১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

ক্যাপিটাল গেইনই যেখানে মুখ্য বাংলাদেশের পুঁজিবাজার

-

পুঁজিবাজার সাধারণ মানুষের কাছে তাদের অলস অর্থ বিনিয়োগের একটি প্রধান মাধ্যম হিসেবে সারা বিশ্বে স্বীকৃত। এখানে শিল্প, সেবা ও অবকাঠামোর মতো খাতগুলোতে বিনিয়োগ করা যায়। উদ্যোক্তারা তাদের প্রকল্পগুলো প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করে থাকেন যার বিপরীতে উদ্যোক্তারা বছর শেষে বিনিয়োগকারীদের একটি নির্দিষ্ট হারে লভ্যাংশ দিয়ে থাকেন। এটি শেয়ারবাজারের প্রাইমারি মার্কেট হিসেবে পরিচিত। বিনিয়োগকারীরা এ শেয়ার ধারণ করলে প্রতি বছরান্তে এ লভ্যাংশ পেয়ে থাকেন।
আবার সেকেন্ডারি মার্কেট থেকে শেয়ার কিনেও এসব কোম্পানির লভ্যাংশ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। একজন বিনিয়োগকারী সেকেন্ডারি মার্কেট থেকে শেয়ার কিনে কোম্পানির রেকর্ড তারিখ পর্যন্ত শেয়ার ধারণ করলে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রস্তাবকৃত লভ্যাংশ পেয়ে থাকেন। সাধারণত সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব কোম্পানির লভ্যাংশ প্রদানের অতীত ইতিহাস ভালো সেসব কোম্পানিকেই বেছে নেন, যাতে বছর শেষে বিনিয়োগের বিপরীতে ভালো একটি লভ্যাংশ পান। সারা বিশ্বে এ দু’ভাবেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মুনাফা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি ব্যাংক, বীমাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে থাকেন। প্রতিষ্ঠানগুলো স্বনামে অথবা সহযোগী প্রতিষ্ঠানের (সাবসিডিয়ারি) মাধ্যমে এ বিনিয়োগের সুযোগ পায়। বছরান্তে প্রতিষ্ঠানগুলোও যথারীতি এ লভ্যাংশ পায় যা সংশ্লিষ্ট কোম্পানির আয়ের খাতায় যোগ হয়। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিসহ বাজারে তালিকাভুক্ত বিভিন্ন ব্লুচিপ কোম্পানিকেই প্রাধান্য দেয় যেগুলো প্রতি বছর ভালো নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে থাকে। এভাবে লভ্যাংশ আয়ই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বরাবরই প্রাধান্য পেয়ে আসছে।
কিন্তু বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক চিত্র ভিন্ন। এখানে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায় স্বল্প মূলধন। বাজারে শেয়ার সংখ্যা কম এমন কোম্পানিই বিনিয়োগকারীদের বিবেচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে। কারণ বাজারের শেয়ারের স্বল্পতার কারণে খুব সহজেই এসব কোম্পানির শেয়ারদর বেড়ে যায়। এর মাধ্যমে ক্যাপিটাল গেইন হয় আশাতীত। গত এক বছরের দেশীয় পুঁজিবাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ সময় দেশের দুই পুঁজিবাজারেই স্বল্প মূলধনী কোম্পানিগুলোর জয়জয়কার। মাত্র মাস ছয়েকের মধ্যে কোনো কোনো কোম্পানির শেয়ারদর ৫০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে এমন ঘটনাও আছে। অথচ এসব কোম্পানি বছরের পর বছর ধরে কোনো লভ্যাংশ দিচ্ছে না। পুঁজিবাজার কর্তৃপক্ষ ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার নানা শাস্তিমূলক পদক্ষেপও কোম্পানিগুলোর শেয়ারদরের ঊর্ধ্বগতি থামাতে পারেনি। একপর্যায়ে লেনদেন স্থগিত করার মতো পদক্ষেপও নিতে হয়েছে। এর পরও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। কারণ ২০, ৫০ বা ১০০ শতাংশ লভ্যাংশ পাওয়ার চেয়ে কয়েক শ’ শতাংশ ক্যাপিটাল গেইনই তাদের বিবেচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে।
অপর দিকে বিনিয়োগকারীর এ ধরনের মানসিকতার কারণে যেসব কোম্পানি প্রতি বছরান্তে ভালো লভ্যাংশ ঘোষণা করে আসছে বাজারে সেগুলো প্রত্যাশিত দর পাচ্ছে না। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে এ ধরনের কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর নেমে আসে বছরের সর্বনিম্নে।
সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ভালো কোম্পানি লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এদের মধ্যে ছিল ওষুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানি একমি ল্যাবরেটরিজ। কোম্পানিটি বিগত অর্থবছরের জন্য ৩৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ প্রস্তাব করে। একই সঙ্গে বিগত অর্থবছরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় দেখায় ৬ দশমিক ৭৪ টাকা। ১০০ টাকা শেয়ারদরের একটি কোম্পানি হিসাবে যে কেউ এ আয় ও লভ্যাংশকে যথেষ্ট ভালো বলে আখ্যায়িত করবে। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। লভ্যাংশ ঘোষণার পর থেকে টানা দরপতনে কোম্পানিটির শেয়ারদর নেমে আসে ৮৮ টাকায়।
একই খাতের কোম্পানি স্কয়ার ফার্মা বোনাস ও নগদ মিলিয়ে ৪৩ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করলেও পরদিন এক টাকা দর হারায় কোম্পানিটি। এ ছাড়া কোম্পানিটির বিগত অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি আয় দেখিয়েছে ১৫ দশমিক ৭২ টাকা, যা তালিকাভুক্তির পর সর্বোচ্চ। অথচ লভ্যাংশ ঘোষণার পরদিন এ বছরের সর্বনি¤œ দরে ছিল কোম্পানিটি। অথচ দেশের পুঁজিবজারগুলোতে হাতেগোনা কয়েকটি ব্লুচিপ কোম্পানির মধ্যে এটিকে প্রথম সারিতে ধরা হয়। তালিকাভুক্তির পর থেকেই ধারাবাহিকভাবে ভালো লভ্যাংশ দিয়ে আসা কোম্পানিটিও ভালো লভ্যাংশ ঘোষণার ফল পায়নি।
ব্লুচিপ কোম্পানিগুলোর আরেকটি মোবিল যমুনা। জ্বালানি খাতের এ কোম্পানিটিও তালিকাভুক্তির পর থেকে নিয়মিত ভালো লভ্যাংশ দিয়ে আসছে। গত ২৩ অক্টোবর বিগত অর্থবছরের জন্য ৪৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস মিলিয়ে ৫০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে মোবিল যমুনা। এটি কোম্পানিটির তালিকাভুক্তির পর এক অর্থবছরে সর্বোচ্চ লভ্যাংশ। একই সঙ্গে কোম্পানিটি বিগত অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি আয় দেখিয়েছে সাত টাকা। কিন্তু লভ্যাংশ ঘোষণার পরও কোম্পানিটির শেয়ারদর ১০০ টাকার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে যা কোনোভাবেই স্বাভাবিক মনে করছেন না বিনিয়োগকারীরা।
মৌলভিত্তিসম্পন্ন ও ব্লুচিপ কোম্পানি হিসেবে পরিচিত অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ মঙ্গলবার বিগত অর্থবছরের জন্য ৪৮ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করলেও গতকাল কোম্পানিটির শেয়ারদর প্রায় ১০ টাকা পড়ে যায়। অথচ আগের বছর ৪৫ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করার পরও কোম্পানিটির শেয়ারদর ৩০০ টাকার ওপরে ছিল। গতকাল কোম্পানিটি ২১৯ টাকায় লেনদেন শেষ করে। আগর দিন শেয়ারের দর ছিল ২২৬ টাকা। কোম্পানিটি বিগত অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি আয় করেছে প্রায় ৯ টাকা। এ ছাড়া জ্বালানি খাতের আরেক কোম্পানি সামিট পাওয়ার অর্থবছর শেষে ৩০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেও ৪৫ টাকা দর ধরে রাখতে পারেনি। কারণ সবাই এ মুহূর্তে দৌড়াছেন ক্যাপিটাল গেইনের পেছনে।
এ অবস্থা চলতে থাকলে পুঁজিবাজারের স্বাভাবিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে, এমনটিই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ এর মাধ্যমে ভালো ও স্বচ্ছ কোম্পানির পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন তারা। আর তা দেশের পুঁজিবাজারের গভীরতা বৃদ্ধি বাজারকে সার্বজনীন ও আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছতে বড় ধরনের প্রতিবন্ধক হিসেবে গণ্য করছেন তারা।


আরো সংবাদ



premium cement