২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পুঁজিবাজারে শৃঙ্খলা ফেরাতে হার্ড লাইনে বিএসইসি

-

পুঁজিবাজারের শৃঙ্খলা ফেরাতে এবার হার্ড লাইনে যেতে হলো পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি)। সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজারের কয়েকটি স্বল্প মূলধনী ও মৌলভিত্তির দিক থেকে ফিছিয়ে থাকা কোম্পানির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপ নেয়। গত ১৬ আগস্ট বৃহস্পতিবার সংস্থাটির পক্ষ থেকে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়। সংস্থাটি আশা করছে, এর মাধ্যমে বাজার স্বাভাবিক আচরণে ফিরবে।
ডিএসই কর্তৃক দুই কোম্পানির তালিকাচ্যুতির পর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে ট্রেড স্থগিতের মতো পদক্ষেপ নিতে হয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটিকে। বৃহস্পতিবার বিএসইসি তিনটি কোম্পানির ট্রেড আগামী ৩০ কার্যদিবসের জন্য সাসপেন্ড করে। কোম্পানি তিনটি হলোÑ মুন্নু স্টাফলার, লিগেসি ফুটওয়্যার ও বিডি অটোকরস। একই সাথে লিগেসি ফুটওয়্যার ও বিডি অটোকারসের অস্বাভাবিক কারণ খতিয়ে দেখতে কমিশন দুই সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটি আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে এ সংক্রান্ত বিপোর্ট বিএসইসিতে জমা দেবে। একই সঙ্গে অন্য পাঁচটি কোম্পানিকে বাধ্যতামূলক স্পট ট্রেডিংয়ে নিয়ে আসে। এখন থেকে এ পাঁচটি কোম্পানির শেয়ার কিনতে নগদ টাকা দরকার হবে। ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে এ তিনটি পদক্ষেপ কার্যকর হবে।
এর আগে একই কারণে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে গত ১৮ জুলাই দু’টি কোম্পানিকে তালিকাচ্যুত করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ। কোম্পানি দু’টি হলোÑ রহিমা ফুড করপোরেশন ও মডার্ন ডাইং লিমিটেড। কোম্পানি দু’টি ১৯ জুলাই থেকে আর স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত নেই। কিন্তু ডিএসইর এ সিদ্ধান্তে সংশ্লিষ্ট সব মহল থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেলেও তাতে বাজার পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি। দু’-একদিন পুঁজিবাজারগুলো কিছুটা স্বাভাবিক অচরণ করলেও আবার আগের আচরণে ফিরে যায়। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধ সম্ভব হয়নি। বাজার আচরণকে স্বাভাবিক করতে তাই নতুন করে হস্তক্ষেপ করতে হলো নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে।
ট্রেড সাসপেন্ডের তালিকায় থাকা কোম্পানি মুন্নু জুট স্টাফলার্সের শেয়ার দর বৃদ্ধি শুরু হয় চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি থেকে। ওইদিন কোম্পানির শেয়ারটির দর ছিল ৬৬৯ টাকা ৮০ পয়সা। গত সাত মাসে দর বেড়ে হয়েছে সাত গুণ। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার কোম্পানিটির শেয়ার চার হাজার ৬৩৯ টাকায় লেনদেন হয়। ওইদিন সার্কিট ব্রেকারের সর্বোচ্চ দরেই কোম্পানিটির বেশির ভাগ শেয়ার হাতবদল হয়েছে। এমনকি দিনের একটি বড় অংশ বিক্রেতার অভাবে লেনদেন বন্ধ ছিল। অথচ স্বল্প মূলধনের কারণে শেয়ার সংখ্যার ছাড়া কোম্পানির মৌলভিত্তি বিচার করলে খুব আহামরি কিছু দেখা যায় না। একমাত্র কোম্পানির রিজার্ভ রয়েছে এক কোটি ৬৩ লাখ টাকা। শেয়ার সংখ্যা মাত্র চার লাখ ৬০ হাজার। অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ’১৮) শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে এক টাকা ৪৩ পয়সা। এর আগের বছর একই সময়ে ইপিএস ছিল ২৩ পয়সা।
আর অর্থবছরের মোট ৯ মাসে (জুলাই ’১৭ -মার্চ ’১৮) কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে দুই টাকা ৯৫ পয়সা। গত হিসাব বছরের একই সময়ে ইপিএস ছিল ৬০ পয়সা। এ মৌলভিত্তির একটি কোম্পানির শেয়ার স্বাভাবিক দর হওয়া উচিত ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। তাও আবার মৌলভিত্তি বিচারে নয়, শেয়ার স্বল্পতার কারণে। অথচ মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় ৭৫০ টাকা থেকে কোম্পানিটির শেয়ারদর ছাড়িয়ে গেছে সাড়ে চার হাজার টাকা। লেনদেন স্থগিত হওয়া অপর কোম্পানি বিডি অটোকার্সের শেয়ারদর গত ২৮ মে ছিল ১০৯ টাকা ৩০ পয়সা। এরপরই শুরু হয় অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি। গত ৫ জুলাই দর বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫০ টাকায়। বৃহস্পতিবার শেয়ারটির সর্বশেষ লেনদেন হয় ৪৩৭ টাকায়।
আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোম্পানির রিজার্ভ লোকসান রয়েছে দুই কোটি ৭৯ লাখ টাকা। শেয়ার সংখ্যা ৩৮ লাখ ৬২ হাজার ৫১২টি। এর মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকের কাছে রয়েছে ৩৮.২৫ শতাংশ শেয়ার। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর কাছে রয়েছে ৭.৪৬ শতাংশ শেয়ার এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে ৫৪.২৯ শতাংশ শেয়ার।
বিডি অটোকার্স বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ ’১৮) শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৪০ পয়সা। এর আগের বছর একই সময়ে ইপিএস ছিল ২২ পয়সা। আর বিগত ৯ মাসে (জুলাই ’১৭ -মার্চ ’১৮) কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৮৩ পয়সা। গত হিসাব বছরের একই সময়ে ইপিএস ছিল ৩৫ পয়সা। মোট শেয়ারসংখ্যা ৪৩ লাখ। টানা লোকসানের কারণে চলতি অর্থবছরের হিসাবে ৩১ মার্চ শেষে কোম্পানির ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ার প্রতি প্রকৃত সম্পদ মূল্য (এনএভি) দাঁড়িয়েছে তিন টাকা ৬০ পয়সা।
গত ৮ মে লিগেসি ফুটওয়্যারের শেয়ারের দর ছিল ৫৫ টাকা ৬০ পয়সা। এরপর বাড়তে থাকে শেয়ার দর কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য ছাড়া। গত ২৮ জুনের পর শুরু হয় অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি। গত সাড়ে তিন মাসে প্রায় পাঁচগুণ হয়েছে শেয়ারটির দর। সম্প্রতি শেয়ারটির সর্বোচ্চ দর ওঠে প্রায় ২৮০ টাকা। বৃহস্পতিবার শেয়ারটি সর্বশেষ ২৬৩ টাকায় কেনাবেচা হয়েছে।
কোম্পানির রিজার্ভ রয়েছে সাত কোটি ৭৭ লাখ টাকা। শেয়ার সংখ্যা এক কোটি ১৩ লাখ ৭৩ হাজার ৮৯৬টি। তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ ’১৮) কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৫৬ পয়সা।
এর আগের বছর একই সময়ে লোকসান ছিল চার পয়সা। আর অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই ’১৭-মার্চ ’১৮) কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৩৮ পয়সা। গত হিসাব বছরের একই সময়ে ইপিএস ছিল পাঁচ পয়সা।
তিনটি কোম্পানিতেই মূলধনের স্বল্পতা ছাড়া মৌলভিত্তির কোনো উল্লেখযোগ্য উপাদান নেই যা কোম্পানিগুলোর শেয়ারের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিক কারণ হতে পারে। শুধু স্বল্প মূলধনকে পঁুঁজি করেই এক শ্রেণীর বাজার খেলোয়াড়েরা উল্লিখিত কোম্পানিগুলো নিয়ে অনৈতিক খেলায় মেতে উঠেছে। আর এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ ধরনের পদক্ষেপ সামনের দিনগুলোতে পুঁজিবাজারকে স্বাভাবিক করবে এমন প্রত্যাশা থাকলেও তারা সন্দিহান। কারণ তালিকাচ্যুতির মতো ঘটনা যেখানে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি, সেখানে বিএসইসির নেয়া পদক্ষেপ কতটুকু কাজ করবে তা একমাত্র ভবিষ্যৎই বলতে পারে। তবু পুঁজিবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বিশেষ করে এখানে সক্রিয় ২০ লক্ষাধিক বিনিয়োগকারীর প্রত্যাশা, নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ তদারকি বলবৎ থাকবে। বাজারকে শৃঙ্খলায় ফিরাতে শুরু বিধি সংস্তার নয়, নিয়মিত তদারকির দ্বায়িত্বও পালন করবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।


আরো সংবাদ



premium cement