২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`
একান্ত সাক্ষাৎকারে রানার গ্রুপের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান খান

সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসতে পেরেছি মোটরসাইকেলকে

-

সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে মোটরসাইকেল নিয়ে আসার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এক সময়ে ৮০ হাজার টাকা ছিল সর্বনি¤œ। তখন আমরা ৬০ হাজার টাকায় মোটরসাইকেল তৈরির পরিকল্পনা নেই। বর্তমানে সর্বনি¤œœ ৬০ হাজার টাকায় মোটরসাইকেল পাওয়া যায়। এখন আমরা ৪০ হাজার টাকায় মোটরসাইকেল তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছি।
কথাগুলো বলেছেন দেশের প্রথম মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রানারের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান খান। তিনি মোটসাইকেল তৈরির বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা ও বর্তমান অবস্থান নিয়ে নয়া দিগন্তের সাথে খোলাখুলি কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার আশরাফুল ইসলাম।
নয়া দিগন্ত : কিভাবে মোটরসাইকেল উৎপাদন শুরু করলেন?
হাফিজুর রহমান খান : অর্থনীতিতে প্রধান অবদান রাখছে যুবসমাজ। তারা মোটরসাইকেল পেলেই খুশি। এটিকে সামনে রেখে আমরা প্রথমে চিন্তা করলাম মোটরসাইকেল কেনার সবার সামর্থের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এ জন্য আমরা গবেষণা করতে লাগলাম কিভাবে মোটরসাইকেলকে সবার সামর্থের মধ্যে আনা যায়। আমাদের গবেষণায় দেখলাম, যাদের দেশে মোটরসাইকেলের দাম কম, তারা সবাই মোটরসাইকেল উৎপাদন করে। আর যে দেশে মোটরসাইকেলের দাম বেশি তারা বিদেশ থেকে আমদানি করে। বাংলাদেশ শতভাগ মোটরসাইকেল আমদানিকারক দেশ ছিল। সবাই কিনতে পারত না। এটি ব্যবহার করা একসময় বিলাসিতা ছিল। আমরা আমাদের ক্রেতাদের মোটরসাইকেল কেনার সামথ্যের ওপর গবেষণা করতে লাগলাম। সবার কাছে কিভাএব মোটরসাইকেল আনা যায় তার ওপর গবেষণা চালালাম; যাতে সবাই তাদের প্রয়োজনে মোটরসাইকেল কিনতে পারেন ও ব্যবহার করতে পারেন। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে আমরা মোটরসাইকেল তৈরি করি। এর ফলে মোটরসাইকেলের দাম প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। প্রতিদিনই পেপার খুললেই আপনারা দেখতে পাবেন মোটরসাইকেলের মূল্যের ওপর ডিসকাউন্ট দিয়ে আসছে এবং তা ১০ হাজার টাকার নিচে নয়।
নয়া দিগন্ত : কিভাবে বাজারজাত করলেন?
হাফিজুর রহমান খান : সবাই যাতে মোটরসাইকেল কিনতে পারেন এ জন্য আমরা কিস্তিতে বিক্রি শুরু করলাম। আমরা যখন এটি শুরু করলাম তখন অনেকেই বলাবলি করেছেন ‘বিক্রি করতে না পেরে এখন কিস্তিতে বিক্রি শুরু করেছে।’ আসলে আমাদের লক্ষ্য হলো সবার কাছেই মোটরসাইকেল পৌঁছে দেয়। দেখুন, আমরা তিন হাজার টাকা পর্যন্ত কিস্তিতে মোটরসাইকেল বিক্রি করি। অথচ তিন হাজার টাকা একজন মানুষের যাতায়াত খরচই লাগে। সে যাতায়াতের খরচ বাঁচিয়েই মোটরসাইকেলের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছেন। এখনো কিছু মানুষের ধারণা, বাংলাদেশের মানুষ যদি মোটরসাইকেল বানায় তাহলে তাদের গুণগত মান থাকবে না। আমরা প্রমাণ করেছি, ওই ধারণা মোটেও সত্য নয়। আমাদের উৎপাদিত মোটরসাইকেলে ১০ বছরের গ্যারান্টি দেয়া হয়।
তিনি বলেন, দাম কমা যখন শুরু হয়েছে তখন গত দুই বছরে মোটরসাইকেলের ব্যবহার বেড়েছে। যত কমবে তত ব্যবহার বাড়বে। আরো দাম কমাতে হলে প্রয়োজন কম্পোন্যান্ট তৈরি। এ জন্য প্রযুক্তি প্রয়োজন। কেউ হেডলাইট, চাকা, টায়ার বানাবে। পার্টস দেশে তৈরি করতে হবে।
নয়া দিগন্ত : বাজার প্রসারিত করতে কী উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন ?
হাফিজুর রহমান খান : মোটরসাইকেলের জন্য মেলা তৈরির আয়োজন হচ্ছে। চেইন ও বসার সিট কিন্তু এখন দেশেই তৈরি হচ্ছে। চারটি আইটেম দেশেই তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে মোটরসাইকেলের লোহার যাবতীয় জিনিস আমরা তৈরি করছি। এটি শুধু রানারের জন্য। আমরা ইঞ্জিনের কম্পোন্যান্ট নিয়ে এসে ইঞ্জিন তৈরি করছি। আমরা কয়েকটি কোম্পানিকে সহযোগিতাও করেছি। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ফরিদপুরে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যারা মোটরসাইকেলের সিট তৈরি করে। তারা সবাইকে দিচ্ছে। রানারের সাথে মিল রেখে ‘রান’ নাম রাখা হয়েছে কোম্পানিটির নাম। কোম্পানিটির মালিক পক্ষ আমাকে দিয়েই উদ্বোধন করেছে। মোটরসাইকেলের পার্টস দেশে তৈরি খুব একটা চ্যালেঞ্জিং নয়। শুধু টেকনোলজি জানা প্রয়োজন। জানলে অতি সহজ। এটি তৈরির প্রক্রিয়া জানলেই সহজ। ইঞ্জিন বাদ দিলে ছোট-বড় মিলিয়ে পাঁচশত পার্টস লাগে মোটরসাইকেল তৈরিতে। হয়ত দেখা যাবে একশত শিল্প কারখানা হলে বিভিন্ন ধরনের পার্টস তৈরি করা যায়। এটি হলে সম্পূর্ণ মোটরসাইকেল তৈরি সম্ভব। তিনি বলেন, ১৩ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত পাটর্সের ওপর আমদানি শুল্ক রয়েছে।
নয়া দিগন্ত : রানারের প্রতিযোগী কারা?
হাফিজুর রহমান খান : রানারের প্রতিযোগী সবাই। এখানে লোকাল বা আন্তর্জাতিক বলে কোনো কথা নেই। হোন্ডা ও বাজাজ দেশে মোটরসাইকেল তৈরির কারখানা বানিয়েছে। আমরা সরকারকে বলেছি, কে কোন ব্র্যান্ড, সেটি বড় কথা নয়। সবাই বানাচ্ছে কি না সেটি দেখার বিষয়। তিনি বলেন, সরকারের ট্রেড পলিসিতে থাকা উচিত কোম্পানিগুলো দুই বছর পর পর কী বানাবে, কত পরিমাণ তৈরি করবে, তার তথ্য রাখা। তার জন্য কি প্রণোদনা থাকবে তা নির্ধারণ প্রয়োজন। আমাদের সব কিছুই অর্থনীতির চাকার সাথে ঘুরছে। অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী হওয়ায়, তাদেরও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়ে আসতে হবে। তৈরি পোশাক খাতে নারী কর্মী প্রবেশের কারণেই অর্থনীতির চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। বর্তমানে নারীদের চলতে হবে দ্রুত। তার সময়েরও দাম হয়েছে। তাড়াতাড়ি যেতে ব্যক্তিগত যানবাহন দরকার। এ জন্য স্কুটির প্রতি নারীদের আগ্রহ বাড়ছে।
নয়া দিগন্ত : সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর কি উদ্যোগ নেয়া দরকার?
হাফিজুর রহমান খান : সড়কে কোনো যানবাহনের শৃঙ্খলা নেই। মোটরসাইকেলের ধরন অনুযায়ী নিয়ম মানছে না কিছু কিছু ক্ষেত্রে। আমি যেহেতু মোটরসাইকেল তৈরি করি, এ জন্য আমারও খারাপ লাগে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আইনের শক্ত প্রয়োগ দরকার। সড়কে এত ধরনের যানবাহনের প্রয়েজান আছি কি-না, তা দেখা দরকার। আমরা অর্থনীতিতে এগিয়ে গিয়েছি, এখন সময় হয়েছে, রিকশা বন্ধের। রিকশা চালকদের পুনর্বাসন করা যেতে পারে। তাদের দ্রুত গতির বাহন দেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশে লাখ তিনেক কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে দেড় লাখ কাঁচা ও বাকি দেড় লাখ পাকা সড়ক। পাকা সড়কের মাত্র আট হাজার কিলোমিটার সড়ক হাইওয়ে, আন্তঃজেলা সড়ক হচ্ছে ১২ হাজার কিলোমিটার, এভাবে ২০ হাজার রাস্তা রয়েছে। এই দেড় লাখ পাকা সড়ক এখন অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে। মানুষের চলাচল বেড়েছে, বিভিন্ন কোম্পানির গড়ি চলাচল করছে, পণ্য পরিবহনে। গ্রামের সবজি এই রাস্তায় ঢাকায় আসছে। কাঁচা পাকা দেড় লাখ রাস্তায় কোন ধরনের যানবাহন চলবে, তার কোনো নির্দেশনা নেই। নছিমন, ইজিবাইক চলছে অনুমোদন ছাড়াই। বর্তমানে দেশে দশ লাখ ইজিবাইক রয়েছে। পাঁচ লাখ নছিমন, করিমন রয়েছে। তিন চাকার গাড়ির অনুমোদন নেই।
চলতে হবে, তাই চলছে। একটা নিয়ম মেনে চলার উপযোগী যানবাহন দিতে হবে। নইলে মানুষ যাতায়াত করবে কিভাবে। সময় হয়েছে এগুলোর সমাধান করার। এখন গতির যুগ, তাই নছিমন করিমন চলছে।
এখন আরো গতি সম্পন্ন গাড়ির প্রয়োজন। পরবর্তী ধাপে অর্থনীতিকে নিতে হলে সমাধান প্রয়োজন।
আমরা একটি সার্ভে করেছিলাম মানুষ এখন কি চায়। তারা বলেছিল, মাদক সমস্যা। সরকার কিন্তু বুঝতে পেরে তার বিরুদ্ধে নেমেছে। এখন রেজিস্ট্রেশন হওয়া মোটরসাইকেলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে মোটরসাইকেলের বাজার ছিল পাঁচ লাখ। গড়ে প্রতি বছর ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। আশা করি আরো পাঁচ বছর থাকবে। গত তিন বছর ধরে এই প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।
দেশে অনেক পুরনো মোটরসাইকেলও রয়েছে। দেশে বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখ মোটরসাইকেল চলাচল করছে। এখন সব কোম্পানিই ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে এসেছে। সরকারের প্রণোদনা পেয়ে রানার, সুজুকি, রোডমাস্টার, গ্রামীণ অনুমোদন পেয়েছে ম্যানুফ্যাকচারিং। বাংলাদেশে বর্তমানে ১২-১৩টি কোম্পানি রয়েছে মোটরসাইকেলের। আগামী পাঁচ বছরে ব্যাটারিচালিত গাড়ি একটি বড় জায়গায় চলে যাবে। দেশে হাইব্রিড গাড়ির চাহিদাও বাড়ছে।
নয়া দিগন্ত : মোটরসাইকেল শিল্পের সম্ভাবনা কেমন?
হাফিজুর রহমান খান : এদেশে মোটরসাইকেল তৈরিতে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ প্রতিষ্ঠান তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। মোটরসাইকেল রফতানির বাজার অনেক বড়। আমরা দু’টি দেশ নেপাল ও ভুটানে রফতানি করছি। শ্রীলঙ্কায় খুব দ্রুত যাবো। আফ্রিকান দেশগুলোতে কথাবর্তা চলছে। এ জন্য ভেন্ডার ডেভোলপ প্রয়োজন। কারণ, কম দামে পণ্য দিতে হবে। এটি ভেন্ডার না হলে সম্ভব নয়। আমদানি করে পণ্য রপ্তানি খরচ কমানো সম্ভব নয়। নেপাল দেড় শ’ সিসির উপরে গাড়ি চাচ্ছে। পাহাড়ি রাস্তার কারণে বেশি সিসির গাড়ির চাহিদা বেশি। আমরা সেটি বিবেচনা করেই মোটরসাইকেল তৈরি করছি।


আরো সংবাদ



premium cement