২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পোশাক খাতের সংস্কার ও অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের বিদায়

-

ভয়াবহ রানা প্লাজা ধসের মাধ্যমে দেশের তৈরী পোশাক শিল্পখাত মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেও এর ধারাবাহিকতায় ব্যাপক সাফল্য এসেছে সম্ভাবনাময় এ খাতে। মোটা অংকের বিনিয়োগের মাধ্যমে সংস্কার হয়েছে দেশের হাজার হাজার শিল্পকারখানা। কাজের উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় ১২০০ কারখানা বন্ধ করা হয়ে গেলেও অবশিষ্ট কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ উন্নত হয়েছে। কিন্তু হতাশার দিক হলো, প্রয়োজনীয় ব্যবসায়িক মানসিকতার অভাবে এত সংস্কার সত্ত্বেও কাক্সিত ফল মিলছে না। অনৈতিক প্রতিযোগিতার ফলে বাড়তি দাম না দিয়ে এ দেশ থেকে পোশাক কিনতে পারছেন বিদেশীরা। পক্ষে-বিপক্ষে কথা আছে অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের বিদায় নিয়েও।
জানা যায়, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর গত পাঁচ বছরে দেশের তৈরী পোশাক শিল্পখাতে ব্যাপক সংস্কার হয়েছে। বিশেষ করে নিরাপত্তাসহ শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক খাতে তেমন পরিবর্তন আসেনি। খরচ বাড়লেও এ খাতে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার তেমন বাড়েনি। তবে সামাজিক খাতে পরিবর্তন হলেও বড় ও ছোট কোম্পানিগুলোর মধ্যে বৈষম্য রয়েই গেছে। যে পরিমাণ বাড়তি বিনিয়োগ হয়েছে সে অনুপাতে বিদেশী ক্রেতারা পণ্যের দাম বাড়ায়নি। এমতাবস্থায় চলমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ব্যাপক বিনিয়োগ দরকার বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে পোশাক খাতের সংস্কারবিষয়ক ইউরোপের ক্রেতাজোট অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশের (অ্যাকর্ড) কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি। নতুন করে মেয়াদ বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছে অ্যাকর্ড। এ বিষয়ে সরকারকে রাজি করাতে উন্নয়ন সহযোগী এবং কূটনীতিকদের কাছে ধরনা দিয়ে যাচ্ছেন জোটের নেতারা। অ্যাকর্ডের মেয়াদ আর না বাড়াতে আদালতের প্রথম দফা নিষেধাজ্ঞার পর এ বিষয়ে প্রভাব খাটাতে সরকারকেও সরাসরি অনুরোধ করা হয়েছে। তবে সব অনুরোধ আমলে নেয়নি সরকার। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই শেষ হচ্ছে বাংলাদেশে অ্যাকর্ডপর্ব। বাংলাদেশে অধিককাল কাজ করার ইচ্ছা অপূর্ণ রেখেই কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে হতে পারে ২০০ ব্র্যান্ডের এ জোটকে।
বর্তমান মেয়াদ শেষ হওয়ার পরই দ্বিতীয় মেয়াদে ‘সেকেন্ড অ্যাকর্ড’ নামে আগের মতোই স্বাধীনভাবে সংস্কার কাজ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অ্যাকর্ড। গত বছরের ২৭ অক্টোবর নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে অ্যাকর্ডের অংশীদারদের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়। তবে জোটের অনেক অংশীদার এখনও এতে সই করেননি। ২০০ ব্র্যান্ডের মধ্যে ১৪০টি ব্র্যান্ড মেয়াদ বাড়াতে সম্মত বলে সমকালের কাছে দাবি করেছেন অ্যাকর্ডের প্রধান নির্বাহী রব ওয়েজ। জোটের দাবি, এতেই ১২০০ কারখানায় বর্ধিত মেয়াদে কার্যক্রম চালানো সম্ভব হবে। তবে দ্বিতীয় মেয়াদে কাজ চালিয়ে নিতে সরকারের সঙ্গে নতুন করে চুক্তি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এখন পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে এ ধরনের কোনো চুক্তি হয়নি।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিসটিক্স রিভিউ ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিশ্বের মোট পোশাক রফতানির ৩৪ দশমিক ৯ শতাংশ বর্তমানে চীনের দখলে। তবে গেল বছর দেশটির পোশাক রফতানি ৭ শতাংশ কমে গেছে। দ্বিতীয় বাংলাদেশ। তৃতীয় শীর্ষ পোশাক রফতানিকারক দেশ ভিয়েতনাম গত বছর ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে। তাদের প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত গত বছর ১৮০০ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে। গত বছর বিশ্বের মোট রফতানিকৃত পোশাকের ৬ দশমিক ৫ শতাংশ বাংলাদেশের। ২০১৬ সালে যা ছিল ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। বৈশ্বিক বাজারের ৩ দশমিক ৩ শতাংশ অংশ নিয়ে পঞ্চম স্থানে রয়েছে তুরস্ক। এর বাইরে ২৮ দেশের জোট ইইউ গত বছর রফতানি করেছে ১১ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের পোশাক।
