২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গরিবের চামড়া হরিলুট

-

গরিব-মিসকিনের যক্ষের ধন কোরবানির এক কোটি পশুর চামড়া নিয়ে এবার হরিলুট হয়েছে। সরকারের সহযোগিতায় ট্যানারি মালিকরা পানির দরে কিনে নিয়েছেন এসব চামড়া। তিন হাজার টাকার চামড়া থেকে গরিব-মিসকিনের ভাগ্যে জুটেছে ৩০০ টাকা। অসাধু ব্যবসায়ীদের তৎপরতায় মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানাগুলো বঞ্চিত হয়েছে তাদের পাওনা থেকে। ব্যবসায়ীদর দাবি, পরিস্থিতির শিকার হয়ে তারা চামড়ার উপযুক্ত দাম দিতে পারেননি। এ জন্য সরকার থেকে প্রয়োজনীয় ঋণের ব্যবস্থা না করা, সাভারের চামড়া শিল্পনগরী চালু করতে নজিরবিহীন বিলম্ব এবং ব্যবসায়িক মন্দাকে দায়ী করেন তারা।
ট্যানারি মালিকরা জানান, প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়া ঢাকা শহরে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় কেনার ঘোষণা দেন ট্যানারি মালিকরা। এ ছাড়া সারা দেশে প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়া ১৮ থেকে ২০ টাকা এবং প্রতি বর্গফুট বকরির চামড়ার দর ১৩ থেকে ১৫ টাকা দর নির্ধারণ করা হয়। ট্যানারি মালিকরা ঢাকায় প্রতিটি বড় চামড়া (৩০ থেকে ৩৫ বর্গফুট) এক হাজার ৪০০ থেকে দেড় হাজার টাকায় কিনছেন। মাঝারি চামড়া (২০ থেকে ২৫ বর্গফুট) এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকায় ও ছোট চামড়া (১২ থেকে ১৮ বর্গফুট) ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় কিনছেন মালিকরা। ছাগলের চামড়াও নির্ধারিত দরেই কেনাবেচা হচ্ছে। যদিও কোরবানিদাতা এবং মাদরাসা ও এতিমখানার কাছ থেকে এবার কম দামেই চামড়া কিনেছিলেন আড়তদাররা।
উপেক্ষিত ট্যারিফ কমিশন
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যৌক্তিক দর নির্ধারণের দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন এবার প্রস্তাব প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম গত বছরের চেয়ে পাঁচ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। সরকার উল্টো পাঁচ টাকা করে কমিয়ে দিয়েছে। এ বছর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ঢাকা শহরে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। এ ছাড়া সারা দেশে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়ার দাম হবে ১৮ থেকে ২০ টাকা এবং প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত বকরির চামড়ার দাম নির্ধারিত হয়েছে ১৩ থেকে ১৫ টাকা। গত বছর প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম নির্ধারিত হয়েছিল সর্বনিম্ন ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৫৫ টাকা। একইভাবে কোরবানির খাসির চামড়ার দাম গত বছরের চেয়ে প্রতি বর্গফুটে কমেছে দুই টাকা করে। গত বছর এর দর ছিল ২০ থেকে ২২ টাকা। অন্য দিকে কোরবানির বকরির চামড়াতেও এবার প্রতি বর্গফুটে দুই টাকা করে দাম কমিয়েছে সরকার। গত বছর এই দাম ছিল ১৫ থেকে ১৭ টাকা।
ওদের কোনো প্লাটফর্ম নেই
চামড়ার দাম কমানোর সিদ্ধঅন্তে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রখ্যাত আলেম অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাঈল নয়া দিগন্তকে বলেন, মহান আল্লাহ পাক সামর্থ্যবান মানুষের ওপর কোরবানি ফরজ করেছেন। এর মাধ্যমে গরিব, ইয়াতিম মিসকিনদের স্বার্থটিও তিনি রক্ষা করেছেন। হাজার বছরের ঐতিহ্য অনুযায়ী আমরা কোরবানির পশুর চামড়া কিংবা চামড়া বিক্রয়লব্ধ টাকা গরিব-মিসকিনের মাঝে বিতরণ করি। দেশের লাখ লাখ মসজিদ, মক্তব, মাদরাসা, এতিমখানার আয়ের প্রধান উৎস এই কোরবানির চামড়ার বিক্রয়লব্ধ আয়। এসব অসহায় মানুষ সঙ্ঘবদ্ধ নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, তাদের পক্ষে কথা বলার মতো কোনো প্লাটফর্ম নেই। সরকারের সহযোগিতা নিয়ে ফড়িয়ারা নামমাত্র মূল্যে গরিবের সম্পদ নিয়ে যাচ্ছে। ধনীরা কোরবানি দিয়ে গোশত খাচ্ছেন আর গরিবের হক চামড়া বিক্রি করে দিচ্ছেন পানির দরে। এতে করে বঞ্চিত হচ্ছেন দেশের কয়েক কোটি ফকির-মিসকিন। এরা এমনিতেই দুর্বল, তাদের অধিকার কেড়ে নিয়ে ধনীরা সম্পদের পাহাড় গড়ছেন আর দরিদ্ররা ক্রমেই গরিব হচ্ছে।
ট্যানারি মালিকদের ব্যাখ্যা
চামড়া শিল্পের বর্তমান দুরবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, গত বছর যেসব কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল তারা এখনো উৎপাদনে যেতে পারেনি। আর আস্থার সঙ্কটের কারণে দীর্ঘ দিনের বিদেশী ক্রেতারা অন্য দেশে চলে গেছেন। কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে যেসব ক্রেতা ফিরে গেছেন তাদের আনা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। চীন প্রচুর রফতানি আদেশ বাতিল করেছে। গত বছরের ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ চামড়া মজুদ আছে। এ বছরও বিক্রির কোনো নিশ্চয়তা নেই। তিনি বলেন, চামড়া শিল্পনগরী চালুর উপযুক্ত হওয়ার অনেক আগেই আমাদেরকে সেখানে ট্যানারি স্থানান্তরে বাধ্য করা হয়েছে। স্থানান্তরিত চামড়া শিল্পনগরীতে পরিবেশসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা এখনো নিশ্চিত হয়নি। নগরীর এ অসম্পূর্ণতার কারণে বিদেশী ক্রেতা আকৃষ্ট হচ্ছে না।
সরকারি ব্যাখ্যা
গত বছরের চেয়ে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম কমার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, মূলত দুটি কারণে এবার কোরবানির পশুর চামড়ার দাম কমানো হয়েছে। প্রথম কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার চাহিদা ব্যাপক হারে কমেছে। দ্বিতীয়ত, সাভারে চামড়া শিল্পনগরী স্থাপিত হলেও এখন পর্যন্ত তা পরিপূর্ণভাবে কাজ শুরু করতে পারেনি। নানা ধরনের ত্রুটি রয়েছে সেখানে। যে কারণে সেখানে এখনো ঠিকভাবে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব হচ্ছে না। সরকার চামড়া ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তোফায়েল বলেন, ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করার অর্থ জিম্মি হওয়া নয়। দেশের এই ব্যাপক উন্নয়নে ব্যবসায়ীদের অবদান অনস্বীকার্য। আমরা ব্যবসায়ীদের বন্ধু। সবাই দেশকে ভালোবাসি। তাই ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করতেই দর কম করে নির্ধারণ করে দিয়েছি।
সমস্যার মূলে চামড়া শিল্পনগরী
চামড়া সঙ্কটের মূলে রয়েছে সাভারের চামড়া শিল্পনগরী। মূলত লালবাগের অপরিকল্পিত ট্যানারিগুলোকে স্বাস্থ্যসম্মত স্থানে স্থানান্তরের জন্যই এ উদ্যোগ। কিন্তু সময়ের কাজ সময়ে না হওয়ায় সৃষ্টি হয় বিপত্তি। প্রকল্পটি নেয়া হয় ২০০৩ সালে। তিন বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০০৫ সালে। অনুমোদিত বরাদ্দ ছিল ১৭৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। বাড়তে বাড়তে বরাদ্দ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকায়। ব্যয় বেড়েছে ৯০২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। তিন বছরের প্রকল্প গড়িয়েছে ১৭ বছরে। সর্বশেষ আরো দুই বছর সময় বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত। কাগজে-কলমে এখন পর্যন্ত কাজ হয়েছে ৯০ শতাংশ। এ কারণেই চামড়াশিল্প বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে বলে জানান বিশ্লেষকরা।
আয় ক্রমেই কমছে
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাব অনুযায়ী চামড়া এখনো দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত। কিন্তু এ অবস্থা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। কারণ সম্ভাবনা যা-ই থাকুক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি থেকে আয় দিন দিন কমছে। চামড়াকে সরকার ২০১৭ সালের ‘বর্ষপণ্য’ ঘোষণা করে। কিন্তু ওই বছরের রফতানি পরিস্থিতি মোটেও ভালো নয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে রফতানি আয় হয়েছে ১০৮ কোটি ডলার যা ল্যমাত্রার তুলনায় ২১ দশমিক ৩৪ শতাংশ কম। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় ১২ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ কম। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ উৎস থেকে আয় হয়েছে ১২৩ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার।

 


আরো সংবাদ



premium cement
ফরিদপুরে নিহতদের বাড়ি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী টিকটকে ভিডিও দেখে পুরস্কার, প্রভাব ফেলছে মানসিক স্বাস্থ্যে পাট শিল্পের উন্নয়নে জুট কাউন্সিল গঠন করা হবে: পাটমন্ত্রী মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেও নেতাকর্মীরা আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে : সালাম নবায়নযোগ্য জ্বালানি ৪০ শতাংশে উন্নীত করতে কাজ করছে সরকার : পরিবেশ সচিব সৌরশক্তি খাতে আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে চায় জার্মানি ‘সরকারের সদিচ্ছার অভাবেই বিচার প্রক্রিয়ার ধীর গতি’ মোদি কি হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণের চেনা রাজনীতিতে ফিরছেন? টাঙ্গাইলে বৃষ্টির জন্য ইসতেসকার নামাজ ফুলগাজীতে ছাদ থেকে পড়ে স্কুলছাত্রের মৃত্যু দোয়ারাবাজারে শিশু হত্যা মামলার আসামিসহ গ্রেফতার ২

সকল