ান্ত। আর চাহিদা কমে যাওয়ায় দামও কমবে, এটিই স্বাভাবিক। এর দায় আমরা কিভাবে নেবো?
ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে বছরে মোটামুটি ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরু, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া। মোট চামড়ার অর্ধেকের বেশি আসে কোরবানির ঈদের সময়। প্রতি বছরের ন্যায় এবারো পবিত্র ঈদুল আজহার আগে গত ৬ আগস্ট সরকার ও ব্যবসায়ীরা মিলে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়। তারা জানায়, এবার ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গর চামড়ার দাম ৪৫-৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৫-৪০ টাকা হবে। গত বছর প্রতি বর্গফুটের দাম একই ছিল। ২০১৭ সালে প্রতি বর্গফুট গরু চামড়ার দাম ছিল ঢাকায় ৪৫-৫৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪০-৪৫ টাকা।
এ ছাড়া সারা দেশে খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৮-২০ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৩-১৫ টাকায় সংগ্রহ করতে বলা হয় ব্যবসায়ীদের। গত বার খাসির চামড়ার দামও ছিল একই। তবে ২০১৭ সালে খাসির চামড়া ছিল প্রতি বর্গফুট ২০-২২ টাকা এবং বকরির চামড়ার দাম ছিল ১৫-১৭ টাকা। তবে বাস্তবে এ দাম নির্ধারণ কোনো কাজেই আসেনি। ঢাকায় পাঁচ বছরে কোরবানির গরু চামড়ার দাম (প্রতি বর্গফুট) ২০১৪ সালে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা, ২০১৫-তে ৫০ টাকা, ২০১৬-তে ৫০-৫৫ টাকা, ২০১৭-তে ৫০-৫৫ টাকা, ২০১৮-তে ৪৫-৫০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়।
দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে ফেলে দেয়া চামড়া
সিলেটে ফেলে দেয়া ২০ ট্রাক চামড়া নিয়ে নয়া সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এসব চামড়া থেকে এখন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ময়লা সরিয়ে সেগুলো পুঁতে রাখা হয়েছিল। কিন্তু কাজ হয়নি। এখন ওই ময়লা থেকে ছড়িয়ে পড়ছে দুর্গন্ধ। এতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। সিলেট নগরীর পারাইরচক এলাকায় হচ্ছে সিটি করপোরেশনের ময়লা ডাম্পিংয়ের স্থান। গোটা শহরের ময়লা প্রতিদিন ওখানেই ডাম্পিং করা হয়। ডাম্পিংয়ের পাশ দিয়েই সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়ক। প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহন ওই সড়ক দিয়ে চলাচল করে। এমনিতেই সব সময় দুর্গন্ধ ছড়ায় ওই ডাম্পিং। গত দুই দিন থেকে ডাম্পিং এরিয়া থেকে বেশি পরিমাণ দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এতে করে পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দারা দুর্ভোগে পড়েছেন। স্থানীয় ইকবাল হোসেন জানিয়েছেন, এখন প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত গোশত পচা দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এবার সিটি করপোরেশন থেকে বিপুল পরিমাণ চামড়া এনে এখানে ডাম্পিং করা হয়। এরপর সেগুলো পচে এই দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
মওসুমি ব্যবসায়ীদের দুষলেন শিল্পসচিব
এ দিকে সঠিক উপায়ে সংরক্ষণ না করে মওসুমি ব্যবসায়ীরা কাঁচা চামড়া নষ্ট করেছে বলে অভিযোগ করেছেন শিল্পসচিব মো: আব্দুল হালিম। সাভারে চামড়া শিল্পনগরীতে চামড়া শিল্প-সংক্রান্ত বিভিন্ন অংশীজনের সাথে মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন। সাভার ট্যানারি শিল্পনগরীর সিইটিপি সম্পূর্ণ চালু রয়েছে উল্লেখ করে শিল্পসচিব বলেন, কোরবানির সময় ট্যানারিগুলো সারা বছরের সরবরাহের অর্ধেক চামড়া সংগ্রহ করে। আগামী দু-তিন মাস এ শিল্প নগরী ট্যানারিগুলো পূর্ণ গতিতে চলবে। পিক সিজনে উৎপাদিত চামড়ার আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার স্বার্থে সব ট্যানারিকে একসাথে কাজ না করে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, চামড়া যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করার ফলে কিছু কিছু স্থানে মওসুমি চামড়াা ব্যবসায়ীরা কাঁচা চামড়া নষ্ট করেছেন। এটি পুরো দেশের চিত্র নয়। অন্য স্থানের চামড়া যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে বিভাগীয় প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement