২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বইমেলার অর্থনৈতিক বিবেচনা

-

বিখ্যাত কবি জালালউদ্দিন রুমি বলেছেন, মানুষের বড় সম্পদ তার হৃদয়। এ হৃদয় নাকি মন্দির বা কাবার চেয়েও পবিত্র। আর মানুষের এ হৃদয়কে সমৃদ্ধ করে বই। হ্যাঁ, মানুষের আত্মার খোরাক জোগানের পাশাপাশি অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে এবারো শুরু হয়েছে অমর একুশের বইমেলা। তিন দশক ধরে চলা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং একাডেমি সম্মুখস্থ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এবার প্রায় তিন লাখ বর্গফুট জায়গায় বইমেলা বসেছে।
অমর একুশে বইমেলাকে ঘিরে প্রতি বছরই নতুন নতুন লেখকের সমাবেশ যেমন হয়, তেমনিভাবে নতুন নতুন প্রকাশকও আবির্ভাব হয় এ মেলার মাধ্যমে। আর এর মাধ্যমে যেমন নতুন নতুন কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হয়, তেমনিভাবে বেকারত্বের অভিশাপ থেকেও মুক্তি পায় কর্মক্ষম শ্রমিক। পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক পসিংখ্যান মতে, প্রতি বছরই দেশে ৩০ লাখ নতুন শ্রমিক আসে কর্মক্ষেত্রে। কিন্তু তাদের কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করতে না পারলে বেকারত্বের সংখ্যা বেড়ে যায়। আর বেকারত্বের হার বেড়ে গেলে সমাজে কাটাকাটি হানাহানিসহ নানা অশান্তি বেড়ে যায়। একপর্যয়ে সামাজিক বিপর্যয় ঘটে। এ সামাজিক বিপর্যয় ঘটানো ঠেকাতে অর্থনীতির অন্যান্য খাতের মতো প্রকাশনা শিল্পও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর এ প্রকাশনা শিল্পের পূর্ণতা আনে অমর একুশে বইমেলা।
মেলার পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দেশের অন্যান্য খাতের মতো বইমেলার ওপরও প্রভাব পড়ে। কারণ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সাথে অর্থনৈতিক বিভিন্ন উপখাতের মতো বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান ও বইপ্রেমীদেরও সমাগম হয় বেশি হারে। আর এসবের পেছনে কাজ করে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। তাই দেখা যায়, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির পেছনে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ওৎপ্রোতভাবে জড়িত।
নতুন নতুন কর্মসংস্থানের মাধ্যমে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। আর ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে অর্থনীতির চাকা গতিশীল হয়, সমৃদ্ধি আনে দেশ ও জনগণের। নানাভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যেমন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, আবার শিল্পে উৎপাদিত পণ্য বিক্রির মাধ্যমেও অনুরূপ কর্মের ব্যবস্থা হয় শ্রমিকের। সেদিক থেকে অমর একুশে বইমেলা শুধু বইপ্রেমীদের জ্ঞানের খোরাকই মেটায় না, বইবিক্রেতা, প্রকাশক, ছাপাখানা, বই বাইন্ডিং ইত্যাদি খাতের সাথে জড়িতদের কর্মেরও সংস্থান করে দেয়। এ কারণে অর্থনৈতিক দিক থেকে ভাষার মাসের গুরুত্ব অপরীসীমÑ এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
