১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

চায়ের অজানা ভবিষ্যৎ

-

১৯৮২ সালের কথা। এক বছরে দেশ থেকে রফতানি হয় তিন কোটি ৪৪ লাখ কেজি চা। এর মধ্যে কেটে গেছে ৩৪ বছর। ২০১৬ সালে এসে চা রফতানি হয় মাত্র চার লাখ ৭০ হাজার কেজি। এ সময়ে দেশে চায়ের উৎপাদন বেড়েছে কিন্তু অস্বাভাবিক পরিমাণে কমেছে রফতানি। কারণ, মাছে-ভাতে বাঙালি এখন চায়ের প্রতি অনেক বেশি আসক্ত। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, দেশের মানুষ প্রতি বছর পান করেছে অন্তত আট কোটি কেজি চা। ফলস্বরূপ যে পরিমাণ চা এখন প্রতি বছর রফতানি হয়, আমদানি করা হয় তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ।
ব্যবসায়ীরা জানান, অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়তে থাকায় চায়ের রফতানি কমেছে। নব্বইয়ের দশকে বিশ্বে চা রফতানির তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল পঞ্চম। সবচেয়ে বেশি পরিমাণ চা রফতানি হয় সেই সময়। ১৯৮২ সালে চা রফতানি হয় তিন কোটি সবচেয়ে কম রফতানি হয় ২০১৬ সালে, চার লাখ ৭০ হাজার কেজি। অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়তে থাকায় রফতানিও কমে গেছে। ২০১৬ সালের চা রফতানিতে বাংলাদেশ ছিল ৭৭তম।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন কমতে থাকায় দেশের খুচরা বাজারে বাড়তে শুরু করেছে চায়ের দাম। গত দেড় মাসেই পানীয় পণ্যটির দাম কেজিতে ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। চাহিদা থাকলেও বাড়তি শুল্কের কারণে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে চা আমদানিতে আগ্রহী নয় দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো। ফলে নির্বাচনের বছরে বাড়তি চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ সঙ্কট দেখা দিয়ে চায়ের দাম আরো বাড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। দেড় মাস আগেও খুচরা বাজারে প্রতি ৫০০ গ্রাম চা ১৫৫ টাকায় সরবরাহ করত ডিলাররা। বর্তমানে একই পরিমাণ চা সরবরাহ করা হচ্ছে ২০২ টাকা ৫০ পয়সায়। সে হিসেবে দেড় মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি চায়ের দাম বেড়েছে প্রায় ১০০ টাকা। খুচরা বাজারে মোড়কজাত প্যাকেটে মুদ্রিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে চা বিক্রি করছে অনেক প্রতিষ্ঠান।
খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে প্রতি বছর ৬ শতাংশ হারে চায়ের চাহিদা বাড়ে। চলতি বছর প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে উৎপাদন কাক্সিক্ষত পরিমাণে না হওয়ায় নিলামে চায়ের দাম বাড়তে শুরু করেছে। ২০১৭-১৮ মওসুমের তুলনায় এবারের মওসুমের নিলামে প্রতি কেজি চায়ের দাম প্রায় ১০০ টাকা বেড়েছে। এ কারণে লোকসান এড়াতে দেশীয় ব্র্যান্ডগুলোও চায়ের দাম বাড়িয়েছে।
জানা যায়, এবারের মওসুমে নিলাম থেকে চা কিনতে কেজিতে অতিরিক্ত ১০০ টাকা গুনতে হচ্ছে। এর সঙ্গে শুল্ক, ব্রোকার্স কমিশনসহ অতিরিক্ত ব্যয় যুক্ত হওয়ায় চায়ের দাম আগের বছরের তুলনায় কেজিতে ১১৭-১২০ টাকা বেড়ে গেছে। এর বিপরীতে কোম্পানিগুলো খুচরা পর্যায়ে চায়ের দাম কেজিতে ১০০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছে। ফলে বর্তমান বাজারে দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো কেজিতে ১৫-২০ টাকা লোকসান দিয়ে চা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। আগামী দিনগুলোয় নিলামে দাম না কমলে খুচরাপর্যায়ে চায়ের দাম ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে।
