১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

কমছে আয়-বাড়ছে ব্যয়

-

ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে যেমন দেউলিয়াত্ববরণ করতে হয়, তেমনি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। কোনো প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি শক্তিশালী হলে সহজেই লোকসান বা বাড়তি ব্যয় সমন্বয় করা যায়। কিন্তু তারও একটি নির্ধারিত সময় থাকে। নির্ধারিত সময় শেষে অর্থাৎ মজুদ শেষ হয়ে গেলে বা লোকসান সমন্বয় করার শক্তি হারিয়ে ফেললে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠা এমন প্রতিষ্ঠানকেও দেউলিয়াত্ববরণ করতে হয়।
দেশের ব্যাংকিং খাতের দিকে তাকালে এমনই মনে হয়। দেশের ব্যাংকিং খাত শক্তিশালী ভিত্তির ওপর গড়ে উঠলেও জনগণের আমানতের অর্থ লুটপাট হওয়ায়, নীতিমালা শিথিলতার কারণে ফাঁকফোকর দিয়ে অন্যায় করে সহজেই পার পেয়ে যাওয়ায়, কাগুজে আদায় বেড়ে যাওয়া, অর্থাৎ প্রকৃত পক্ষে ঋণের টাকা আদায় না করেও কৃত্রিমভাবে আদায় দেখিয়ে মুনাফা স্ফীত করা, বিনিয়োগ মন্দাজনিত কারণে আয় কমে যাওয়াসহ নানা কারণে ব্যাংকের ধকল সহ্য করার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে ব্যাংকিং খাতের চিত্র অনেকটা এমনই।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে সর্বশেষ বেসিক ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির চিত্র বের হয়ে আসার পর রীতিমতো সাবেক ও বর্তমান ব্যাংক বিশ্লেষকেরা শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নীতিনির্ধারক সেদিন তো বলেই ফেললেন, চট্টগ্রামের ব্যাংকিং খাত যেন অগ্নিকুণ্ড হয়ে পড়েছে। হাত দিলেই ঝনঝন করে ভেঙে পড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সম্প্রতি তার চট্টগ্রাম অফিসের নির্বাহী পরিচালক, মহাব্যবস্থাপকসহ প্রায় ডজনখানেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে এক সাথে বদলি করেছে। কিন্তু যাদের কারণে চট্টগ্রামের ব্যাংকিং খাতে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তারা ধরাছোঁয়ার যেন বাইরেই থেকে গেছে। এর পরও শেষমেশ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চট্টগ্রামের ব্যাংকিং খাত নিয়ে কিছু একটি করার উদ্যোগ নিয়েছে এটাও বা দোষের কী।
ব্যাংকারদের সাথে আলাপচারিতায় অনেকেই প্রশ্ন করে থাকেন, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক কি আগে থেকে জানত না। যদি বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১১ সালেই তাদের এক তদন্তে বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির তথ্য পায়। শিকারির কাজ শিকার ধরা। পুলিশের কাজ চোর ধরা। সুতরাং ব্যাংকিং খাতের কোথায় কী হচ্ছে ত্রিশতলা ভবন থেকে বসেই অনেকেই বলতে পারেন। নাকে গন্ধ পান নানা কেলেঙ্কারির। চৌকস কর্মকর্তারা ব্যাংক পরিদর্শনে গিয়েই বুঝতে পারেন ব্যাংকে কী হচ্ছে বা ঘটছে। ব্যাংকারদের কাছ থেকে পাল্টা প্রশ্ন আসে, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক এত কিছু জানা বা বোঝার পরেও কেন বেসিক ব্যাংকের বিরুদ্ধে আগে থেকেই ব্যবস্থা নিলো না। আগে থেকে ব্যবস্থা নিলে জনগণের সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা লুটপাট করতে পারত না। আর তখনই নিজেকে গুটিয়ে নিতে হয়। বিষয়টি না বোঝার ভান করে অন্য প্রসঙ্গ তোলার চেষ্টা করি। রিপোর্টারদের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান অনেক সুউচ্চে। তাকে কেউ ছোট করুক বা কেউ বদনাম করুক তা বেশির ভাগ রিপোর্টারের কাম্য নয়। কেননা, ব্যাংকারেরা কোনো অনিয়ম করলে বাংলাদেশ ব্যাংক সেটি শনাক্ত করবে। আর রিপোর্টারেরা তা প্রকাশ করে অন্যদের সচেতন করবে। তবে সব ক্ষেত্রে সেটি ঠিক নয়। কেননা, ব্যাংক হলো আস্থার প্রতীক। নিজের কষ্টার্জিত অর্থ যেখানে নিজের ঘরে রাখা নিরাপদ মনে করে না, যতখানি না নিরাপদ মনে হয় ব্যাংকে রেখে। সুতরাং ব্যাংকের বড় বড় অনিয়ম বেশি হারে পত্রিকায় প্রকাশ হলে আমানতকারীরা শঙ্কিত হয়ে পড়বেন। তখন ব্যাংক থেকে অনেকেই মুখ ফিরে নেবেন। তার পরেও বড় অনিয়ম হওয়ার আগেই বাংলাদেশ ব্যাংক তা শনাক্ত করে ঠিক করবে, এটিই সবার প্রত্যাশা।
