১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

পিপিপি প্রকল্পের কচ্ছপ গতি

-

গতিহীন সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) নেয়া প্রায় অর্ধশত উন্নয়ন প্রকল্প। পিপিপির বেশির ভাগ প্রকল্পই স্থবির হয়ে আছে। বিশেষভাবে এসব প্রকল্প নেয়া হলেও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) তালিকাভুক্ত অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পের চেয়েও দীর্ণদশা পিপিপির প্রকল্পগুলোর। এমনকি গত ৯ বছরে এসবের অগ্রগতি তলানিতে। আর ৯টি খাতে অনুমোদিত এই ৪৭ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজন হবে ১৪ বিলিয়ন ডলার বা এক লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বড় প্রত্যাশা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) প্রায় অর্ধশত প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হলেও গত ৯ বছরেও তাতে গতি আসেনি। সঠিক প্রকল্প বাছাই না করা, অসম্পূর্ণ সম্ভাব্যতা যাচাই, অস্বাভাবিক ব্যয়, দুর্নীতি ও সরকারের নজরদারির অভাব এবং সমতা ঘাটতির কারণে পিপিপির প্রকল্প বাস্তবায়ন ধীর গতিতে চলছে। আশানুরূপ কোনো অগ্রগতি নেই।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সরকারের রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১-এর অভীষ্ট ল্েয পৌঁছতে দেশের ভৌত অবকাঠামো ও সেবা খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশেষ জোর দেয়। এ জন্য প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে উন্নয়ন প্রকল্পের অন্তত ৩০ ভাগ পিপিপিতে নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৪৭টি প্রকল্প পিপিপির ভিত্তিতে বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সাতচল্লিশ প্রকল্পের মধ্যে মাত্র ১০টি প্রকল্পের বেসরকারি খাতের সাথে চুক্তি হয়েছে। যার প্রকল্প মূল্য হলো ২৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। দরপত্র প্রক্রিয়াতে আছে ১০ প্রকল্প এবং সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর্যায়ে আছে ১৩ প্রকল্প। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দুটি এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চুক্তি হয়েছে। দুটি প্রকল্প ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। এগুলো হলোÑ হেমোডায়ালাইসিসি সেন্টার অ্যাট চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হসপিটাল, হেমোডায়ালাইসিসি সেন্টার অ্যাট ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি (এনআইকেডিইউ)।
সূত্র জানায়, তিনটি প্রকল্পে ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফাইন্যান্সিংয়ের সম্মতি দেয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছেÑ ঢাকা-চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য ছয় হাজার কোটি টাকা, রাজউকের অধীনে শান্তিনগর থেকে মাওয়া সড়ক পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা চতুর্থ সেতুসহ ফাইওভার নির্মাণ প্রকল্প। যার ব্যয় ৬০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া ঢাকা বাইপাস রোডের জন্যও ভিজিএফ রাখা হয়েছে। ভিজিএফের পরিমাণ মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৩০ শতাংশের মধ্যে হতে হবে।
এদিকে, বাস্তবায়ন করার জন্য চুক্তি হয়েছে, এগুলো হলোÑ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কালিয়াকৈর হাইটেক পার্ক, মংলা অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন প্রকল্প, মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল-২ স্থাপন প্রকল্প, মংলা বন্দরের দুটি জেটি নির্মাণ প্রকল্প, রাজউকের আওতায় মধ্যবিত্তদের জন্য বহুতল ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্প, ঢাকার মিরপুর-৯ এ মাল্টি-স্টোরেড ফ্যাট বিল্ডিং, পর্যটন করপোরেশনের অধীনে কক্সবাজারে একটি ট্যুরিজম কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্প, সিলেটের শ্রীমঙ্গলে বয়স্কদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল অবসর নির্মাণ প্রকল্প এবং নারায়ণগঞ্জে শ্রমিকদের জন্য ওয়েলফেয়ার সেন্টার ও হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্প।
জানা গেছে, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ মতায় যাওয়ার পর শোরগোল তুলে পিপিপির মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নের তোড়জোড় শুরু হলেও এর মাধ্যমে গৃহীত একটি প্রকল্পও এখনো শেষ করা যায়নি। ২০০৯ সালের পর প্রথম বাজেটেই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত পিপিপির মাধ্যমে অবকাঠামো উন্নয়নে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছিলেন। এরপর প্রতিবছর তিন হাজার কোটি টাকা করে বরাদ্দ থাকলেও ব্যয় না হওয়ায় তা নিয়মিতই ফেরত যায়। পিপিপির আওতায় ২০১১ সালের ৩০ এপ্রিল ভিত্তি স্থাপনের পর ছয় বছরে কাজ এগিয়েছে মাত্র ৯ শতাংশ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ। কয়েক বছর ধরেই পিপিপির মাধ্যমে বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পের একই তালিকা ঝুলছে। এই সংখ্যা ৪৭ দেখানো হচ্ছে সরকারি বিভিন্ন তথ্যে এবং পিপিপির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে। এগুলোর কোনোটির দরপত্র আহ্বান হয়েছে, কোনোটির কাজ শুরুর পর্যায়ে। আবার কোনোটির সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে বা চলবে।
গত অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল দুই হাজার ১১৩ কোটি টাকা। কিন্তু কাক্সিত হারে খরচ হয়নি অর্থ। তাই বরাদ্দ ব্যয়ে হতাশা থাকলেও এবার নেয়া হয়েছে নানা পদপে। এবার আশা করা হচ্ছে, এ েেত্র গতি আসবে। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) রেকর্ডসংখ্যক প্রকল্প যুক্ত করা হয়েছে। এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিঠিতে বলা হয়, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার হিসাব মতে, সরকারের রূপকল্প-২০২১ ও ২০৪১-এর অভীষ্ট ল্েয পৌঁছাতে দেশের ভৌত অবকাঠামো ও সেবা সেক্টরে প্রতি বছর বিনিয়োগ প্রয়োজন মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ছয় ভাগ। অর্থাৎ প্রতি বছর কমপে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। যেখানে পিপিপির মাধ্যমে পূরণের ল্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ দশমিক ৮ ভাগ। অর্থাৎ প্রতি বছর পিপিপি প্রকল্পে বিনিয়োগ হতে হবে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা অবকাঠামো ও সেবা সেক্টরের মোট বিনিয়োগের শতকরা ৩০ ভাগ।
সূত্র জানায়, গত অর্থবছরে এডিপিতে পিপিপির প্রকল্প রাখা হয় ৩৬টি। পরে মার্চ মাসে এসে সংশোধিত এডিপিতে এই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৩০টিতে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এডিপিতে পিপিপি প্রকল্প ছিল ৩২টি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের এডিপিতে ছিল ৪০টি, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের এডিপিতে ৪০ এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে পিপিপি প্রকল্পের সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ ৪৬টি। এর মধ্যে ৪৭টি প্রকল্পের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পিপিপি কর্তৃপ অনুমোদন দিয়েছে। বাকি ৩১টি প্রকল্প বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে পাওয়া গেছে।
বিশ্লেষকরা জানান, পিপিপি প্রকল্পের মেয়াদ বারবার বাড়ানোর কারণে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া সমতার ঘাটতি রয়েছে। আমাদের উচিত সক্ষমতা অনুযায়ী প্রকল্প নেয়া। পাশাপাশি মাথায় রাখতে হবে অর্থায়নের বিষয়টি। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলেও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পূর্ণ আস্থা ফেরেনি দেশের মধ্যে। সে আস্থার উপরই বিনিয়োগ নির্ভর করে। অনেক দিন থেকেই পিপিপিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা শোনা যাচ্ছে। তবে এর বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। যদি পিপিপিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হয়, তাহলে এডিপি বাস্তবায়নে সরকারের দায়ের পরিমাণ কমবে। এটা দেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্য সুখকর হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তার মতে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে না আসার কারণ হচ্ছে, অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ তারা লাভজনক মনে করছে না। হয়তো এ েেত্র কিছু প্রফিট আসবে, তবে দীর্ঘমেয়াদের। তাই এ খাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি বিনিয়োগ করতে চায় না। এ ছাড়া পিপিপির েেত্র প্রকল্প নির্বাচন এবং বাস্তবায়নের পর কালেকশনÑ এসব বিষয়ে জটিলতা রয়েছে। এ ছাড়া পিপিপি এক্সপার্টিজ সমস্যাও রয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলমের মতে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর পিপিপি প্রকল্পে গতি অবশ্যই আসবে। কারণ তার নির্দেশনা হলো অনুশাসন যা মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে মেনে চলতে হয়। উন্নয়ন প্রকল্পে ৩০ ভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশ থাকলে উন্নয়ন প্রক্রিয়া আরো দ্রুততর হবে। পিপিপিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয়েছে। কয়েকটি দৃশ্যমান অগ্রগতি হলে এ খাতে আরো অনেকেই এগিয়ে আসবেন, তখন এর বাস্তবায়ন দ্রুত হারে বাড়বে বলে তিনি মনে করছেন।
সরকারি পর্যালোচনা প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, পিপিপিতে স্থবির থাকা প্রকল্পগুলোতে একক কোনো সমস্যা নয়। বহুমাত্রিক জটিলতার কারণে এসব প্রকল্পে অগ্রগতি হচ্ছে না। এর মধ্যে কোনো প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের জটিলতা, কোথাও দরপত্র আহ্বানে সমস্যা আবার কোথাও প্রকল্পটি নেয়ার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন আছে সাধারণ মানুষের মনে। যেসব প্রকল্প শ্লথ, সেগুলোর দ্রুত সমস্যার সমাধান করে প্রকল্পের কাজে গতি আনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। উদাহরণ হলো, বাগেরহাটে খানজাহান আলী বিমানবন্দর এবং বিশেষ পর্যটন পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ তিন বছর আগে নেয়া হলেও এখন পর্যন্ত কোনো কাজই শুরু হয়নি। পিপিপি অফিসের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে নানা ধরনের জটিলতায় পড়তে হয়েছে। এখন পর্যন্ত জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াই শেষ হয়নি। সে কারণে পরামর্শক নিয়োগও সম্ভব হয়নি।

 


আরো সংবাদ



premium cement