এ দিকে বহির্বিশ্বে স্বার্থান্বেষী মহলের নেতিবাচক প্রচারণা সত্ত্বেও বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পখাতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রয়েছে জানিয়ে শিল্পমন্ত্রী বলেন, তৈরী পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আছে। বহির্বিশ্বে একই ধরনের নেতিবাচক প্রচারণা সত্ত্বেও সরকার এবং উদ্যোক্তাদের দৃঢ়তায় বাংলাদেশী চামড়া শিল্পখাত অব্যাহত প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খাত থেকে বাংলাদেশের রফতানি আয় হয়েছে ৩০ দশমিক ৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ২৮ দশমিক ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত এক দশকে আমাদের জুতা রফতানির পরিমাণ ৭ গুণ বেড়েছে।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজাধসের পর একই বছরের ১৫ মে ইউরোপের ২০টি দেশসহ উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার ২০০ ব্র্যান্ড এবং খুচরা ক্রেতা ও কয়েকটি ট্রেড ইউনিয়নের সমন্বয়ে অ্যাকর্ড গঠিত হয়। সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, ৫ বছরের নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হয়েছে গত মে মাসে। তবে সরকারের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে অতিরিক্ত ৬ মাস সময় এ দেশে কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়েছে অ্যাকর্ড এবং অপর ক্রেতাজোট উত্তর আমেরিকার অ্যালায়েন্সকে। বর্ধিত সেই মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী নভেম্বরে। এর মধ্যেই গত ৯ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন বাংলাদেশে অ্যাকর্ডের কার্যক্রম নিয়ে চূড়ান্ত রায় দিয়েছে। আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে অ্যাকর্ডকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এ সময় পর্যন্ত সরকার গঠিত ট্রানজিশন মনিটরিং কমিটির (টিএমও) তত্ত্বাবধানে কাজ করতে বলা হয়েছে তাদের।
এ দিকে ২০১২ সালে সংঘটিত সাভারের রানাপ্লাজা দুর্ঘটনার মতো আর কোনো দুর্ঘটনা আগামীতে ঘটবে না বলে আশা করছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মো: মুজিবুল হক। তিনি বলেন, গত পাঁচ বছরে রানাপ্লাজার মতো দুর্ঘটনা ঘটেনি। চ্যালেঞ্জ করছি, আগামীতেও আর ঘটবে না। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক ক্রেতাজোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের মেয়াদ শেষ হয়েছে চলতি বছরের মে মাসে। কারখানা সংস্কার তদারকিতে তাদেরকে ছয় মাস সময় দেয়া হয়েছে। তারা নতুন করে সময় চাচ্ছে। কিন্তু আমরা আর তাদের সময় বাড়াব না। রেমিডিয়েশন কো-অর্ডিনেশন সেল বা সংস্কারকাজ সমন্বয় সেল (আরসিসি) গঠন করা হয়েছে। এখন আমরাই কারখানা সংস্কারকাজের তদারকি করতে পারব। কারণ অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স আমাদের প্রকৌশলী দিয়েই কাজ করিয়েছে।
প্রতিমন্ত্রী জানান, সংস্কারকাজ সমন্বয় সেলের (আরসিসি) এ পর্যন্ত ৩০টির বেশি সভা হয়েছে। ৭৫৫টি কারখানা এখন পর্যন্ত তাদের সংস্কারকাজ সম্পন্ন করতে পারেনি। এসব কারখানাকে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে সংস্কারকাজ সম্পন্ন না করলে তাদের কারখানা বন্ধ করে দেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তিনি। তিনি বলেন, আরসিসির সমতা বাড়াতে ইতোমধে ৬০ জন প্রকৌশলী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাদের ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম শেষ হয়েছে। শিগগিরই আরও ৪০ জনকে নিয়োগ দেয়া হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন সংস্থার কর্মীসহ ১৩০ জন এখানে কাজ করবে এ সংস্থায়।
অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের অনুপস্থিতিতে রানাপ্লাজার মতো দুর্ঘটনা হতে পারে- বিদেশীদের এমন আশঙ্কার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের অবস্থান জানতে চাইলে শ্রমপ্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের কারখানার সংস্কারকাজের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স, তারা নিজেরাই বলেছে, আমাদের ৯৬ থেকে ৯৯ শতাংশ কারখানার সংস্কারকাজ সম্পন্ন হয়েছে। তিনি বলেন, গত পাঁচ বছরে রানাপ্লাজার মতো দুর্ঘটনা ঘটেনি। চ্যালেঞ্জ করছি, আগামীতেও আর ঘটবে না।
অ্যাকর্ডভুক্ত ক্রেতারা যেসব কারখানা থেকে পোশাক নেয় এরকম দুই হাজার ৯৬টি কারখানাকে প্রাথমিক পরিদর্শনের জন্য বাছাই করা হয়। এর মধ্যে ১৬৩১টি কারখানার প্রাথমিক পরিদর্শন শেষ হয়েছে। নতুন করে পরিদর্শনের কথা রয়েছে ৭৪টির। ৪৯টিকে জাতীয় কর্মপরিকল্পনার আওতায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বন্ধ রয়েছে ৮৮টি। সংস্কার অগ্রগতি দেখাতে ব্যর্থতার অভিযোগে ৯৬টির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়েছে। স্থানান্তর আবশ্যক হওয়া বাকি ৫৮টি কারখানা এখন আর অ্যাকর্ডের আওতায় নেই। তবে অ্যাকর্ডের তত্ত্বাবধানে প্রাথমিক পরিদর্শনে চিহ্নিত ভবনের কাঠামো, অগ্নিনিরাপত্তা ও বৈদ্যুতিক নিরাপত্তাসংক্রান্ত ত্রুটির ৮৪ ভাগ ইতোমধ্যে সংশোধন হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল