২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দুর্বল শেয়ারের দৌরাত্ম্য

-

সদ্যবিদায়ী ২০১৮ সালে দেশের পুঁজিবাজারে স্বল্প মূলধনী কোম্পানির শেয়ারদর বৃদ্ধি ছিল পুঁজিবাজারে আলোচনার বিষয়। স্বল্প মূলধনী এসব কোম্পানির প্রায় পুরো অংশই বর্তমানে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে উৎপাদন বন্ধ, লোকসান গুনছে, বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতে না পারায় তাদের অবস্থান হয়েছে সবচেয়ে নি¤œ ক্যাটাগরি বলে বিবেচিত ‘জেড ক্যাটাগরিতে’। গত বছরের শেষপ্রান্তে জাতীয় নির্বাচন হয়। এর পর থেকেই ফের এসব কোম্পানির দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব কোম্পানি ঘিরেই পুঁজিাবাজারে সৃষ্টি হয়েছে একটি সঙ্ঘবদ্ধ চক্র। এ চক্রের সদস্যদের কেউ কেউ রাজনৈতিক দলের সমর্থক বলে নিজেদের পরিচয় দেন।
দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) বর্তমানে ‘জেড’ ক্যাটাগরির কোম্পানির সংখ্যা ৪৪টি। এসব কোম্পানির শেয়ারকে পচা বা সব থেকে দুর্বল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিনিয়োগ অযোগ্য হিসেবে পরিচিতি তুলে ধরতেই ডিএসই এসব কোম্পানিকে ‘জেড’ ক্যাটাগরির কাতারে রেখেছে। পুঁজিবাজারে এ কথা সর্বজনবিদিত যে, এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা মানেই লোকসান গুনতে থাকা। কিন্তু এসব কোম্পানির শেয়ার ঘিরেই লাভবান হচ্ছে সঙ্ঘবদ্ধ চক্রটি।
এসব কোম্পানির শেয়ারদর গত বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। এমনকি সাপ্তাহিক লেনদেনেও অংশ বেশি ছিল এসব কোম্পানির। শেয়ার বৃদ্ধির এমন চিত্রকে বিশ্লেষকেরা অস্বাভাবিক হিসেবেই আখ্যায়িত করে আসছেন। বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু কোম্পানির বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর চিঠিও দিয়েছে ডিএসই। তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সর্বশেষ ১৫টি কোম্পানির বিষয়ে সরেজমিন তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডিএসই। কয়েকটির বিষয়ে পুঁজিবাজার থেকে তালিকাচ্যুতির বিষয়ে আলোচনাও চলছে। কিন্তু প্রায় অর্ধবছর পেরিয়ে যাওয়ার সময় হলেও কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে পারেননি বিনিয়োগকারীরা।
এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার বাজার পর্যবেক্ষণ দুর্বলতাকেই দায়ী করছেন বিনিয়োগকারীরা। অপর দিকে নিজেদের সীমাবদ্ধতা বা কালক্ষেপণের বিষয়ে কিছুই প্রকাশ করছেন না নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা। ফলে বাজারে এসব কোম্পানির দৌরাত্ম্য কমেনি। দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার নেতিবাচক হিসেবেই পরিচিতি পাচ্ছে।
শিগগিরই যে এসব কোম্পানির দৌরাত্ম্য কমবে, তার কোনো লক্ষণ এখনো প্রকাশ পায়নি। কারণ হিসেবে বিনিয়োগকারীরা জানিয়েছেন, নির্বাচন-পরবর্তী প্রথম সপ্তাহের ডিএসইর লেনদেন চিত্র জানান দিয়েছে এসব কোম্পানির শেয়ারদর এ বছরও বৃদ্ধির তালিকায় থাকবে। সঙ্ঘবদ্ধ চক্রের সদস্যরা নতুন উদ্যমে শেয়ার যোগসাজশে লিপ্ত হবে। ডিএসইর নির্বাচন-পরবর্তী লেনদেনের তথ্য অনুযায়ী, আলোচিত সময়ে ডিএসইতে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে থাকা কোম্পানির প্রাধান্য ছিল পুরো লেনদেনে। শতাংশের হিসাবে কোম্পানির শেয়ারদর বৃদ্ধির শীর্ষে থাকা প্রতিষ্ঠানই হচ্ছে ‘জেড’ ক্যাটাগরির। তালিকায় সবার উপরে থাকা সাভার রিফ্র্যাক্টরিজ দীর্ঘদিন ধরেই লোকসান দিয়ে আসছে।
তার পরও এই শেয়ারদর বৃদ্ধি পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। ফলে সপ্তাহজুড়ে কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৫৪ লাখ টাকা। আর প্রতি কার্যদিবসে গড়ে লেনদেন হয়েছে ১৮ লাখ টাকা। কোম্পানিটির শেয়ার দাম সপ্তাহজুড়ে বেড়েছে ২৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ, যা তালিকাভুক্ত তিন শতাধিক কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে বেশি। টাকার অঙ্কে বেড়েছে ৩০ টাকা। সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস শেষে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে ১৩৩ টাকা, যা আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে ছিল ১০৩ টাকা।
এ ছাড়া দর বৃদ্ধিতে শীর্ষে থাকা দশটির কোম্পানির মধ্যে সাতটিই হচ্ছে ‘জেড’ ক্যাটাগরির। আলোচিত সময়ে শেয়ারদর বৃদ্ধিতে শীর্ষ দশে স্থান করে নেয়া ‘জেড’ ক্যাটাগরির অন্যান্য কোম্পানির মধ্যে রয়েছেÑ বেক্সিমকো সিনথেটিক, সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইল, তাল্লু স্পিনিং, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স, এমারেল্ড অয়েল এবং শ্যামপুর সুগার মিল।
এ ছাড়া ‘জেড’ ক্যাটাগরির আরেক প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো সিনথেটিকের দরও বৃদ্ধি পেয়েছে এই সময়ে। সপ্তাহজুড়ে এ কোম্পানিটির শেয়ার দাম বেড়েছে ২৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এর পরেই রয়েছে সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইল। সপ্তাহজুড়ে কোম্পানিটির শেয়ার দাম বেড়েছে ২৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এ ছাড়া বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্সের ২১ দশমিক ৪৩ শতাংশ, এমারেল্ড অয়েলের ১৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ এবং শ্যামপুর সুগার মিলের ১৯ দশমিক ৬১ শতাংশ দাম বেড়েছে।
এ সময় ডিএসইতে লেনদেনে অংশগ্রহণ করা ৩৪৯টি সিকিউরিটিজের মধ্যে শেয়ারদর বৃদ্ধি পেয়েছে ৩১২টির বা ৮৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ, কমেছে ২৯টির, অপরিবর্তিত ছিল ছয়টি ও লেনদেন হয়নি দুটি কোম্পানির। এই সময়ে ডিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছে দুই হাজার ১৫১ কোটি ৫৪ লাখ টাকার। যা পূর্ববর্তী সপ্তাহের চেয়ে ৩১ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি। জানা গেছে, সপ্তাহভিত্তিক এ লেনদেন ডিএসইর গত চার মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।
মৌলভিত্তির খাত হিসাবে বিবেচিত ব্যাংক ছাড়া অন্য কোনো খাতের নতুন কোনো খবর বাজারে ছিল না। কিন্তু দুর্বল এসব কোম্পানির ওপর ভর করেই সূচক ইতিবাচক হিসেবে লেনদেন করছে। এসব কারণে গত বছরে ডিএসইর বাজার মূলধন এক সপ্তাহের ব্যবধানে বৃদ্ধি পেয়েছে সাড়ে দশ হাজার কোটি টাকার বেশি।
পুঁজিবাজারের অবকাঠামো খাতের কিছুটা উন্নয়ন হলেও বিনিয়োগকারীদের আস্থায় আনা সম্ভব হয়নি। শেয়ার কারসাজি ও যোগসাজশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ন্ত্রক সংস্থার একাধিক উদ্যোগের আশানুরূপ ফল দৃশ্যমান হয়নি। ফলে একপর্যায়ে স্বল্প মূলধনীর পাশাপাশি শেয়ারদর হারায় মৌলভিত্তির কোম্পানিও। এসব কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছেন। সঙ্ঘবদ্ধ যোগসাজশকারীদের প্রতারণায় বাজার থেকে চলে যায় ৪৮ হাজার কোটি টাকার মূলধন।
দেশের ভালো-মন্দের হর্তকর্তা হিসেবে সরকারকেই ভূমিকা রাখতে হয়। ক্ষমতাসীন সরকার নতুন করে দায়িত্ব নেয়ার পরে এসব বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ নেবে বলেই আশা করেন বিনিয়োগকারীরা। স্বল্প মূলধনীর দৌরাত্ম্য কমাতে এর বিকল্প নেই। রহস্যজনক আচরণ থেকে বেরিয়ে এসে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে পারলেই পুঁজিবাজারকে আস্থায় নিতে পারবেন বিনিয়োগকারীরা।

 


আরো সংবাদ



premium cement