প্রকাশকরা জানিয়েছেন, সারা বছরের কাক্সিক্ষত মাস ভাষার মাস। এ মাসকে ঘিরেই তাদের যত কর্মযজ্ঞ। ভালো লেখকদের লেখা পাওয়ার জন্য যেমন তাদের পেছনে ঘুরতে হয়, তেমনি নতুন নতুন লেখক সৃষ্টিরও প্রয়াশ থাকে। কেননা, পৃথিবী পরিবর্তনশীল। প্রতিনিয়তই পরিবর্তন হচ্ছে পৃথিবী। সেই সাথে পরিবর্তন হচ্ছে মানুষের রুচি ও আবেগের। পুরনো লেখকদের লেখার পাশাপাশি নতুন লেখকদের লেখার আবেদন থাকে পাঠকদের কাছে। এ কারণেই প্রকাশকরা পুরনো লেখকদের লেখা যেমন সংগ্রহ করে থাকেন, তেমনি নতুন লেখকদের লেখাও তারা সংগ্রহ করতে ব্যতিব্যস্ত থাকেন। কিন্তু তাদের লক্ষ্য থাকে ফেব্রুয়ারি মাস। এ মাসেই তাদের সারা বছরের কর্মকাণ্ডের গুণগত মান যাচাই হয়। সর্বাধিক পাঠক যে প্রকাশকের বই কেনেন ওই প্রকাশকের মানদণ্ড ততই বাড়ে। এ দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায়, ভালো লেখকদের অধিক বই কাটতির মাধ্যমে তার যেমন অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য আনে, তেমনি ভালো প্রকাশের বই অধিক বিক্রির মাধ্যমে ওই প্রকাশকের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী নিয়ে আসে। এ থেকে দেখা যায়, ভালো লেখকের পাশাপাশি ভালো প্রকাশক হওয়ারও প্রতিযোগিতা অর্থনৈতিক তাগিদেই থেকে যায়।
বর্তমানে প্রকাশনা শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। একটি প্রকাশনার সাথে প্রায় ৩০ প্রকারের কর্মক্ষম শ্রমিক জড়িত থাকে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, লেখক, প্রকাশক নিজে, টাইপরাইটার, কপি রিডার, ছাপাখানা চালানোর জন্য প্রয়োজন হয় টেকনিশিয়ান, ছাপাখানা থেকে ছাপা হওয়ার পর বই বাইন্ডিং করার জন্য বাইন্ডার ইত্যাদি খাত সরাসরি জড়িত থাকে। প্রথমত লেখক লেখেন। কম্পোজিটর হাতের লেখাকে কম্পিউটারে কম্পোজ করেন। প্রচ্ছদ শিল্পী (ক্ষেত্র বিশেষে অলঙ্করণ শিল্পীও যুক্ত হন) বইয়ের চরিত্র অনুযায়ী প্রচ্ছদ আঁকেন। প্রকাশক প্রণ্ডুলিপিভেদে নির্ধারিত মাপে কাঠামো দাঁড় করান। সাধারণত বইয়ের কম্পোজ ও অঙ্গসজ্জা ফর্মাপ্রতি (১৬ পৃষ্ঠা) ৫০০ থেকে এক হাজার টাকায় করেন পেশাদার ব্যবসায়ীরা। কাগজে প্রিন্ট করার পর পাণ্ডুলিপি যায় বানান সংশোধকের কাছে। সচরাচর এরা প্রতি ফর্মা ১০০ থেকে ৫০০ টাকায় দেখে থাকেন। লেখক-প্রকাশকের সম্মিলিত উদ্যোগে পাণ্ডুলিপি ফাইনাল করা হলে প্রেসে যায়। বর্তমানে মুদ্রণশিল্পে এসেছে আধুনিক প্রযুক্তি। ছাপায় ভালো মান যারা চান, ট্রেসিং ও পেস্টিংয়ের ঝক্কি কমাতে সরাসরি সিটিপি (কম্পিউটার টু প্লেট) করেন। পেল্টের পরের স্তর ছাপাখানা। ছাপাখানার সাথে ওৎপ্রোত সম্পর্ক কাগজের। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন রকম কাগজই পাওয়া যায় বাজারে। লেখক ও প্রকাশকরা সামর্থ্য ও পছন্দ অনুযায়ী কাগজ বাছাই করেন।
বইমেলার অর্থনীতি নানাভাবে, বিভিন্ন দিকে বিস্তৃৃত। পরিবহন শ্রমিক, মুটেরা দেখে বাড়তি টাকার মুখ। অন্য দিকে এ সময়ে বিজ্ঞাপনের ব্যবসাও থাকে রমরমা। দৈনিক পত্রিকা থেকে শুরু করে অনলাইন নিউজ পোর্টাল, বইমেলাকেন্দ্রিক বুলেটিনে ছাপা হয় কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপন। এ বিজ্ঞাপন লেখক-প্রকাশক উভয়পক্ষই দিয়ে থাকেন। সংশ্লিষ্টরা চান, বইয়ের খবর সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। ক্রেতা আকৃষ্ট করতে বিজ্ঞাপন প্রচার ও প্রকাশ দীর্ঘ দিনের রেওয়াজ। বইমেলায় প্রকাশিত বইগুলোই পরবর্তীকালে চলে যায় পুরনো বইয়ের দোকানে। ঢাকার পল্টন, মিরপুর, নীলক্ষেত এলাকায় পুরনো বইয়ের ব্যবসা সরগরম থাকে সারা বছরই।
মেলার অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে চলছে। বাড়ছে বই ও বিক্রির পরিমাণও। বাংলা একাডেমির এক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০০২ সালে স্টলের সংখ্যা ছিল ২৪০টি। গত ২০১৭ সালে ৬৩৩ ইউনিটে ১৫টি প্যাভিলিয়নে ৪০৯টি প্রতিষ্ঠান মেলায় অংশগ্রহণ করলেও গতবারের মতো এবার তার পরিসর বেড়েছে। গত বছর আগের বছরের চেয়ে ইউনিটের সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ৭১৯। আর প্যাভিলিয়নেরর সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ১৫ থেকে ২৪ এ। প্রকাশকের সংখ্যাও ৪০৯ থেকে বেড়ে হয়েছিল ৪৫৫। গত বছরের চেয়ে এবার ইউনিটের সংখ্যা বেড়ে গেছে। গত বছর থেকে এবার ইউনিটের সংখ্যা ৭১৯ থেকে বেড়ে হয়েছে ৭৭০টি। তবে, প্যাভিলিয়নের সংখ্যা অপরিবর্তিত অর্থাৎ ২৪টিতেই রয়েছে। তবে, গত বারের চেয়ে এবার মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমে ৪৫৫টি থেকে ৪৪৯টিতে নেমেছে।
এ ছাড়া নানা ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে। এর মধ্যে অন্যতম হলো স্টল নির্মাণ ও সাজসজ্জাকারীদের প্রতি বছরে একবার কর্মের সংস্থান হয়। খাবারের দোকান চলে সারা মাস। মেলা সহায়ক মেলা বসে। যেমনÑ শিশুদের খেলনা, মহিলাদের সাজসজ্জার উপকরণ ইত্যাদি মেলাকে আরো অর্থবহ করে তোলে। এসব কর্মকাণ্ডের সাথে সরাসরি অর্থনৈতিক সম্পর্ক থাকে। সবমিলে বইমেলা পাঠক, লেখক-লেখিকাদের যেমন মিলন মেলায় পরিণত হয়, তেমনি অর্থনৈতিক দিক থেকেও এর সাথে জড়িতরা লাভবান হন।


আরো সংবাদ



premium cement
রাত পোহাতেই রুদ্ধদ্বার অনুশীলন শুরু বাংলাদেশের সাটুরিয়ায় প্রশান্তির বৃষ্টি চেয়ে সালাতুল ইসতিসকা আদায় ইরান নিয়ে মার্কিন হুঁশিয়ারি পাকিস্তানকে গাজায় গণকবরের বিষয়ে ইসরাইলের কাছে ‘জবাব’ চেয়েছে হোয়াইট হাউস দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান বাস্তবায়ন করা হলে হামাস অস্ত্র ছাড়তে রাজি শনিবার থেকে শুরু গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা, প্রস্তত জবি ক্যাম্পাসগুলোতে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সমর্থন করেন বাইডেন: মুখপাত্র নোয়াখালীতে ইসতিসকার নামাজ আদায় জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তিভাব থাকবে বান্দরবানে বৃষ্টির চেয়ে চোখের পানি ফেলে বিশেষ নামাজ চকরিয়ায় যুবককে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা, গ্রেফতার ৭

সকল