২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`
নয়া দিগন্তের সাথে সাক্ষাৎকারে আইআইডিএফসির এমডি

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন

-

মো: গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফিন্যান্স কোম্পানির (আইআইডিএফসি) বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এর আগে তিনি ন্যাশনাল ফিন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ছিলেন। এ ছাড়া এআইবিএল ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের সিইও ও বিএমএসএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে স্নাতক ও ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জনকারী গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়ার ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) ও বিনিয়োগ ব্যাংকিং শিল্পে ৩০ বছরের বেশি কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি জিএসপি ফিন্যান্সের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা ও মাইডাস ফিন্যান্সিং লিমিটেডের জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক ছিলেন। উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও ক্ষদ্র্র ব্যবসায় পরিচালনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সার্টিফায়েড প্রশিক্ষক গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, আইবিএ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন ও এমবিএ ক্লাব লিমিটেডের আজীবন সদস্য। তিনি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের বিভিন্ন বিষয়ে নয়া দিগন্তের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশরাফুল ইসলাম।
নয়া দিগন্ত : আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকিং খাতে তারল্যসঙ্কট চলছে। আইআইডিএফসির অবস্থা কী?
গোলাম সরওয়ার : আমানত সংগ্রহ করে বিনিয়োগ করতে তহবিল ব্যবস্থাপনায় আমাদের প্রতিষ্ঠান লংটার্ম পরিকল্পনা নিয়ে থাকে। তিন থেকে ছয় মাস আগেই বিনিয়োগ নিয়ে পরিকল্পনা নেয়া হয়। সেভাবেই আমানত সংগ্রহ করার চেষ্টা করি আমরা। বর্তমানে যে তারল্যসঙ্কট চলছে, তা আমরা গত নভেম্বর মাসেই বুঝতে পেরেছিলাম। পূর্বাভাস দিয়ে আগাম প্রস্তুতি নিয়েছিলাম আমরা। এ জন্য আমাদের তারল্যসঙ্কট হয়নি।
নয়া দিগন্ত : বর্তমানে কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। কেন এমনটি হলো? আর্থিক খাতে এর প্রভাব কী?
গোলাম সরওয়ার : এটা ঠিক কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমস্যায় পড়েছে। যারা সমস্যায় পড়েছে, তারা হয়তো পূর্বপ্রস্তুতি নেয়নি। যদিও আমরা স্বল্পমেয়াদে ব্যাংক, আমানতকারী ও কলমানি মার্কেট থেকে আমানত নিয়ে থাকি। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকেও আমানত সংগ্রহ করে থাকি। এ ছাড়া ব্যক্তি পর্যায়ের আমানত সংগ্রহ করছি বেশি করে। ব্যক্তি পর্যায়ের আমানতের স্থায়িত্ব বেশি হয়। হঠাৎ করেই তুলে নেয় না, যেটা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো করে থাকে। তারল্যসঙ্কটে যারা ভুগছে, তারা হয়ত, স্বল্পমেয়াদে আমানত সংগ্রহ করে দীর্ঘ মেয়াদের বিনিয়োগ করেছে। এতে মূলধনে মিচম্যাচ হয়েছে। অনেকের খেলাপি ঋণ বেড়ে গিয়েছে। এটা তারা প্রকাশ করতে পারছে না।
পাঁচ-সাতটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যথাসময়ে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে না পারলে, পুরো আর্থিক বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এটি ব্যাংকিং খাতের বেলায়ও হয়। সম্প্রতি একটি ব্যাংকের তারল্যসঙ্কটের কারণে পুরো ব্যাংকিং খাতে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশে কার্যরত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমিতির বৈঠকেও আলোচনা হয়েছে। আমরা এটি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গেও বৈঠক করার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পরিস্থিতি থেকে কিভাবে উত্তোরণ ঘটানো যায় তা নিয়ে আলোচনা করা হবে।
নয়া দিগন্ত : সম্প্রতি ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোরও একই অবস্থা। খেলাপি ঋণ মুনাফার ওপর কেমন প্রভাব পড়ছে?
গোলাম সরওয়ার : সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে এটা ঠিক। খেলাপি ঋণের অর্থ না পেলে প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগকারীদের যথাসময়ে মুনাফাসহ আমানত ফেরত দিতে পারে না। এটা আমানতকারীদের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা তৈরি করে। তা গ্রাহকদের মাঝে ছড়িয়ে যায়। ওই প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থাহীনতা তৈরি হয়, যা পুরো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুনামের ওপর প্রভাব পড়ে।
নয়া দিগন্ত : আগামী মার্চের মধ্যে ঋণ আমানতের অনুপাত (এডিআর) সাড়ে ৮৩ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। ব্যাংকের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এর প্রস্তুতি কী?
গোলাম সরওয়ার : এটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পড়ে না। আমরা ভিন্নভাবে হিসাবটি করি। ব্যাংকগুলোর বেলায় এটি প্রযোজ্য। কিছু ব্যাংক করতে পারেনি এখনো। যদি সময় বাড়ানো না হয়, তাহলে আমানত বাজারে প্রভাব পড়বে। বিতরণ করা ঋণ তো হুট করেই ফেরত আনা যাবে না। এডিআর সমন্ব করতে হলে, আমানত সংগ্রহ বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে আমানতের বাজার সীমিত। আমানত সংগ্রহ করতে অনেক ব্যাংকই সুদের হার বাড়িয়ে দেবে। এতে তহবিল ব্যয় বেড়ে গিয়ে সুদের হার বৃদ্ধি পাবে। ঋণ সুদ বাড়লে পণ্য উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। যার ফলে পণ্যের দামও বৃদ্ধি পাবে। এভাবেই মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাবে। এ জন্য সুদের হার একটি যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। বিষয়টি সরকারকেও দেখতে হবে।
নয়া দিগন্ত : ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংক (বিএবি) ঘোষণা অনুযায়ী ৬ ও ৯ শতাংশ হারে সুদহার বাস্তবায়ন কি সম্ভব?
গোলাম সরওয়ার : বাংলাদেশের অর্থনীতি চলে মুক্তবাজার অর্থনীতির আদলে। এখানে সুদের হার নির্ধারণ হয় চাহিদা ও সরবরাহের ওপর। সুদের হার বেঁধে দেয়ার সুযোগ নেই। জোর করে কিছু কার্যকর করা যায় না। তাহলে ঋণ বিতরণ বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা বিষয়টি বুঝতে পেরেই আমানতকারীদের বুঝিয়েছি আপনি চাইলেই আমানত ফেরত নিতে পারবেন। আমানত ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছি।
নয়া দিগন্ত : বর্তমানে আইআইডিএফসির অবস্থা কী?
গোলাম সরওয়ার : দেশের প্রথম অর্থসচিব মো: মতিউল ইসলামের উদ্যোগে দশটি ব্যাংক, তিনটি বীমা ও আইসিবি নিয়ে প্রায় দেড় যুগ আগে প্রতিষ্ঠিত হয় আইআইডিএফসি। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই আমাদের একটি সুনাম আছে যথাসময়ে মেয়াদ শেষে আমানত ফেরত দেয়া। ১০ থেকে ৫০ কোটি টাকার আমানত মেয়াদপূর্তি শেষে গ্রাহক ফেরত পেয়েছে। কোনো গ্রাহক এখনো টাকা চেয়ে নিরাশ হননি। এটি আমাদের ঐতিহ্য। এ জন্য অন্য প্রতিষ্ঠানে ১২ শতাংশ সুদ পেলেও তুলনামূলক কম সুদে গ্রাহকরা আমানত রাখছেন আমাদের প্রতিষ্ঠানে।
নয়া দিগন্ত : বর্তমান পরিস্থি উত্তরণের উপায় কী?
গোলাম সরওয়ার : বর্তমানে প্রধান চ্যালেঞ্জ এডি রেশিও সমন্বয়, তারলসঙ্কট দূর করা। আমানত না পেলে সুদের হার বেড়ে যাবে। আমানত বাজারে সুদের হার যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসাটা বড় চ্যালেঞ্জ। পরিস্থিতি উত্তরণের উপায় হলো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। আমানতের সুদের হার যাতে না বাড়ে সে জন্য এডি রেশিও সমন্বয়রে সময় বাড়িয়ে দিতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। খেলাপি ঋণ আদায় বৃদ্ধি জোর করতে হবে। ইচ্ছেকৃত খেলাপি যাতে নতুন করে কেউ না হয়, সে জন্য তদারকি বাড়াতে হবে।
নয়া দিগন্ত : সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
গোলাম সরওয়ার : আপনাকেও ধন্যবাদ।

 


আরো সংবাদ



premium cement