১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

পর্যটক টানতে নানা উদ্যোগ

-

কক্সবাজার, কুয়াকাটা, পার্বত্য অঞ্চলে দেশী-বিদেশী পর্যটক টানতে ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের জন্য নেয়া হয়েছে বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প। ইতোমধ্যে মেরিনড্রাইভ রোডের সুফল ভোগ করছে পর্যটক ও স্থানীয়রা। বাকি প্রকল্পের কিছু অর্ধেক, কিছু দুই-তৃতীয়াংশ বা কিছু এক-তৃতীয়াংশ কাজ শেষ হয়েছে অথবা চলমান রয়েছে। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় গড়ে তোলা হচ্ছে ‘অ্যাক্সক্লুসিভ পর্যটন জোন’। এতে বদলে যাবে রাঙ্গামাটির পর্যটন চিত্র। এরই মধ্যে মাস্টার প্ল্যান তৈরি করে সরকারকে ডিপিপি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পে ১২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
পর্যটন করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের নীল জলরাশি আর সবুজ পাহাড়ের সম্মিলনে নয়নাভিরাম প্রকৃতিকে ঘিরে এ শিল্প বিকাশে বিভিন্ন কাজ করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, শত কিলোমিটারের মেরিন ড্রাইভ, রেললাইন প্রকল্প, সৈকতে শহর রক্ষাবাঁধ, বিকল্প সড়ক, সবুজ পার্ক, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল, সাবরাং ও সোনাদিয়ায় এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোনসহ নানা মেগাপ্রকল্পে ধীরে ধীরে দেশের পর্যটন রাজধানী হয়ে উঠছে কক্সবাজার। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারভিত্তিক ১২টিসহ ৬৯টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। সংশ্লিষ্টদের আশা, প্রায় তিন লাখ কোটি টাকার চলমান এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্পন্ন হলে পাল্টে যাবে পুরো কক্সবাজারের পর্যটনের চেহারা। সময়ের ব্যবধানে কক্সবাজার হবে জাতীয় অর্থনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দু।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, পর্যটনের উন্নয়নে গৃহীত ৬৯টি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রায় ১৩ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেক প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে। দু-একটি ছাড়া বেশির ভাগ প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণকাজ দ্রুত চলছে। চলমান প্রকল্পের মাঝে মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পটি সবচেয়ে বড়। ১২০০ মেগাওয়াট উৎপাধন ক্ষমতাসম্পন্ন এ প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। ইতোমধ্যে ৭০ ভাগ সম্পন্ন হওয়া এ প্রকল্প সম্পন্ন হলে ২০২১ সালে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করা যাবে। মাতারবাড়ি তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে রাস্তার উন্নয়ন, বেড়িবাঁধ নির্মাণ, কয়লা আনলোডের জন্য জেটিসহ প্রায় কাজ শেষ হয়েছে। ২০২১ সালে পুরোদমে এ কেন্দ্রটি চালুর পর ২০২৪ সালে চালু হবে আরো একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ দুটি বিদ্যুৎ প্রকল্প সম্পন্ন হয়ে চালু হলে পাওয়ারের মূল কেন্দ্রে পরিণত হবে মহেশখালী। এ থেকে পর্যটনের ক্ষেত্রেও ভালো ফল পাওয়া যাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে মহেশখালীতেও সফলতার মুখ দেখেছে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল প্রকল্প। গত মাস থেকে এ টার্মিনাল দিয়ে এলএনজি গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়েছে। এখন আনোয়ারা হয়ে প্রতিদিন তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যোগ হচ্ছে জাতীয় গ্রিডে। শিগগিরই এটি দিনে পাঁচ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটে দাঁড়াবে বলে উল্লেখ করেন সংশ্লিষ্ট সূত্র। একইভাবে মহেশখালী ডিজিটাল আইল্যান্ড, সোনায়াদিয়া বঙ্গবন্ধু গভীর সমুদ্রবন্দর, সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক, ধলঘাটা ও মাতারবাড়ির মাঝখানে বাণিজ্যিক বন্দরসহ চারটি অর্থনৈতিক অঞ্চল মিলে অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে মহেশখালীতে।
