২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

ডলারের বিদায় কি আসন্ন?

-

ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, তখন তিনি যেন নিজের অজান্তেই মার্কিন সাম্রাজ্যের ওপর মারাত্মক আঘাত টেনে অনছেন। আর তা হলো বিশ্বের প্রধান রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলার পরিত্যক্ত হতে চলেছে। বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে ইউরোপ আস্থা হারাচ্ছে আন্তর্জাতিক অর্থ, বাণিজ্য, কূটনীতি ও যুদ্ধের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব প্রদানের সক্ষমতায়। এই দেশগুলো নীরবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সাত দশকের পুরনো মিত্রতার অবসান ঘটাচ্ছে এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলছে। বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থার এই পুনর্গঠন আমেরিকান সাম্রাজ্যের জন্য মারাত্মক হবে বলে অনেক আগেই মন্তব্য করেছেন ইতিহাসবিদ আলফ্রেড ম্যাককেই এবং অর্থনীতিবিদ মাইকেল হাডসন।
তাদের মতে, এতে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতিসহ একটি অর্থনৈতিক মৃত্যুর আগমন ত্বরান্বিত হবে। ফলে বিদেশে বিশাল সামরিক সঙ্ঘাত অনিবার্য হবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিক্ষিপ্ত হবে দীর্ঘায়িত মন্দায়। ট্রাম্প আমেরিকাকে আবার মহৎ করার পরিবর্তে নিজের অজান্তে সাম্রাজ্যের সবচেয়ে মারাত্মক কবর খননকারী হিসেবে অবির্ভূত হয়েছেন।
ট্রাম্প প্রশাসন ন্যাটো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসঙ্ঘ, বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফসহ বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে, অথচ এগুলোই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও বিশ্ব অর্থনৈতিক আধিপত্যকে টিকিয়ে রেখেছে। ম্যাককয় বলেন, মার্কিন সাম্রাজ্য একটি সঙ্কর। তিনি লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক শাসনের একটি স্বতন্ত্র রূপ, যা প্রাচীন ও আধুনিক বিভিন্ন সাম্রাজ্যের দিকগুলো নিয়ে গঠিত। এই অনন্য মার্কিন সাম্রাজ্য মিত্রদের সাথে জোট গঠনের ক্ষমতার দিক দিয়ে এথেন্সের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। তা বিশ্বজুড়ে সামরিক ঘাঁটির ওপর নির্ভরতার দিক দিয়ে রোমান এবং বিশ্বব্যাপী সংস্কৃতি, বাণিজ্য ও জোটগুলোকে নিয়ে একটি সামগ্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার আকাক্সক্ষার দিক দিয়ে ব্রিটিশ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
জর্জ ডব্লিউ বুশ যখন ইরাক আক্রমণ করেছিলেন, তখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্তর্জাতিক আইন ও ঐতিহ্য লঙ্ঘন করে ধ্বংসলীলা শুরু করেছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প এই সঙ্কট গভীরতর করেছেন। ২০১৫ সালের ইরানি পরমাণু চুক্তি থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রত্যাহার, যদিও ইরান চুক্তিটি মেনে চলতে থাকে এবং ইউরোপীয় দেশগুলোকেও প্রত্যাহার করতে বলা, নইলে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার হুমকি দেয়ার ফলে ইউরোপীয় দেশগুলোকে বিরূপ করে এবং তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে বিকল্প মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। ইরান আর আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের জন্য ডলার গ্রহণ করছে না এবং পরিবর্তে ইউরো গ্রহণ করছে। এটি তেহরানের সাথে ওয়াশিংটনের গভীর বৈরিতার একটি ছোট উপাদান নয়।
তা ছাড়া, তুরস্ক ডলার পরিত্যাগ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে যে, জার্মানি ও ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো রাশিয়ার গ্যাস আমদানি বন্ধ করুক। একইভাবে ইউরোপীয়রা ওয়াশিংটনকে উপেক্ষা করে। চীন ও রাশিয়া এখন ডলার থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য কাজ করছে। মস্কো তার রিজার্ভ ১০০ বিলিয়ন ডলারকে চীনা ইউয়ান, জাপানি ইয়েন ও ইউরোয় রূপান্তর করেছে। ২০১৪ সাল থেকে বিদেশী সরকারগুলো আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের সোনার রিজার্ভ সংরক্ষণ করছে না, ফেডারেল রিজার্ভ থেকে এগুলো সরিয়ে নিচ্ছে। জার্মানি তার ৩০০ টন সোনা ফেরত নিয়েছে। নেদারল্যান্ডস তার ১০০ টন ফেরত নিয়েছে।
ভেনিজুয়েলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ, চীনের সাথে সম্ভাব্য বাণিজ্য যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক জলবায়ু চুক্তি থেকে প্রত্যাহার, ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস (আইএনএফ) চুক্তি থেকে প্রত্যাহার, ওয়াশিংটনের অচলাবস্থা এবং ইরানের সাথে বৈরিতা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিরাট আঘাত। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও আর্থিক নীতি মাইক পম্পেও জন বোল্টন এবং ইলিয়ট আব্রামসের কাছে বন্দী।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী কার্যকরভাবে যে অর্থনৈতিক আধিপত্য গড়ে তুলেছিল, তা থেকে নিজেদের মুক্ত করার চেষ্টা করছে বিভিন্ন দেশ। ডলারের জন্য এটা মোটেই সুখবর নয়। কেননা বিশ্বে আরো বিশৃঙ্খলা বাড়তে পারে। ডলারের কোণঠাসা হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। সমাজতন্ত্রীরা নয়, ট্রাম্প ও তার কট্টর মতাদর্শীরাই যে পুঁজিবাদের পতন ঘটাচ্ছেন, এতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বিশ্লেষকেরা।
ঐতিহাসিক রোনাল্ড রবিনসন যুক্তি দেন যে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ‘মারা গিয়েছিল যখন ঔপনিবেশিক শাসকেরা স্থানীয় সহযোগীদের হাতছাড়া করেছিল।’ তিনি উল্লেখ করেন, ফলস্বরূপ এই অসহযোগ উপনিবেশগুলোর পতনের সময় নির্ধারণ করেছিল। তার মতে, ঐতিহ্যবাহী মার্কিন সহযোগীদের বিচ্ছিন্নতার এই প্রক্রিয়া একই প্রভাব ফেলবে। ম্যাককয়ের মতে, ‘সব আধুনিক সাম্রাজ্য নিজেদের শক্তিকে স্থানীয় পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্থানীয় অনুগতদের ব্যবহার করেছে। অর যখন স্থানীয় প্রভাবশালীরা জাগতে ও কথা বলতে শুরু করেছিল এবং তাদের নিজস্ব এজেন্ডা নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে, তখন আলোচনায় চলে আসে সাম্রাজ্যগুলোর পতনের বিষয়।’
এ দিকে প্রথমবারের মতো আমেরিকার জাতীয় ঋণের পরিমাণ ২২ ট্রিলিয়ন (লাখ কোটি) ডলার ছাড়িয়েছে। এ ঋণের পরিমাণ ২২.০১ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে বলে মার্কিন অর্থ বিভাগের মঙ্গলবারের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। ফলে ডলারের ওপর থেকে দেশগুলোর আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে।
২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি মাসে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার সময় জাতীয় ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯.৯৫ ট্রিলিয়ন ডলার। মার্কিন সরকারের বাজেট ঘাটতির পরিমাণ ২.০৬ ট্রিলিয়ন ডলার বেড়েছে। এতে হুমকিতে পড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ।
কর হ্রাস এবং অভ্যন্তরীণ ও সামরিক কর্মসূচিতে ব্যয়বৃদ্ধির কারণে মার্কিন সরকারের ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ট্রাম্পের ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার কর কর্তন এবং অভ্যন্তরীণ ও সামরিক কর্মসূচির জন্য ব্যয় বাড়ানোর ফলে গত বছর কংগ্রেসের কর্মকাণ্ডের কারণে ঋণের পরিমাণ দ্রুতগতিতে চলছে।
জাতীয় ঋণ বার্ষিক বাজেট ঘাটতির সমষ্টি। কংগ্রেসীয় বাজেট অফিস পরিকল্পনা করেছেÑ এ বছরে ঘাটতি হবে ৮৯৭ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ গত বছরের ৭৭৯ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতির চেয়ে ১৫.১ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। সিবিও ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, আগামী কয়েক বছরে ঘাটতি ক্রমেই বাড়বে। ২০২২ সালে ঘাটতি ১ ট্রিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে এবং ২০২৯ সাল পর্যন্ত ঘাটতি ১ ট্রিলিয়ন ডলারের নিচে নামবে না।
ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করে যে, তাদের কর কর্তন শেষ পর্যন্ত দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করতে অর্থের জোগান দেবে। অনেক অর্থনীতিবিদ এটির সমালোচনা করেন। কিছু বাজেট বিশেষজ্ঞ সতর্ক করে দিয়েছেন, ক্রমবর্ধমান রাষ্ট্রীয় ঋণ সরকারকে যথেষ্ট ঝুঁকিতে ফেলবে। কারণ, এটি কর কর্তন বা খরচ বৃদ্ধির মাধ্যমে আর্থিক সঙ্কট কাটিয়ে ওঠাকে আরো কঠিন করে তুলতে পারে।
মার্কিন থিংকট্যাংক পিটার জি পিটারসন ফাউন্ডেশনের প্রধান মাইকেল পিটারসন বলেছেন, জাতীয় ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে। এতে প্রত্যেক মার্কিন নাগরিকের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ হুমকিতে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ এখন জিডিপির ১০০ শতাংশের বেশি, অর্থনীতিবিদদের জন্য যা একটি লাল সঙ্কেত। ম্যাককয় বলেন, আমাদের বৃহদায়তন বাণিজ্য ঘাটতি পূরণ নির্ভর করে বিদেশে ট্রেজারি বন্ড বিক্রির ওপর। একবার সেই বন্ডগুলোর মূল্য কমে গেলে এবং আর স্থায়ী বিনিয়োগ বিবেচনা করা না হলে ডলারের ব্যাপক অবমূল্যায়ন হবে। এই প্রক্রিয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। সেন্ট্রাল ব্যাংকের রিজার্ভে ২০০৪ এর তুলনায় কম ডলার রয়েছে।
২০১৫ সালের তুলনায় ডলারে আন্তঃব্যাংক তহবিলের স্থানান্তর-বিনিময়ের পরিমাণ কম হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অর্ধেক ডলারে বিনিময় হয়। এ দিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ কেবল ১০ শতাংশ।
ব্যাংক অব ইংল্যান্ড গভর্নর মার্ক কার্নি গত মাসে ঘোষণা করেছিলেনÑ ‘অবশেষে মার্কিন ডলার বাদ দিয়ে আমাদের রিজার্ভ মুদ্রা থাকবে।’
বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডারের শতকরা ৬১ ভাগ ডলার। যদি এই ডলারের রিজার্ভগুলো অন্যান্য মুদ্রা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, তাহলে ডলার প্রত্যাহার ত্বরান্বিত হবে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক নীতিমালার অচলতা কেবল সঙ্কটকে আরো বাড়িয়ে তুলবে। হাডসন ইনস্টিটিউটের ইরউইন এম স্টেলজার সম্প্রতি বলেন, ‘যদি সীমাহীন ঋণ, অর্থ মুদ্রণ করে অর্থায়ন করা সমৃদ্ধির পথ হয়, তাহলে তখন ভেনিজুয়েলা ও জিম্বাবুয়ে প্রবৃদ্ধি সূচকের শীর্ষস্থানে থাকবে।’

 


আরো সংবাদ



premium cement
অবন্তিকার আত্মহত্যা : জবির সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের জামিন আবারো নামঞ্জুর পাথরঘাটায় বদর দিবস পালনে দেড় হাজার মানুষের ইফতারি আদমদীঘিতে ৭২ হাজার টাকার জাল নোটসহ যুবক গ্রেফতার সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান মির্জা ফখরুলের জলবায়ু সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পদক্ষেপ নেয়া হবে : মন্ত্রী গাজীপুরে গাঁজার বড় চালানসহ আটক ২ দুই ঘণ্টায় বিক্রি হয়ে গেল ২৫০০ তরমুজ ড. ইউনূসের ইউনেস্কো পুরস্কার নিয়ে যা বললেন তার আইনজীবী একনেকে ৮৪২৫ কোটি টাকার ১১ প্রকল্প অনুমোদন সান্তাহারে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে যুবক নিহত জলবায়ু সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পদক্ষেপ নেয়া হবে : আব্দুর রহমান

সকল