২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নয়-ছয় সুদহারে বিপাকে আমানতকারীরা

-

শিল্পনগরী টঙ্গীর বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষ করে অবসরে যান ২০১২ সালে। এককালীন পেনশনের ২০ লাখ টাকা পেয়ে ওই সময় ১২ শতাংশ মুনাফায় আমানত রাখেন একটি ব্যাংকে। তিন মাস মেয়াদি আমানত হিসাবের মুনাফা থেকে কর ও বিভিন্ন চার্জ কাটার পর প্রথম দুই বছরে প্রতি মাসে গড়ে পেতেন ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। এসময় তার বাসা ভাড়া দিতেন আট হাজার টাকা। আর বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল মিলে খরচ হতো এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা।
কিন্তু পাঁচ বছরের ব্যবধানে আমানতে মুনাফার হার পাঁচ শতাংশের নিচে নেমে আসায় আমিনুল ইসলাম তার একমাত্র সঞ্চয় থেকে এখন মাসে পাচ্ছেন আট হাজার টাকা। অথচ এই সময়ে তার বাসাভাড়া পাঁচ হাজার টাকা বেড়ে হয়েছে ১৩ হাজার টাকা। আর গ্যাস-বিদ্যুতের বিলও প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে হয়েছে আড়াই হাজার টাকা। এ ছাড়াও, প্রতিবছর জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে ছয় থেকে সাত শতাংশ।
সার্বিক অবস্থায় দেখা যাচ্ছে, পাঁচ বছর আগে আমিনুল ইসলাম তার আমানত থেকে যে মুনাফা পেতেন, তা এখন নেমে এসেছে অর্ধেকের নিচে। পক্ষান্তরে তার পারিবারিক ব্যয় বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ফলে ব্যাংকের মুনাফার ওপর নির্ভরশীল আমিনুলের সংসার এখন আর চলছে না। এ অবস্থায় পরিবার নিয়ে তিনি পড়ছেন বিপাকে। তাই কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।
এমন চিত্র শুধু আমিনুল ইসলামের ক্ষেত্রেই নয়, অনেক সরকারি চাকরিজীবী এবং প্রবাসীদের পরিবারও আমানত রেখেছেন ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার আশায়। তাদের কেউ সন্তানের উচ্চশিক্ষার জন্য, কেউ আবার মেয়ের বিয়ের জন্য। কিন্তু সেই আমানত এখন পড়েছে হুমকির মুখে।
আলোচ্য চিত্র থেকে দেখা যায়, আমানতের সুদহার শুধু নিচেই নামেনি, মূল্যস্ফীতির হার থেকেও নিচে নেমে গেছে; যা খুবই বিপজ্জনক। এতে আমানতকারীরা একদিকে ব্যাংকে আমানত রাখার ক্ষেত্রে বিমুখ হবেন, অন্য দিকে অনেকে আবার অর্থ পাচারে জড়িয়ে পড়বেন। যা ব্যাংকিং খাতের জন্য দুঃসংবাদ বয়ে আনবে। এ ছাড়াও, মানুষের হাতে পুঁজি আটকে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুরো অর্থনীতি।
হ্যাঁ, নয়-ছয় সুদহার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন আমানতকারীরা। গত ২০ জুন বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) সিদ্ধান্ত নেয়, আমানতের সুদহার হবে ছয় শতাংশের নিচে। আর ঋণের সুদহার হবে ৯ শতাংশের নিচে। বাস্তবতা হলোÑ আমানতের সুদহার ব্যাংকগুলো ৬ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনলেও ঋণের সুদহার ১০ শতাংশের উপরই রয়েছে। এতে ঋণের সুদহার না কমায় দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেই সাথে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আমানতকারীরা।
ব্যাংক ঋণের সুদ ৯ শতাংশে নামাতে গড়িমসি : গত বাজেট ঘোষণার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর এক সভায় তিনি ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার জন্য নির্দেশ দেন। ওই সভায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাজী আকরাম উদ্দিন আহমদ উপস্থিত ছিলেন। তাকে উদ্দেশ করেই প্রধানমন্ত্রী এ নির্দেশনা দিয়েছিলেন। পরে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে বলা হয় বাংলাদেশ ব্যাংককে। বাংলাদেশ ব্যাংক নানা ধরনের বিচার-বিশ্লেষণ ও ব্যাংকের এমডিদের সাথে বৈঠক করে এ হার কমানোর উদ্যোগ নেয়।
এর আলোকে গত ২০ জুন বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সভায় সব ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার ৯ শতাংশে এবং আমানতের সুদ হার ছয় শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয়।
সুদের এ হার তারা পয়লা জুলাই থেকে কার্যকর করার কথা জানায়। বিএবির সদস্য হচ্ছে ৩৭টি ব্যাংক। এর মধ্যে ওইদিন ২৬টি ব্যাংকের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। তারা ওইদিন এই হার কমাতে নীতিগত সিদ্ধান্তও নিয়েছিল। কিন্তু এরপরও ঋণের সুদের হার কমে সিঙ্গেল ডিজিটে নামছে না। ব্যাংক ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশের মধ্যে বা সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে গড়িমসি করছে ব্যাংকগুলো। এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ ব্যাংক সুদের হার ৯ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনেনি।
সরকারি খাতের চারটিসহ হাতেগোনা কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক কিছু ঋণের সুদ ৯ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনলেও অন্য ব্যাংকগুলো তা করছে না। দেশে বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে ঋণের সুদ হার কমানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হলেও বাস্তবে তা কার্যকর হচ্ছে না।
এতে উদ্যোক্তারা পড়েছেন বিপাকে। তারা চড়া সুদের কারণে ঋণ নিয়ে শিল্প স্থাপন করতে পারছেন না। ফলে পুঁজি বিনিয়োগ না করে হাত গুটিয়ে বসে আছেন। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিল্পের বিকাশ ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জানা গেছে, দেশে ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে এখন পর্যন্ত ২৩টি ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশে নামিয়েছে। তবে বিভিন্ন সেবার বিপরীতে আরোপিত চার্জসহ এ হার আরো বেশি হচ্ছে।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ১৯টি ব্যাংক সুদের হার কমিয়েছে। সব ব্যাংকই বেশির ভাগ ঋণের ক্ষেত্রে এ হার ডাবল ডিজিটেই রেখেছে। কৃষি, মসলা ও নারী উদ্যোক্তা খাতে কিছু ঋণের সুদের হার তারা ৯ শতাংশে রেখেছে, যা আগে থেকেই ছিল। তারা শিল্প, চলতি মূলধনসহ কিছু খাতে ঋণের সুদের হার ১ থেকে ২ শতাংশ কমিয়েছে। কমানোর পরও এসব ঋণের সুদের হার ১০ থেকে ১৪ শতাংশে রয়েছে।
বেসরকারি ব্যাংকগুলো এখন পর্যন্ত যেসব ঋণের সুদের হার কমিয়েছে সেগুলোর মধ্যে কেবল কৃষি ঋণ, নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ, রফতানি ঋণ ও মসলা চাষে ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশের মধ্যে রেখেছে। এগুলোর সুদ হার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া। এর মধ্যে কৃষি ও নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ ৯ শতাংশ, রফতানি ঋণ ৭ শতাংশ ও মসলা চাষের ঋণ ৪ শতাংশ সুদে দিতে হবে। ফলে ব্যাংকগুলো এসব খাতে কোনো সুদ কমায়নি। শিল্প খাতের মেয়াদি ঋণ, চলতি মূলধন ঋণ, পণ্য আমদানি ঋণের সুদের হার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ রেখেছে। মাঝারি শিল্পে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র শিল্পে সাড়ে ১২ থেকে সাড়ে ১৬ শতাংশ, হাউজিং খাতে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ। ভোক্তা ঋণের ১৩ থেকে ১৬ শতাংশ, রফতানিমুখী শিল্প স্থাপনে ১১ থেকে ১৪ শতাংশ সুদ নির্ধারণ করেছে।
এ দিকে, ঋণের সুদের হার কমাতে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের একাধিক সংস্থা থেকে প্রবল চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। কয়েকটি ব্যাংকের এমডিদের সাথে আলাদাভাবে কথা বলেও সুদের হার কমানোর বার্তা দেয়া হচ্ছে। তারপরেও তারা সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনছে না।
ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের মাথায় হাত ঃ বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের বেসরকারি খাতের অংশ ৮৩ শতাংশের ওপরে। বাকিটা সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের। এই ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে ২৫টির আমানতের সুদহার বর্তমানে পাঁচ শতাংশের নিচে। আমনতের সুদহার কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা। তারা এখন অনেকেই ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বেশি মুনাফার আশায় নানা ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করছেন। এতে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের আমানত ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement
বিশ্বের অন্যতম স্মার্ট হজ ব্যবস্থাপনা হবে বাংলাদেশে : ধর্মমন্ত্রী সিলেটে ৪৪ লাখ টাকার ভারতীয় চিনিসহ গ্রেফতার ৪ অবৈধ সম্পদ : এস কে সিনহার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন ২৬ জুন টি-টোয়েন্টি র‌্যাংকিংয়ে চাপম্যান-আফ্রিদির উন্নতি থানচিতে ট্রাকে দুর্বৃত্তদের গুলি চীনের আনহুই প্রদেশের সাথে ডিএনসিসি’র সমঝোতা স্মারক সই আ’লীগের ২ গ্রুপের সংঘর্ষ : ২ শতাধিক ককটেল বিষ্ফোরণ, আহত ৫ রাঙ্গামাটিতে ডাম্প ট্রাক খাদে পড়ে নিহত ৬, আহত ৮ প্রতিবাদ সমাবেশকারীদের গ্রেফতারের নিন্দা জামায়াতের ‘সংসদ সদস্যরা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন না’ ফরিদপুরে বেইলি ব্রিজ অপসারণ করে স্থায়ী ব্রিজ নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধন

সকল