অপর দিকে পর্যটকদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ‘রেললাইন’ প্রকল্প দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটারের সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ রেলপথের নির্মাণকাজ পুরোদমে শুরু হয়েছে। ২০১৯ সালের শেষের দিকে পর্যটন শহরে রেলের আগমন ঘটবে বলে আশা প্রকাশ করছেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা। হাইটেক পার্ক, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ, জালিয়ার দ্বীপ এক্সক্লুসিভ নাফ ট্যুরিজম পার্ক, সাবরাং অর্থনৈতিক জোনসহ পুরো জেলায় চলছে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো: কামাল হোসেন জানান, বর্তমানে দেশের এক বছরের বাজেটের প্রায় ৭০ ভাগ টাকার পরিমাণ উন্নয়নকাজ চলছে কক্সবাজারে। কিন্তু এখানকার মানুষ এসব উন্নয়ন থেকে কী সুফল পাবে বা কেন এসব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে সেই সম্পর্কেও খুব বেশি জানে না। এমনও অনেকে আছে যারা এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে কোনো ধারণাই রাখে না। জনগণের সামনে সরকারের এই উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরার জন্য এবার ব্যতিক্রম উন্নয়ন মেলার আয়োজন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
কউক সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজারের উন্নয়নে বড় বাজেট নিয়ে এগোচ্ছে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে শহরকে আকর্ষণীয় করতে গুরুত্বপূর্ণ তিন পয়েন্টে তিনটি ভাস্কর্য নির্মাণের পাশাপাশি শহরকে বদলে দিতে এবার বাস টার্মিনাল থেকে হলিডের মোড় পর্যন্ত আধুনিক মানের নতুন সড়ক করতে যাচ্ছে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। যা শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি কমাবে যানজটও। এ ছাড়া সম্প্রতি দরিয়ানগর থেকে শুরু করে প্রায় হিমছড়ি পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার বৈদ্যুতিক খুঁটিতে বাতি স্থাপন করে পর্যটন শিল্পে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। আগত পর্যটকরা সন্ধ্যার পর থেকে বাতির আলো দেখে মুগ্ধ হয়েছেন বলে অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাছাড়া পর্যটকদের চলাচলে নিরাপত্তার জন্য লাইটের এই আলো অনেকটা সহায়ক হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন।
পর্যটন করপোরেশন কর্তৃপক্ষ জানান, শীতের আগমনের পূর্ভাবাস পাওয়ামাত্রই পর্যটন এলাকাগুলোয় পর্যটকের আগমন শুরু হয়েছে। বর্তমানে পর্যটন মোটেলের কক্ষগুলো প্রায় সময় শতভাগ বুকিং থাকছে। বিশেষ করে সরকারি ছুটির দিনগুলোতে পর্যটকদের আগমন বেশি থাকে। ছুটির দিনে পর্যটকদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে রাঙ্গামাটি। প্রতি শুক্র-শনিবারসহ সরকারি ছুটির দিনে কয়েক হাজার পর্যটকের আগমন ঘটে বলে জানান কর্তৃপক্ষ।
কর্তৃপক্ষ জানান, এক্সক্লুসিভ পর্যটন জোন গড়ে তোলার লক্ষ্যে গৃহীত প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে দ্রুত বদলে যাবে রাঙ্গামাটির পর্যটন চিত্র। গড়ে উঠবে বিশ্বমানের আধুনিক সৌন্দর্যমণ্ডিত বিভিন্ন স্থাপনা। আর রাঙ্গামাটি পরিণত হবে আন্তর্জাতিক পর্যটন নগরীতে। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমা বলেন, রাঙ্গামাটি আসলে পর্যটনের জন্য খুবই আকর্ষণীয় অঞ্চল। এখানে পাহাড়, হ্রদ, ঝরনার সমন্বয়ে গড়া প্রকৃতি যে কাউকে আকৃষ্ট করে তোলে। কিন্তু প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও কর্মপরিকল্পনার অভাবে পর্যটনের দিক থেকে রাঙ্গামাটি এখনো পিছিয়ে। তাই রাঙ্গামাটির পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে জেলা পরিষদ এরই মধ্যে ১২০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যা অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এখানকার পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা কাজে লাগালে জাতীয় ও স্থানীয়ভাবে দ্রুত অর্থনৈতিক অবস্থা পাল্টে যাবে।
বৃষ কেতু চাকমা আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও জেলা পরিষদ আইনের শর্ত অনুযায়ী ২০১৪ সালে পর্যটন বিভাগটি তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে হস্তান্তর করে সরকার। এর পর রাঙ্গামাটি জেলায় পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ। এক্সক্লুসিভ পর্যটন জোন গঠনে যে মহাপরিকল্পনাটি হাতে নেয়া হয়েছেÑ সেটি বাস্তবায়ন হলে রাঙ্গামাটি জেলার পর্যটন কেন্দ্রগুলোর আকর্ষণ যেমন বাড়বে, তেমনি সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর লোকজন আত্ম-কর্মসংস্থান গড়ে তোলার সুযোগ পাবে।


আরো সংবাদ



premium cement