কিন্তু নাছোড়বান্দা ব্যাংকারেরা ছাড়তে চান না। প্রসঙ্গ ঘুরে ফিরে আবারো বেসিক ব্যাংক প্রসঙ্গ টানেন। আসে হলমার্ক প্রসঙ্গ। আসে ফারমার্স ব্যাংক প্রসঙ্গ। আসে ডজনখানেক ব্যাংক দখল করা চট্টগ্রামভিত্তিক একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ প্রসঙ্গে। বলছিলাম বাংলাদেশ ব্যাংক বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি সম্পর্কে ২০১১ সাল থেকেই জানত। তখন ছিদ্র ছিল ছোট। বাংলাদেশ ব্যাংক শক্ত হাতে ধরলে হয়তো ছিদ্র বন্ধ হয়ে যেত বা সর্বশেষ পরিস্থিরি শিকার হতো না ব্যাংকটির। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক কেন করল না, নাকি তাকে করতে দেয়া হয়নি সেটি ওয়াকিবহাল মহলই ভালো জানে। তবে এটুকু বলা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশির ভাগ কর্মকর্তারই আন্তরিকতার অভাব ছিল না। তার পরও কিছু ব্যক্তির সরকারের জুজুর ভয়ের কারণেই হোক, আর ব্যক্তি স্বার্থেই হোক বা অন্য মহলের ইঙ্গিতেই হোক বাংলাদেশ ব্যাংক আগে জানার পরেও কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা আক্ষেপ করে বলেন, পানির মতো অর্থ বের করে নেয়া হয়েছে, তাদের চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া অন্য কিছু করার ছিল না। কিছু করতে গেলেই পুরস্কারের চেয়ে তিরস্কার গুনতে হতো। যেমনটি হয়েছে চট্টগ্রামের ব্যাংকিং খাতের ক্ষেত্রে।
যা হোক মূল প্রসঙ্গে আসি। নানা কারণে ব্যাংকিং খাতের আয় কমে গেছে। কমে গেছে প্রকৃত আয়। যেমনÑ শুধু একটি প্রসঙ্গ অবতারণা করা যাক। ব্যাংকগুলো সাধারণ আমানতকারীদের কাছ থেকে কম সুদে আমানত গ্রহণ করে অপেক্ষাকৃত বেশি সুদে গ্রাহকদের কাছে বিনিয়োগ করে থাকে। ঋণ ও আমানতের সুদের ব্যবধানই হলো ব্যাংকের মুনাফা। এ মুনাফা দিয়ে তার পরিচালনা ব্যয় অর্থাৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা, নানা ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করার পর সরকারের ট্যাক্স দিয়ে থাকে। সরকারের কর পরিশোধ করার পর শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ বিলি বণ্টন করা হয়। তাহলে দেখা যায়, ব্যাংক ঋণ দিয়ে যত বেশি আদায় করতে পারবে, ততবার বেশি বিনিয়োগ করতে পারবে। তত বেশি মুনাফা করতে পারবে। রিটেইন আর্নিং বাড়বে, বাড়বে মূলধন। ব্যাংকের ভিত্তি শক্তিশালী হবে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বলা চলে কোনো রকম জামানত ছাড়াই ঋণ নবায়নের হিড়িক চলে। এর গোড়াপত্তন শুরু করে সাবেক গভর্নর ড, আতিউর রহমান গভর্নর থাকা কালে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের আগে বলা চলে কোনো ধরনের জামানত ছাড়াই ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয়া হয়। যুক্তি দেখানো হয়েছিল, ওই সময় বিরোধী দলের আন্দোলনের কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ কারণে তারা ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। ঋণখেলাপি হয়েছেন। এ জন্যই এ সুযোগ দেয়া হয়েছিল। এ সুযোগ নিয়ে দীর্ঘ দিনের পুরনো খেলাপি ঋণও অনেকটা ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই নবায়ন করা হয়। এক হিসাবে ওই সময় প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয় কোনো ধরনের জামানত ছাড়াই। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী খেলাপি ঋণ নবায়ন করতে হলে, একটি নির্ধারিত পরিমাণ ডাউন পেমেন্ট অর্থাৎ আগাম খেলাপি ঋণের একটি অংশ পরিশোধ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নির্ধারিত সময়সীমা বেঁধে দিতে পারত। অর্থাৎ এক বছর বা ছয় মাসের মধ্যে যারা ঋণখেলাপি হয়েছেন তাদের ঋণ নবায়ন করার সুযোগ দেয়া হবে। কিন্তু নীতিমালা শিথিল করার সময় এ ধরনের কোনো সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়নি। এর ফলে ঢালাওভাবে খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়। আর নবায়ন করার অনুমোদন দেয়া হয়, যারা নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই বিভাগ থেকে। এরপর ওই ঋণ আবার খেলাপি হয়। পরের বছর ঋণ পুনর্গঠনের নামে ১৪টি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপকে ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয়া হয়।
ব্যাংকারেরা আফসোস করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন সার্কুলারে ব্যাংকের প্রকৃত আদায় কমে গেছে। আদায় বেড়েছে, কিন্তু তা কাগজ-কলমে। এর ফলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে খেলাপি ঋণ কমেনি। অথচ এ সুযোগে একশ্রেণীর ব্যাংক খেলাপি ঋণ কম দেখিয়ে তাদের আয়কে স্ফীত করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ১০০ টাকা আয় করতে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে ৭৮ টাকা, যেখানে ২০০৯ সালে ছিল সাড়ে ৭২ টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ব্যয় সর্বাধিক হচ্ছে। বর্তমান অবস্থার উন্নতি না হলে ব্যাংকের লোকসান সমন্বয় করার সক্ষমতা আরো কমে যাবে। তখন ব্যাংকিং খাতের সম্ভাব্য পরিস্থিতি নিয়ে তারা শঙ্কিত। তবে দেশের ব্যাংকিং খাত এমন পরিস্থিতির মুখোমুখী হোক এটি কারোই কাম্য নয়। হ


আরো সংবাদ



premium cement