১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

৮০০০ টাকা মজুরির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন

-

দেশের তৈরী পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য শ্রমিক পক্ষ ন্যূনতম মজুরি দাবি করেছিল ১২ হাজার ২০ টাকা। অন্যদিকে মালিকপক্ষ দিতে চেয়েছিলেন ৭০০০ টাকা। শেষ পর্যন্ত স্বয়ং প্রধামন্ত্রীর হস্তক্ষেপে ৮০০০ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। এতে মালিকপক্ষ মোটামুটি সম্মত হলেও এ সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করেছেন শ্রমিকরা। তাদের দাবি, এ টাকা কোনোভাবেই পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। আর মালিকপক্ষ এটিকে দেখছেন মুক্তবাজার অর্থনীতির সূত্র দিয়ে। তাদের মতে, এ টাকায় শ্রমিক পেতে তাদের কোনো সমস্যা হবে না। অর্থনীতির স্বাভাবিক সূত্র অনুযায়ী কম টাকায় শ্রমিক পেলে বেশি টাকা দেয়ার তো কোনো যৌক্তিকতা থাকে না। যদিও মাসিক ৮০০০ টাকা মজুরি কতটা যৌক্তিক সেটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন।
সংবাদ সম্মেলনে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুর ঘোষণা অনুযায়ী, পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি হবে ৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে বেসিক ৪ হাজার ১০০ টাকা, বাড়ি ভাড়া ২ হাজার ৫০ টাকা এবং অন্যান্য ১৮৫০ টাকা। এ কাঠামো আগামী ডিসেম্বরের পর কার্যকর হবে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতি ৫ বছর পরপর বেতন পুনর্মূল্যায়ন করার কথা। সে হিসেবে আগামী ডিসেম্বরে আগের বেতন কাঠামোর ৫ বছর পূর্ণ হবে। নতুন কাঠামো কার্যকর হবে পয়লা জানুয়ারি থেকে। তিনি জানান, পরপর ৫টি বৈঠক করেও শ্রমিক-মালিকরা ঐকমত্যে পৌঁছতে না পারায় প্রধামন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান সিনিয়র জেলা জজ সৈয়দ আমিনুল ইসলাম বলেন, এর আগে ৪টি বৈঠকে ঐকমত্যে আসতে না পারায় উভয়পক্ষ প্রধানমন্ত্রীর কাছে যান। প্রধানমন্ত্রী উভয়পক্ষের কথা শুনে ৮ হাজার টাকা নির্ধারণ করেন।
এ দিকে ন্যূনতম নতুন মজুরি প্রত্যাখ্যান করেছে শ্রমিক সংগঠনগুলো। মজুরি বোর্ডের সভা চলাকালে বেশ কয়েকটি শ্রমিক সংগঠন ১৬ হাজার টাকা সর্বনিম্ন মজুরির দাবিতে তোপখানা রোডে বিক্ষোভ করে। মজুরি ঘোষণার পর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ সমাবেশ করে গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র। সমাবেশ থেকে অবিলম্বে ঘোষিত মজুরি পুনর্বিবেচনা করে ১৬ হাজার টাকা নির্ধারণ করার দাবি জানানো হয়। সমাবেশে নেতারা বলেন, বর্তমান বাজারে ৮ হাজার টাকা দিয়ে কারো পক্ষে জীবনধারণ করা এবং উৎপাদন অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়। ঘোষিত মজুরি অগ্রহণযোগ্য। তারা বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি যেখানে প্রায় ১৮ হাজার টাকা ঘোষিত হয়েছে। সেখানে পোশাক খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি অর্ধেকেরও কম। শ্রমিকরা এই চরম বৈষম্য কখনো মেনে নেবে না।
গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার নয়া দিগন্তকে বলেন, ঘোষিত মজুরির মাধ্যমে শ্রমিকদের সঙ্গে অন্যায্য আচরণ করা হয়েছে। এই মজুরি কোনোভাবেই বাজারদরের সঙ্গে মিল নেই। এরই মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয়েছে ১৭ হাজার টাকার বেশি। অথচ রফতানি আয়ের বড় খাত পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য মজুরি ঘোষণা করা হয়েছে ৮ হাজার টাকা। এ খাতের শ্রমিকদের সঙ্গে এটা প্রতারণা। এই মজুরি প্রত্যাহার করে শ্রমিকদের দাবি ১৬ হাজার টাকা পুনর্বিবেচনার দাবি জানান তিনি।
ঘোষিত মজুরির যৌক্তিকতা প্রশ্নে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, মজুরি পুনর্নির্ধারণের প্রস্তাব আমরাই দিয়েছি। আমরা চাই আমাদের শ্রমিক ভাই-বোনেরা ভালো থাকুক। তারা ভালো থাকলে আমাদের উৎপাদও বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু আমাদের সামর্র্থ্যও দেখতে হবে। তিনি বলেন, মজুরি ঠিক করতে হবে কারখানার সক্ষমতা অনুযায়ী। ধরুন আপনি একটা মজুরি ঠিক করলেন কিন্তু দিতে পারলেন না। অতিরিক্ত চাপে পড়ে কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। তখন তো মালিকের পাশাপাশি শ্রমিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তার মতে, মজুরি বাড়াতে হবে, পাশাপাশি শিল্পও টিকিয়ে রাখতে হবে। তিনি বলেন, সেক্টরের সক্ষমতা বিবেচনায় আমরা চেয়েছিলাম ন্যূনতম মজুরি ৭ হাজার টাকা হোক। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ৮ হাজার টাকা করার নির্দেশ দেয়ার পর আমরা তা মেনে নিয়েছি। ৫১ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি কোনোভাবেই কম নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ঘোষিত মজুরি কোনোভাবেই ন্যায্য নয় মন্তব্য করে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম নয়া দিগন্তকে বলেন, শ্রমঘন পোশাক শিল্প এ দেশে সম্প্রসারিত হয়েছে মূলত শ্রমিকদের ওপর নির্ভর করে। সস্তা শ্রমের কারণেই আমাদের এ শিল্প বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। কিন্তু শ্রমিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণ না করে কোনো শিল্পই চূড়ান্তভাবে সাফল্য লাভ করতে পারে না। সরকার যে মজুরির ঘোষণা দিয়েছে সেটি তাদের নিশ্চিত জীবনযাপনের জন্য কষ্টকর। সিপিডির পক্ষ থেকে ১০ হাজার ২০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেটা ছিল অনেক গবেষণালব্ধ। শ্রমিকদের বেঁচে থাকার জন্য এ টাকা খুবই জরুরি। তিনি বলেন, এখনও সময় আছে। সরকারের উচিত সিপিডির প্রস্তাবটি পুনর্বিবেচনা করা।
তৈরী পোশাক শিল্প খাতের জন্য প্রথম ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয় ১৯৮৫ সালে। সরকার, মালিক এবং শ্রমিকপক্ষ মিলে তখন মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫৪২ টাকা। তিন হাজার ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০১৩ সালে পোশাক খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয় পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা। মাঝে দুই বোর্ড সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করেছিল ৯০০ এবং ১৬৬২ টাকা ৫০ পয়সা। প্রতিবারই মজুরি বোর্ড গঠনের পর মালিক এবং শ্রমিক পক্ষের বাগি¦তণ্ডা হয়েছে, পক্ষে-বিপক্ষে মিছিল-সমাবেশ হয়েছে। তবে প্রতিবারই মালিকপক্ষ জয়ী হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম কোনোরূপ মিছিল-মিটিং-ভাঙচুর করা ছাড়াই তৈরী পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের লক্ষ্যে বোর্ড গঠন করে সরকার। শুধু তাই নয় তৈরী পোশ শিল্পের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ উল্টো সরকারকে অনুরোধ করেছিল এ বোর্ড গঠন করার জন্য। কারণ, বিদ্যমান পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা মজুরি এতটাই কম যে, শ্রমিকদের আন্দোলন ছাড়াই ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতারা এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৪ জানুয়ারি গঠন করা এ বোর্ডের প্রধান নিযুক্ত করা হয় সিনিয়র জেলা জজ সৈয়দ আমিনুল ইসলামকে।
কিন্তু বোর্ড গঠনের পরই দেখা দেয় বিপত্তি। মালিকপক্ষ কোনোভাবেই ছয় হাজার ৩৬০ টাকার বেশি ন্যূনতম মজুরি মেনে নিতে রাজি হচ্ছিল না। অপরপক্ষে শ্রমিকদের দাবি ছিল, বর্তমান দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনায় ন্যূনতম মজুরি কমপক্ষে ১২ হাজার ২০ টাকা নির্ধারণ করতে হবে। দুই পক্ষের এমন দূরতম অবস্থানে শ্রমিক-মালিক সম্পর্কেও দূরত্ব বাড়ছে। আগামী দিনগুলোতে শিল্পের সম্প্রসারণে এর প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।


আরো সংবাদ



premium cement