১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পুঁজিবাজার : প্রয়োজন কারসাজি চক্রের বিচার

-

কোথাও অপরাধের বিচার সুনিশ্চিত হওয়া প্রমাণ করে আইনের শাসন রয়েছে। এটি সুশাসনের প্রতিষ্ঠাও। যেখানে এটি আছে, সেখানে অপরাধের মাত্রাও তুলনামূলক হয়। অপরাধের ধরন ও মাত্রা অনুযায়ী একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই দণ্ড বা শাস্তির পরিমাপ নির্ধারণ করে আদালত। এভাবে আইনের শাসন প্রাতিষ্ঠানিকতা পায়। পুঁজিবাজারে দুষ্টচক্র হিসেবে পরিচিত শেয়ার কারসাজির সঙ্গে জড়িতদেরও বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন। আদালতের বাইরে গিয়ে শুধু জরিমানা করার প্রবণতা পুঁজিবাজারে সুশাসন ফিরিয়ে আনা দুরূহ ব্যাপার। অন্তত দেশের অতীত ইতিহাস তাই বলে।
পুঁজিবাজার উন্নয়ন ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বাজারের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাসমূহ বিভিন্ন প্রকার উদ্যোগ নিয়ে আসছে বিভিন্ন সময়। এজন্য পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) বিশেষ ক্ষমতাও দেয়া হয়েছে। যা আর্থিক খাতের অন্য কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এভাবে দেয়া হয়নি। এটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিএসইসির স্বাতন্ত্র্যকেই শুধু নয়, বিনিয়োগকারীদের ভরসার জায়গাকে সমৃদ্ধ করার প্রতীক হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। এর সাথে বাজার উপযোগী একাধিক আইন ও বিধি প্রণয়ন করা হয়েছে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। সবই করা হয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে।
আইন অনুযায়ী বিএসইসির অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থকে সমুন্নত রাখা। এ দায়িত্ব পালন সহজ করতে সর্বশেষ পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট অপরাধের দ্রুত বিচার করতে গঠন করা হয়েছে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। সুশাসন নিশ্চিতের মাধ্যমে বাজার উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় এমন পদক্ষেপ প্রশংসা কুরিয়েছে সবার।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনের দিকে তাকালে দেখা যায়, বিশ্বের প্রতিটি বাজারেই কারসাজি চক্রের উপস্থিতি রয়েছে। বলা যায়, কারসাজি চক্র এখন পুঁজিবাজারের অনুষঙ্গ হয়ে গেছে। এটি বিবেচনায় নিয়েই বিভিন্ন দেশের পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কারসাজি চক্রকে দৃশ্যমান কোনো তৎপরতায় আসতে দেয় না। কারসাজি চক্র দৃশ্যমান হলেই তাদের দমনে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়। ফলে এখন পুঁজিবাজারের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কারসাজি চক্রের তেমন কোনো সংবাদ বা তথ্য পাওয়া যায় না।
কিন্তু দেশের পুঁজিবাজারে শেয়ার কারসাজি চক্রের দৌরাত্ম কমেনি কাক্সিক্ষতভাবে। বাংলাদেশের বিকাশমান পুঁজিবাজারের গভীরতা তুলনামূলক ছোট হলেও কারসাজি চক্রের দৃশ্যমান উপস্থিতি রয়েছে। সঙ্ঘবদ্ধ এ চক্রের দৌরাত্ম প্রায়ই বাজারকে প্রভাবিত করছে। পুঁজিবাজারের ইতিহাসে এদের কারণেই ১৯৯৬ ও ২০১০ সালে পরপর দুই বার মহাধস নেমেছে। মহাধসের সেই ক্ষত এখনও সারেনি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। কারসাজি চক্রের কারণেই বর্তমান সরকার দু’বার লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর কাছে বিরাগভাজন হয়েছে।
কারসাজি চক্রের দৌরাত্ম কমাতে সাম্প্রতিক বছরে বিএসইসি শতাধিক কোম্পানি, উদ্যোক্তা-পরিচালক, প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিরুদ্ধে বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। কারণ দর্শানোর নোটিশ, সতর্কতা জারি ও গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছে। দৃশ্যমান এসব পদক্ষেপের তেমন কোনো সুফল পায়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো। এর পেছনে সিদ্ধান্ত নিতে কালক্ষেপণই মূলত দায়ী। যা বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা হচ্ছে নিয়মিত।
এমনকি শেয়ার কারসাজির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরাও। সর্বশেষ পুঁজিবাজারের বিদ্যুৎ খাতের কোম্পানি শাহজিবাজার কোম্পানির শেয়ারে কারসাজি করে কৃত্রিমভাবে দর বৃদ্ধির ঘটনায় দায়ে দুই ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করে বিএসইসি। ব্যক্তি দু’জনকে আশি ও ৫০ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। প্রতিষ্ঠানটিকে এক কোটি টাকার জরিমানা হয়। আর্থিকভাবে জরিমানা করার পূর্বে তাদের বিরুদ্ধে কারসাজির ঘটনা প্রমাণ পাওয়ায় বিএসইসি মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু অপরাধীদের অনুরোধে মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে আর্থিকভাবে জরিমানা করে বিএসইসি।
ব্যক্তি হিসেবে জরিমানার অঙ্ক নেহায়ত কম নয়। তবুও প্রশ্ন থেকে যায় ট্রাইব্যুনাল গঠনের উদ্দেশ্য নিয়ে। অপরাধীর বিচার যদি আদালতের বাইরে হয়, তাহলে ন্যায্য বিচার হওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন ওঠে।
সেখানে বিচারের চেয়ে ব্যক্তি রক্ষার চেষ্টা হতে পারে। প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপ করার সুযোগ তৈরি হয়। আদালতের গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। এক সময় হয়তো প্রশ্ন উঠবে, আদালতেরই প্রয়োজন নেই।
আদালতে অপরাধীর বিচার হয় একটি আইনানুগ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে। সেখানে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনিও তার পক্ষে সাফাই পেশ করতে পারেন। দুই পক্ষের দলিল, যুক্তি ও প্রমাণের সত্যতা যাচাই-বাছাই করতে পারে আদালত। এ বিসয়ে বিচারকগণ পেশাগতভাবেও দক্ষ। একটি প্রতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই বিচারের রায় আসে। কিন্তু আদালতের বাইরে বিচার হলে প্রাতিষ্ঠানিকতা রক্ষা হয় না।
লাখ লাখ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থকে লুণ্ঠিত করে শেয়ার কারসাজি চক্র। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত করে তারা লাভবান হয়। এতে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা চলে যায়। বিনিয়োগকারী যখন কারসাজিতে লিপ্ত হয় তখন আর তিনি বিনিয়োগকারী থাকেন না। এজন্য বিশ্বাস ভঙ্গের দায়ে তার বা তাদের শাস্তি হওয়াই আবশ্যক। এটি আদালতের মাধ্যমে হলে কোনো প্রশ্ন ওঠে না। আদালতের মাধ্যমে বিচার হলেই একমাত্র সুশাসন সম্ভব।
অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক দণ্ড নিশ্চিত করলে এক পর্যায়ে শেয়ার কারসাজিতে কেউ উৎসাহী হবে না। আর্থিক দণ্ডের চেয়ে কারসাজিতে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ বেশি হলে, সঙ্ঘবদ্ধ চক্র কারসাজির পথ থেকে বেরিয়ে আসবে না বলেই অতীতে দেখা গিয়েছে।
একই সাথে অপরাধের বিচার ও দণ্ডের বিষয়টি আরো প্রচারের প্রয়োজন। সাধারণ বিনিয়োগকারীদেও সচেতনতা বৃদ্ধিতে এমন পদক্ষেপ ভূমিকা রাখবে। শাস্তি নিশ্চিত হলে, নতুন করে কেউ অপরাধে জড়ানোর সাহস করবে না। এমনটিই হয়ে আসছে বিভিন্ন দেশে। পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাকেও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আদালতকে সহযোগিতা করা উচিত। বর্তমানে বাজারের সবচেয়ে বড় ঘাটতির জায়গা হচ্ছে আস্থার বিষয়টি। এটি নিশ্চিত করলে বিকাশমান অর্থনীতির সাথে পুঁজিবাজার এগিয়ে যাবে। নিরাপদ বিনিয়োগের ক্ষেত্র হবে দেশের পুঁজিবাজার।

 


আরো সংবাদ



premium cement