নিলামবাজার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৯ অক্টোবর অনুষ্ঠিত মওসুমের ২৩তম নিলামে ৫২ হাজার ৩৫৪ প্যাকেটে মোট ২৮ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮০ কেজি চা বিক্রির জন্য প্রস্তাব করা হয়। নিলামে তোলা ৯০ শতাংশ চা বিক্রি হয়। এ সময় প্রতি কেজি চায়ের গড় দাম দাঁড়ায় ২৯৬ টাকায়। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে এটাই চায়ের সর্বোচ্চ গড় দাম। আগের মওসুমের একই নিলামে প্রতি কেজি চায়ের গড় দাম ছিল ২১০ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে নিলামে চায়ের গড় দাম বেড়েছে কেজিতে ৮৬ টাকা। মূলত এবারের বর্ষা মওসুমে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে কাক্সিক্ষত পরিমাণে উৎপাদন না হওয়ায় বাজারে চায়ের সরবরাহ কমেছে। ফলে নিলামে পানীয় পণ্যটির দাম কেজিপ্রতি ৩০০ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ সালে দেশে সাড়ে আট কোটি কেজি চা উৎপাদিত হয়। রেকর্ড পরিমাণ এই উৎপাদনের পরের বছরই উৎপাদন ৬১ লাখ কেজি কমে যায়। সব মিলিয়ে গত বছর উৎপাদন দাঁড়ায় সাত কোটি ৮৯ লাখ কেজি। চা চাষের ইতিহাসে এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উৎপাদন। গত দুই বছর রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদনের কারণে চা আমদানি কিছুটা কমেছে। পাশাপাশি রফতানিও বেড়েছে। বাংলাদেশ চা বোর্ডের পরিসংখ্যান থেকে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
চা বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, আমদানি ও উৎপাদন মিলে ২০১৬ সালে দেশের বাজারে চায়ের সরবরাহ ছিল সবচেয়ে বেশি, ৯ কোটি ৩৮ লাখ কেজি। ওই বছর দেশের মানুষ আট কোটি ১৬ লাখ কেজি চা পান করেছে। তবে ব্যবসায়ীরা জানান, মানুষ পান করেছে আট কোটি ৫০ লাখ কেজি চা। হিসাবটি আমলে নিলে ২০১৬ সালে চায়ের উদ্বৃত্ত ছিল ৮৮ লাখ কেজি। এ জন্য গত বছর চা আমদানি হয়েছে ৬২ লাখ কেজি, যা পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ। আবার রফতানি বেড়েছেও আগের তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। গত বছর ২৫ লাখ কেজি চা রফতানি হয়।
গত ১০ বছরের উৎপাদন ও চাহিদার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এই সময়ের ব্যবধানে চায়ের উৎপাদন বেড়েছে দুই কোটি কেজি। অর্থাৎ বছরে গড়ে উৎপাদন বাড়ছে সাড়ে ৩ শতাংশ হারে। একই সময়ে চায়ের চাহিদা বেড়েছে তিন কোটি ৩৮ লাখ কেজি। বছরে চাহিদা বাড়ছে সাড়ে ৬ শতাংশ হারে। চায়ের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, ২০১০ সাল থেকে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম হয়। তখন থেকেই আমদানি শুরু হয়। গত আট বছরে দেশে মোট চা আমদানি হয় পাঁচ কোটি ৯৫ লাখ কেজি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়েছিল ২০১৫ সালে, মোট এক কোটি ৫৮ লাখ কেজি। ২০১৬ সালে ৮৭ লাখ কেজি এবং ২০১৭ সালে ৬২ লাখ কেজি চা আমদানি হয়।
চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালিনীছড়া চা-বাগানের মাধ্যমে প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা চাষ শুরু হয়। বর্তমানে নিবন্ধিত চা-বাগানের সংখ্যা ১৬৪। চা চাষের জমির পরিমাণ দুই লাখ ৭৫ হাজার ২১৭ একর। সবচেয়ে বেশি চা-বাগান রয়েছে মৌলভীবাজার জেলায়। এ ছাড়া হবিগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম, পঞ্চগড় ও রাঙ্গামাটি এলাকায় চা চাষ হচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement