২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অর্থনীতিতে নতুন বছরের চ্যালেঞ্জ

-

বিদায়ী বছর নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে পার করল বাংলাদেশের অর্থনীতি। ব্যাংকিং খাতে নগদ আদায় কমে যাওয়ায় পাহাড় ছুঁয়েছে খেলাপি ঋণ। কমে গেছে আমানত প্রবাহ। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। এতে বেড়ে গেছে সরকারের ব্যাংক ঋণ। ব্যাংকে নগদ টাকায় টান পড়ায় বেড়ে গেছে ব্যবসায় ব্যয়। গুণগত বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটছে না। অর্থনীতির নেতিবাচক অবস্থার মধ্যেই শুরু হয়েছে নতুন বছর। বিগত বছরের অর্থনৈতিক সূচকগুলোর গতি অব্যাহত থাকলে নতুন বছরে সরকারকে অর্থনীতির নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হবে। এই চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করা, উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন, সরকারের মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন জোরদারকরণ এবং সর্বশেষ ব্যাংকিং খাতে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ আদায়। এর পাশাপাশি অর্থনৈতিক বৈষম্যও কমিয়ে আনতে হবে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় ব্যর্থ হলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে।
বিদায়ী বছরে ব্যাংকিং খাতের সেরা চমক ছিল ঋণের সুদ হার সিঙ্গেল ডিজিটে অর্থাৎ ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা। বেশির ভাগ ব্যাংক বাস্তবায়ন করতে না পারলেও নানাভাবে প্রভাব ফেলে এ ঘোষণা। আর এ প্রেক্ষাপট তৈরি হয় ব্যাংক উদ্যোক্তাদের চাপে আমানতকারীদের আমানত সুরক্ষা করতে বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার (সিআরআর) ১ শতাংশ কমানো, পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবার থেকে দুইজনের পরিবর্তে চারজন পরিচালক থাকা, পরিচালকদের মেয়াদ ছয় বছর থেকে বাড়িয়ে ৯ বছর করা, সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতে বেশি হারে ভাগবসানোসহ নানা দাবি আদায় করার পর। এ ছাড়া সারা বছর আলোচনায় ছিল উচ্চ হারের খেলাপি ঋণ, খেলাপি ঋণের কারণে প্রভিশন ঘাটতি, ধারাবাহিকভাবে মূলধন ঘাটতি, ডলার ও নগদ টাকার সঙ্কট। বছরের শেষপ্রান্তে এসে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির ব্যাংক খাত থেকে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকার লোপাট হওয়ার তথ্য এবং নতুন ব্যাংক অনুমোদনের খবরও আলোচনায় ছিল। সব মিলে বিদায়ী বছরটি ব্যাংক খাতে খুব স্বস্তিজনক অবস্থায় ছিল না।
নতুন বছরে ব্যাংকিং খাতের জন্য আমানত সংগ্রহই হবে মূল চ্যালেঞ্জ। আমানতের সুদ হার কমে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এতে কমে গেছে আমানতের প্রবৃদ্ধি। কিন্তু ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেনি, বরং তুলনামূলকভাবে বেড়ে গেছে। পরিস্থিতি উন্নতি না হলে তহবিল ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়ার আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত নভেম্বরে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। কিন্তু ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ শতাংশের উপরে। অর্থাৎ আমানত যে হারে বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে ঋণের প্রবৃদ্ধি। ব্যাংকাররা আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন সঞ্চয়পত্রের ঋণের সুদ। সঞ্চয়পত্রের ঋণের সুদ আমানতের সুদহারের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি। এ কারণে বেশি মুনাফার আসায় আমানতকারীরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছেন। আবার কেউবা পুঁজিবাজারসহ ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করছেন। এতে কমে গেছে আমানতপ্রবাহ। আবার কেউবা বলছেন, ভালো বিনিয়োগকারী না পাওয়ায় ব্যাংকগুলোর ঋণ নিরাপদে রাখতে সরকারের দীর্ঘ মেয়াদের বিল বন্ডে বিনিয়োগ করছে। ফলে এক দিকে যেমন আমানত কমেছে, অন্যদিকে তহবিল সরকারের কোষাগারে দীর্ঘ মেয়াদে আটকে গেছে। ফলে বছরের শেষ সময়ে এসে আর্থিক খাতে নগদ টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেট সরকার একটি উচ্চাভিলাষী রাজস্ব আদায়ের টার্গেট নির্ধারণ করেছে। ১২ মাসে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্য ধরা হয়েছে দুই লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। এনবিআরের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ের কথা ছিল ৭৮ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। কিন্তু এ সময়ে রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হয়েছে ৬২ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। ফলে চার মাসে রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। এর ফলে এ সময়ে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ। গত বছর একই সময়ে যা ছিল ১৭ শতাংশ। রাজস্ব ঘাটতির কারণে বছরের বাদবাকি সময়ে সরকারকে রাজস্ব আদায়ে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে বছর শেষে রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি ৪০ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা হতে পারে বলে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি (সিপিডি) মনে করে।
চলতি অর্থবছরে এডিপিতে বরাদ্দ রয়েছে এক লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। পরিকল্পনা কমিশনের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী অর্থবছরের পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) এডিপি অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয়েছে ৩৬ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা। কিন্তু এ সময়ে এডিপির অর্থ ব্যয় করার কথা ছিল ৭৩ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে পাঁচ মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ২০ শতাংশ। চলতি বছরেও একই সময়ে এ হার ২০ শতাংশের ঘরেই রয়েছে। নতুন বছরে কাজের গুণগতমান বজায় রেখে এডিপির অর্থ ব্যয় করা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে বলে মনে করেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা। অর্থবছরের শেষ দিকে তাড়াহুড়ো করে এডিপি বাস্তবায়ন করা হলে তার যেমন গুণগত মান রক্ষা হয় না, তেমনি ঘটে অর্থের অপচয়ও।
ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ আদায় সরকারের জন্য চলতি বছরের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে। দীর্ঘ দিনের পুঞ্জীভূত এই ঋণ এখন পাহাড় ছুঁয়েছে। বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে দেশের ব্যাংকিং খাতে অবলোপনসহ খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৫০০ শতাংশ। আর অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৩০০ শতাংশ। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে। তখন ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। আর ঋণ অবলোপন ছিল প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। সব মিলে সামগ্রিক খেলাপি ঋণ ছিল প্রায় সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে অবলোপনসহ খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা আট লাখ ৬৮ হাজার সাত কোটি টাকার ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। আর এ সময়ে অবলোপন হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবে প্রকৃত খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে দেড় লাখ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের অর্ধেকটার সরকারি বিভিন্ন ব্যাংকের। বিশাল পরিমাণ খেলাপি ঋণের কারণে ১২টি ব্যাংকে প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে। সরকারের এই খেলাপি ঋণ নতুন বছরে কতখানি আদায় করতে পারবে তার ওপর অর্থনীতি তথা ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা নির্ভর করছে। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, এই খাতে সাফল্য পাওয়া বেশ কষ্টকর।
চলতি অর্থবছরে সরকারের জন্য আরেক চ্যালেঞ্জ হচ্ছে হাতে নেয়া বড় বড় মেগা প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করা সম্ভব হবে কি না। কারণ পরিসংখ্যান বলছে, নির্ধারিত সময় থেকে অনেক পিছিয়ে বেশির ভাগ মেগা প্রকল্প। উদাহরণ হিসেবে দেয়া যায়, সরকারের সবচেয়ে বড় মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল গত ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি, নভেম্বর পর্যন্ত সেতু প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৬১ শতাংশ। একইভাবে সরকারের অন্যান্য মেগা প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা সেতু রেলসংযোগ, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও চট্টগ্রাম রেলপথ প্রকল্প এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হার ১৫ শতাংশ। আর মেট্রোরেলের প্রকল্পের অগ্রগতি ১৬ শতাংশের কাছাকাছি বলে জানা গেছে। চলতি নতুন বছরে এই প্রকল্পগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন করা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে। দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, কিন্তু একই সাথে বেড়ে যাচ্ছে আয়বৈষম্য। এই বৈষম্য চলতি বছরে কিভাবে কমানো যায় তা সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে। হ


আরো সংবাদ



premium cement
আরো ৩ দিনের হিট অ্যালার্ট তাপপ্রবাহ মে পর্যন্ত গড়াবে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে ঢাকার ভূমিকা চায় যুক্তরাষ্ট্র বিদ্যুৎ গ্যাসের ছাড়পত্র ছাড়া নতুন শিল্পে ঋণ বিতরণ করা যাবে না মিয়ানমারে ফিরল সেনাসহ আশ্রিত ২৮৮ জন বিএনপি ক্ষমতায় যেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে : কাদের রোববার থেকে স্কুল খোলা : শনিবারও চলবে ক্লাস যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বরাজনীতির মঞ্চ থেকে সরিয়ে আনতে চান ট্রাম্প : বাইডেন কলিং ভিসায় প্রতারণার শিকার প্রবাসী দেশে ফেরার সময় মারা গেলেন চট্টগ্রামে পুলিশ হেফাজতে দুদক কর্মকর্তার মৃত্যু ভারতীয় ৫২৭ খাদ্যপণ্যে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী রাসায়নিক পেয়েছে ইইউ তীব্র তাপদাহের জন্য দায়ী অবৈধ সরকার : মির্জা আব্বাস

সকল