২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পর্যটন শিল্পের বেহাল দশা

-

কক্সবাজার, বান্দরবান, সিলেটের বিছানাকান্দিসহ দেশের পর্যটন স্পষ্টগুলোতে ভ্রমণপিপাসুরা পরিবার নিয়ে বেড়াতে গিয়ে প্রতিনিয়ত হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। কোথাও কোথাও টাকা দিয়ে টিকিট কেটে পর্যটন স্পটে বিপদে পড়ছেন। যার কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সৌন্দর্য উপভোগ করার বদলে কোনোমতে জীবন নিয়ে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, পর্যটন স্পটগুলোতে সরকারিভাবে সঠিক পরিচর্যা না হওয়ার কারণে ভ্রমণপিপাসুরা একদিকে যেমন হাজার হাজার টাকা খরচ করে বিনোদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনি লুটপাটের কারণে লাভজনক এ খাত থেকে সরকার আজো কোনো লাভের মুখ দেখতে পারছে না।
বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা দেশীয় পর্যটনের বেহাল অবস্থার কথা অকপটে স্বীকার করে নয়া দিগন্তকে বলেন, পর্যটন করপোরেশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা-কর্মচারী ও এ পেশার সাথে সংশ্লিষ্টদের খামখেয়ালিপনা ও লুটপাটের কারণে মূলত পর্যটন শিল্প এগিয়ে যাওয়ার বদলে দিন দিন আরো অবনতির দিকেই যাচ্ছে। তারা উদাহরণ দিয়ে বলছেন, বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক পর্যটন শিল্পে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, নেপাল এমনকি পাশের দেশ ভারত কোটি কোটি ডলার এ খাত থেকে উপার্জন করছে। অথচ বাংলাদেশের চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত।
এই অধঃপতনের কারণ বলতে গিয়ে তারা এ প্রতিবেদককে বলেন, পর্যটন স্পটগুলোতে চরম দুরবস্থা বিরাজ করার পাশাপাশি পুরনো আমলের পর্যটন করপোরেশনের হোটেল-মোটেলে এখন আর কেউ টাকা খরচ করে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। ফলে সরকার প্রতি বছর নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করার পরও এ খাত অবহেলিতই রয়েছে। সব কিছু থাকার পরও লাভের মুখ দেখতে পারছে না। এখন যাদের কারণে এই দুরবস্থা তাদের চিহ্নিত করে নতুনদের হাতে দায়িত্ব তুলে দেয়া উচিত।
সম্প্রতি বাংলাদেশের সৌন্দর্যের লীলাভূমি বান্দরবানের নীলাচল ও মেঘলা ঘুরতে গিয়ে ঢাকার একাধিক পরিবার বিপাকে পড়েন। তারা ভাঙা রাস্তা পেরিয়ে নীলাচলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারলেও পর্যটন করপোরেশনের অধীন মেঘলায় প্রবেশ পথ পিচ্ছিল হওয়ায় টিকিট কেটেও ঢোকার পরও ফিরে আসতে বাধ্য হন। শুধু বান্দরবান নয়, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, সিলেটের সীমান্ত লাগোয়া বিছনাকান্দি গিয়ে হাজার হাজার পর্যটক প্রতিনিয়ত ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
পাহাড় ঘেরা বান্দরবানের রাস্তাঘাট সুন্দর ও গোছানো হলেও শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরত্বের নীলাচল যেতে ভাঙাচোরা রাস্তায় কাহিল হতে হচ্ছে নারী শিশুসহ সব বয়সের পর্যটকদের। নীলাচল যে কত নানন্দিক তা চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। বলছিলেন পরিবার নিয়ে ঘুরতে যাওয়া ঢাকার পর্যটক মাসুদ রানা ও তার ছোট মেয়ে ইকরা। পর্যটকরা বান্দরবান শহর থেকে জনপ্রতি ২০০ টাকা খরচ করলেই চাঁন্দের গাড়িতে উঠে চলে যেতে পারেন আকর্ষণীয় স্পটিতে। এই স্পট দেখতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সববয়সী পর্যটকরা ছুটে আসেন। তবে বাদ সাধে শহরের আশপাশে থাকা আরেক নান্দনিক স্পট ‘মেঘলা’। সেখানে পর্যটকরা পর্যটন করপোরেশনের কাউন্টার থেকে টিকিট কেটেই ভেতরে ঢুকে নিচের ঢাল জায়গা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে বিপাকে পড়েন। এ সময় অনেক পর্যটক পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিলেন। উপায় না পেয়ে ২৫ পর্যটকের মধ্যে চার-পাঁচ জন ঝুঁকি নিয়ে গেলেও বাকিরা হতাশ হয়ে ফিরে যান।
মেঘলার ঝুলন্ত ব্রিজ পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসা ঢাকার বাসিন্দা মীম ও ইমন আব্দুল্লাহ এ প্রতিবেদককে বলেন, আমরা প্রত্যেকে ৫০ টাকা করে টিকিট কেটে স্পটে যাই। ভেতরে যেতে ঢালু জায়গা দিয়ে হেঁটে যেতেই বাধে বিপত্তি। এক কদম হাঁটলে পা পিছলে যায়। কোনো মতে রড ধরে ঝুলন্ত ব্রিজ পর্যন্ত যাই। এরপর আবার দ্রুত ফিরে আসি। কারণ ফেরার পথে আরো বেশি পিচ্ছিল থাকে। অনেকেই এ সময় সেখান থেকে ফিরে গেছেন বলে জানান। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পর্যটন করপোরেশন টিকিট কেটে লোক ভেতরে প্রবেশ করাচ্ছে কিন্তু ভেতরের যে কী অবস্থা সেটি কে দেখবে? তাদের মতে, যদি কেউ পিচ্ছিল জায়গা দিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে যান, তাহলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্ভাবনা রয়েছে।
শুধু বান্দরবান নয়, কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েও সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটকরা হতাশ। মিরপুরের বাসিন্দা আকতার হোসেন এ প্রতিবেদককে বলেন, এখনকার চেয়ে ১০-১৫ বছর আগের কক্সবাজার ছিল আরো অনেক সুন্দর ও গোছাল। এখন তো দেখলে মনে হবে কোন ‘বস্তিতে’ এসেছি। একটা সি বিচে ঢোকার পথে যদি টিনের ঝাপড়া দিয়ে ঘর তৈরি করা হয় সেখানকার সৌন্দর্য আর কী দেখার আছে? আগে এলে কক্সবাজার সি বিচে যেমন বালু দেখতাম এখনো তাই দেখছি। উন্নতির মধ্যে দেখছি রাতে পর্যটকদের ঘোরাঘুরি করার জন্য কিছু লাইট পোস্ট লাগানো হয়েছে। পর্যটকরা কক্সবাজার ঘুরতে গিয়ে বিচে এর চেয়ে বেশি কিছু দেখতে পারছেন না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এই কক্সবাজারে পর্যটন করপোরেশনের রয়েছে একাধিক হোটেল-মোটেল। কিন্তু সেগুলোর অবস্থা এতই নাজুক যে, টাকা দিয়ে কেউ সেখানে থাকতে পছন্দ করবেন না। কারণ সেখানে কোনো ধরনের আধুনিকতার ছোঁয়া নেই ?
এ প্রসঙ্গে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে বলেন, আসলে আমাদের পর্যটন যেখানে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ পর্যটন শিল্প দিয়ে লাখ লাখ ডলার আয় করতে পারলেও আমরা শুধু লোকসান করছি। যার কারণে আজো লাভের মুখ দেখতে পারছে না পর্যটন করপোরেশন। এ নিয়ে আপনারা পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলে তার কাছে জানতে চান পর্যটন শিল্প কেন এখনো অবহেলিত? একই চিত্র বিরাজ করছে সৌন্দর্যের আরেক লীলাভূমি সিলেটের নতুন পর্যটন স্পট বিছনাকান্দিতে। এ স্পটে গিয়ে আবার সিলেটে ফেরার পর অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। সেখানে থাকা, খাওয়াসহ প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেয়ার মতো নেই কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা। এসব দেখার দায়িত্ব আসলে কারÑ প্রশ্ন হাজারো পর্যটকের ?
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান খান কবিরের সাথে একাধিকবার টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টার পরও তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।


আরো সংবাদ



premium cement