১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

সাপের বিষের অর্থনীতি

-

সাপের নাম শুনে আঁতকে ওঠেন না এমন নারী-পুরুষের সাক্ষাৎ পাওয়া নিঃসন্দেহে দুরূহ কাজ। আর সাপের বিষ? সে তো আরো ভয়াবহ বিষয়। অথচ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্যও আশীর্বাদ হতে পারে ভয়ঙ্কর এ তরল পণ্য। যদিও ৫০০ কোটি ডলারের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারেই শূন্য। অথচ দেশের অনেক এলাকায়ই বাণিজ্যিকভাবে সাপ চাষ হচ্ছে। এসব সাপ বা বিষ দেশের ব্যবহারকারীদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ হলেও আইনগত জটিলতায় এর ব্যবহার করা যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে ওষুধ প্রস্তুত করাসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা সাপের বিষ প্রতিনিয়ত বিদেশ থেকে আমদানি করেন। আর বাংলাদেশ থেকে মূল্যবান এ সম্পদ পাচার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পাচার হচ্ছে সাপের চামড়া ও মাংসও।
তরল ডায়মন্ড
ঢাকার বাজারে বর্তমানে প্রতি গ্রাম স্বর্ণের দাম চার হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা। অন্য দিকে আমাদের দেশীয় সাপ থেকে প্রক্রিয়াজাত করা এক গ্রাম ভাইপার রাসেলের বিষের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় আড়াই লাখ টাকা। এ ছাড়া কালাচ বা কালচিতি সাপের বিষের মূল্য তিন লাখ থেকে চার লাখ টাকা, খয়া গোখরার ৫০ হাজার টাকা, বিভিন্ন সামুদ্রিক সাপের বিষের মূল্য প্রায় চার লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা। উচ্চমূল্যের কারণেই সাপের বিষকে তরল বলা হয় ডায়মন্ড। বাংলাদেশে ১৬টির অধিক প্রজাতির বিষধর সাপ আছে, যাদের বিষ অত্যন্ত মূল্যবান। অথচ হাজার মিলিয়ন ডলারের এ বাজারে বৈধভাবে প্রবেশ করতে পারছে না বাংলাদেশ। কারণ বাংলাদেশে বৈধভাবে সাপের খামারের কোনো অনুমতি দেয়া হয় না। এ কারণে বিষ, মাংস বা চামড়া বিশ্ববাজারে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়ে সরকার দৃষ্টি দিলে হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
দুই কারণে দামি
সাপের বিষ কেন এত দামি? এর প্রধান কারণ দু’টি। প্রথমত, মানুষের জীবনরক্ষাকারী ওষুধ তৈরি করতে সাপের বিষ ব্যবহার হয়। সাপে কাটা রোগীদের জন্য সাপের বিষ দিয়েই যেমন এন্টিভেনম তৈরি হয়, তেমনি ক্যান্সার, হার্টের রোগসহ বিভিন্ন জটিল রোগের জন্য সাপের বিষ ব্যবহার করে তৈরি হয় অনেক দামি ওষুধ। বিশ্ব প্রতি বছর প্রায় ১৫ লাখ মানুষ সাপের কামড়ে অসুস্থ হয়। এর মধ্যে দেড় লাখ মারা যান। সাপে কাটা রোগীদের জন্য ব্যবহৃত ভ্যাকসিন এন্টিভেনম খুবই দামি। একটি এন্টিভেনমের মূল্য প্রায় ১৫০০ ডলার। যদিও প্রতিটি দেশের সরকার ভর্তুকি দিয়ে তা সাধারণের কাছে সরবরাহ করে। বাংলাদেশসহ বেশির ভাগ দেশ এ ভ্যাকসিন তৈরি করে না। বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। এ ছাড়া সাপের বিষ দিয়ে তৈরি ওষুধও চড়া দামে আমাদের আমদানি করতে হয়। দ্বিতীয়ত, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মাদকাসক্তদের