২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কোম্পানির ভাবনায় নির্বাচন-পরবর্তী বছর

-

দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তালিকাভুক্ত কোম্পানি বিএসআরএম লিমিটেড। প্রকৌশল খাতের এ কোম্পানিটি জুন শেষে হিসাব বছরে আগের চেয়ে মুনাফা বেশি করেছে। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিয়েছে সেই তুলনায় কম। অপর দিকে, কম লভ্যাংশ দেয়ার পাশাপাশি বোনাস শেয়ার দিয়েছে বেশি। কারণ হিসেবে কোম্পানি বলছে, সামনে জাতীয় নির্বাচন। পরবর্তী পরিস্থিতি কী হবে তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। আগামী বছর ব্যবসায় না হলেও যেন বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতে পারে এ জন্য অর্থ হাতে রেখেছে কোম্পানিটি।
বিএসআরএমের মতো নীতি অবলম্বন করেছে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানির বড় একটি অংশ। ফলে বাজারে বোনাস শেয়ারের আধিক্য বৃদ্ধি পেয়েছে। যা বাজারে বিনিয়োগ ঝুঁকি বাড়িয়েছে। এতে সামনে পুঁজিবাজারে অর্থের প্রবেশ না ঘটলেও বোনাস শেয়ারের সংখ্যা বাড়বে। বিনিয়োগকারীরা মুনাফা তুলে নিতে শেয়ার বিক্রি বৃদ্ধি পাবে। এতে শেয়ারের দরও কমে যাবে।
জানা গেছে, কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সূচকের মূল্যায়নে পুঁজিবাজারকে আয়না হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু আমাদের পুঁজিবাজার উন্নয়নে কোনো আগ্রহ নেই সরকারের। এ সুযোগে কয়েকটি চক্র কারসাজির মাধ্যমে গত এক বছরে সাধারণ বিনিয়োগকারীর পকেট থেকে হাতিয়ে নিয়েছে সাড়ে ১৯ হাজার কোটি টাকা। শেয়ার কারসাজি চক্রের দৌরাত্ম্য, আস্থার সঙ্কট ও নেতিবাচক ধারার কারণে গত তিন বছরে পাঁচ লাখের বেশি বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজার ছেড়েছেন বিও হিসাব বন্ধ করে। এসব সমস্যার সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে বোনাস শেয়ার।
পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত প্রকৌশল খাতের কোম্পানি বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস (বিএসআরএম) লিমিটেড। বছর শেষে মুনাফা আড়াই গুণের বেশি হলেও বিনিয়োগকারীদের জন্য আগের হারে লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ। গত জুনে শেষ হওয়া হিসাববছরের জন্য কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের জন্য নগদ ১০ শতাংশ ও ১০ শতাংশ বোনাস মিলিয়ে ২০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এই সময়ে বিএসআরএমের সমন্বিত শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস হয়েছে ১২ টাকা ৯৫ পয়সা। সমন্বিত শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য বা এনএভি হয়েছে ৬৩ টাকা ৭০ পয়সা। এ সময় কোম্পানিটির কর-পরবর্তী মুনাফা ছিল ৭৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।
আগের বছর অর্থাৎ ২০১৬-১৭ হিসাব বছরের জন্য কোম্পানিটির ইপিএস ছিল তিন টাকা ৫৩ পয়সা ও এনএভি ছিল ৫৫ টকা ৭৫ পয়সা। এ হিসাবে গত বছরে ইপিএস বৃদ্ধি পেয়েছে ২৬৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ। বছর শেষে ইপিএস ও এনএভি দুটিতে বড় উল্লম্ফন হয়েছে। তবে আগের বছরের মতো বিনিয়োগকারীদের জন্য ২০ শতাংশ (১০ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার) লভ্যাংশ ঘোষণা করেছিল।
মুনাফা বাড়লেও লভ্যাংশ না বাড়ানোর কারণ হিসেবে কোম্পানিটি জানিয়েছে, নতুন বছরে ব্যবসায় হবে কি-না, তাও বলতে পারছি না। এ জন্য বিনিয়োগকারীদের কম লভ্যাংশ দেয়া হয়েছে হাতে নগদ অর্থ রাখার জন্য। যাতে আমরা ভবিষ্যতেও ডিভিডেন্ড দিতে পারি।
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, গত জুন ক্লোজিংয়ে পুঁজিবাজারের কোম্পানির মধ্যে গত সপ্তাহ পর্যন্ত ১৬০টি কোম্পানি গত হিসাব বছরের জন্য বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে ৪০টি কোম্পানি শুধু বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। বাকিগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই বোনাস ও নগদ লভ্যাংশ করেছে। ফলে পুঁজিবাজারে খুব দ্রুতই শেয়ারের আধিক্য বাড়বে। বিনিয়োগকারীরা মুনাফা তুলতে শেয়ার বিক্রি বাড়িয়ে দেবেন। এতে শেয়ার বিক্রির চাপে দরপতন হবে বাজারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
বোনাস শেয়ার ঘোষণার কারণ সম্পর্কে বিএসআরএমের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সামনে জাতীয় নির্বাচন। দেশের রজনৈতিক সঙ্কট এখনো কাটিয়ে উঠেনি। ফলে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে দেশের আর্থ-সামাজিক ও ব্যবসার পরিস্থিতি কী হবে তা নিয়ে এক ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাজ করছে। বিএসআরএম প্রতিনিয়ত বিনিয়োগ বাড়িয়ে চলছে। আগামী বছর যদি বিনিয়োগ সক্ষমতা কাজে লাগাতে না পারি, তা হলে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
নির্বাচন নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন বিনিয়োগকারীরাও। বর্তমানে পুঁজিবাজারে নতুন অর্থের প্রবেশ ঘটছে না। বাজার ঠিক রাখতে রাষ্ট্রায়ত্ত ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) পর্যন্ত দুই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে পুঁজিবাজারে। তারপরও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে না পুঁজিবাজার। যদিও চীনা কনসোর্টিয়ামের অর্থ ছাড়া হয়েছে, কিন্তু সেই অর্থ এখনো পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ শুরু করেননি অনেকেই। আগে খাতভিত্তিক কোম্পানির প্রতি ভরসায় অনেকেই বিনিয়োগ করত। এখন সেখানেও কারসাজি চলছে। এ থেকে বাদ যাচ্ছে না মৌলভিত্তির কোম্পানিও।
ফলে ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানগুলোও ভালো করতে পারছে না। সূত্র জানিয়েছে, দেশের প্রথম সারির একটি ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান গত সপ্তাহ শেষে ১১ লাখ টাকা হারিয়েছে কয়েকটি শেয়ার কিনে। শেয়ারের দর কমায় তার টাকাও হারিয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বিভিন্নভাবে টিকে থাকতে পারলেও সাধারণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের যাওয়ার জায়গা নেই।
বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, তালিকাভুক্ত কোম্পানির বোনাস শেয়ার দেয়ার প্রবণতা ভালো নয়। এতে পুঁজিবাজারে শেয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের ক্রেতা পাওয়া যায় না। ফলে সামগ্রিকভাবে বাজারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। শেয়ারের চাপে দরপতন হয় সব খাতের কোম্পানির। এতে মৌলভিত্তির শেয়ারের দামও পড়ে যায়।
জানা গেছে, গত ডিসেম্বরে শেষ হওয়া হিসাব বছরের জন্য পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের বেশির ভাগই বোনাস শেয়ার দেয় বিনিয়োগকারীদের। তখনো পুঁজিবাজারে দরপতন ঘটে। অক্টোবরের প্রথম দিক থেকে কোম্পানিগুলো জুন ক্লোজিংয়ের ডিভিডেন্ড ঘোষণা করতে শুরু করে। এক মাস ধরে ঘোষণার পর দেখা যায়, তালিকাভুক্তির মধ্যে ২০০ কোম্পানি বোনাস ও নগদ লভ্যাংশ দেয় বিনিয়োগকারীদের। এর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ কোম্পানিই বোনাস শেয়ার ঘোষণা করেছে। এর পর থেকেই পুঁজিবাজারে দরপতন হতে শুরু করে শেয়ারে। এক মাসের ব্যবধানে প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার বাজার মূলধন হারিয়েছে ডিএসই।


আরো সংবাদ



premium cement