কাছে দিন দিন সাপের বিষের চাহিদা বাড়ছে। মূলত যাদের আসক্তি একেবারে চরমে, সাধারণ মাদকে যাদের নেশা হয় না তারা কড়া নেশার জন্য সাপের বিষ ব্যবহার করেন। এ ছাড়া উন্নত মাদকে ব্যবহৃত হচ্ছে সাপের বিষ। অনেক দেশের মানুষ সাপের বিষের ফোঁটা জিভের ডগায় দিয়ে নেশা করেন। চীনে এমন কিছু অঞ্চল আছে যেখানকার মানুষ চিরযৌবন লাভের আশায় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের সাপের বিষ নিয়মিত গ্রহণ করেন। তারা সাপের বিষের নিয়মিত গ্রাহকও।
পাচারই ভরসা
আমাদের দেশে বর্তমানে বৈধ উপায়ে সাপের খামার তৈরির অনুমতি নেই। এ কারণে বৈধ উপায়ে সাপের বিষ রফতানিরও সুযোগ নেই। স্বাভাবিক কারণেই অবৈধ উপায়ে কোটি কোটি টাকার সাপের বিষ পাচার হচ্ছে দেশের বাইরে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনুমতি পাওয়া গেলে অত্যন্ত লাভজনক হতে পারে সাপের বিষের ব্যবসা। বাংলাদেশসহ এশিয়া মহাদেশের অন্যতম বিষধর সাপ হচ্ছে কিং কোবরা। এর বিষ রসায়ন গবেষণাগারে একটি মূল্যবান উপাদান। কোবরার বিষ অনেক রোগের প্রতিষেধক তৈরিতে গবেষণাগারে বিক্রিয়ার প্রভাবক ও অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। কোবরার বিষ নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় ব্যবহৃত প্রভাবক ও অনুঘটক তৈরিতে কাজ করে। এ কারণে উন্নত বিশ্বের যেসব দেশ নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার মাধ্যমে রাসায়নিক উপাদান তৈরি করে সেসব দেশে কোবরার বিষ মহামূল্যবান। এ ছাড়া কোবরার বিষ বায়োকেমিক্যাল (বায়ু জীবাণুযুক্ত অস্ত্র) অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে। এ কারণে উন্নত বিশ্বে এ বিষের ব্যাপক চাহিদা।
আশীর্বাদ না অভিশাপ
পটুয়াখালী সদর উপজেলার মাদারবুনিয়া ইউনিয়নের নন্দিপাড়া গ্রামের আবদুর রাজ্জাক। বিদেশে সাপের খামার দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে ২০০০ সালে দেশে ফিরে স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত একটি কিং কোবরা ও ২৪টি ডিম দিয়ে নন্দিপাড়া গ্রামে সাপের খামার শুরু করেন। বাণিজ্যিকভাবে সাপের বিষ উৎপাদনে তিনি গড়ে তোলেন সাপের খামার। এরপর দিন দিন তার খামারে বেড়েছে সাপের পরিমাণ। বর্তমানে নাজা নাজা, নাজা কিউটিয়া, পাইথোন ও কিং কোবরা এই চার প্রজাতির প্রায় তিন শ’ বিষধর সাপ রয়েছে তার খামারে। তবে দীর্ঘ ১৭ বছরেও খামারের অনুমোদন না পাওয়ায় বিষ সংগ্রহ ও বিক্রি করতে পারছেন না এ উদ্যোক্তা। ফলে খামার এখন তার গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। খামার তৈরির পর থেকে খামারের অনুমোদন ও বিষ সংগ্রহের জন্য সরকারের বিভিন্ন দফতরে ঘুরেছেন আবদুর রাজ্জাক। তবে এত দিনেও মেলেনি অনুমোদন। এ কারণে বর্তমানে এক দিকে খামারে কর্মরত শ্রমিকদের বেতন দিতে পারছেন না, অন্য দিকে খামার পরিচালনা ও সাপের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়েও আছেন আর্থিক সঙ্কটে।
উদ্ধার ৫০০ কোটি টাকার বিষ
বিগত বছরগুলোতে কয়েক শ’ কোটি টাকার সাপের বিষ চোরাকারবারিদের হাত থেকে উদ্ধার করেছে র্যাব, বিজিবি, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একটি চক্র পাচারের রুট হিসেবে বাংলাদেশকেও ব্যবহার করছে। গত ১০ বছরে সাপের প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বিষসহ বেশ কয়েকজন চোরাকারবারিকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত বছর রাজধানী থেকে ১২ পাউন্ড সাপের বিষ জব্দ করে পুলিশ, যার মূল্য ছিল ৬৮ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৬ সালের ২ আগস্ট বিজিবি চুয়াডাঙ্গা থেকে প্রায় ১২ কোটি টাকা মূল্যের সাপের বিষসহ মোহাম্মদ সোহেল নামে (৪০) এক ব্যক্তিকে আটক করে। ওই বছর ৭ মার্চ র্যাব-১০ রাজধানীর লালবাগে অভিযান চালিয়ে ১২ পাউন্ড সাপের বিষ উদ্ধার করে। এর বাজারমূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা। র্যাব-৯ ২০১৫ সালের ২৪ জুলাই সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার রাউত গ্রাম থেকে ১২ পাউন্ড গোখরার বিষ উদ্ধার করে, যার মূল্য ছিল প্রায় ৪৬ কোটি টাকা। ২০১৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জয়পুরহাটের একটি আবাসিক হোটেল থেকে ১২ পাউন্ড কোবরার বিষ উদ্ধার করে র্যাব-৫, যার মূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর উত্তরা থেকে ছয় বোতল সাপের বিষ উদ্ধার করে পুলিশ, যার মূল্য প্রায় ১২ কোটি টাকা। ২০১০ সালে মতিঝিল থেকে র্যাব দুই আউন্স সাপের বিষ উদ্ধার করে। ২০০৯ সালের আগস্টে কাওরানবাজারের একটি আবাসিক হোটেল থেকে ১২ আউন্স সাপের বিষ উদ্ধার করে র্যাব। ২০০৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পাবনার ফরিদপুর উপজেলা থেকে ১২ পাউন্ড সাপের বিষ উদ্ধার করে র্যাব-১২। ২০১৬ সালে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা মূল্যের সাপের বিষ উদ্ধার করা হয় পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি থেকে। জলপাইগুড়ি বনবিভাগ তখন সংবাদমাধ্যমকে জানায়, আমাদের কাছে খবর ছিল যে, বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করছে সাপের বিষ। এমন খবরের ভিত্তিতে নজরদারি করে বিষের বড় এ চালান জব্দ করা হয়।


আরো সংবাদ



premium cement
ফ্রান্সের হয়ে রেকর্ড ম্যাচ খেলা হলো না গ্রিজম্যানের স্বর্ণের দাম এবার কমলো গণ-ইফতার কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের হামলার নিন্দা ছাত্রশিবিরের পাবনায় একরাতে কবরস্থান থেকে ১৫টি কঙ্কাল উধাও! সম্পদ বিবরণী জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা বাতিল হলে দুর্নীতি উৎসাহিত হবে : টিআইবি ফিলিপাইন ও জাপানের নেতাদের সাথে বৈঠকে বসছেন বাইডেন ইফতার পার্টির নামে সরকারের অন্ধ সমালোচনা করছে বিএনপি : ওবায়দুল কাদের ভাড়া বেশি নিলে সেই বাস বন্ধের হুঁশিয়ারি মালিক সমিতির যুক্তরাষ্ট্রে প্রীতি ম্যাচে খেলা হচ্ছে না মেসির ঢাকায় কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে অভিযানে মূলহোতাসহ ৩৫ জন গ্রেফতার মে মাসে মেলবোর্নে নিউক্যাসলের মুখোমুখি হবে টটেনহ্যাম

সকল