২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ডেনিমের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ রোলমডেল

-

বিশ্ববাজারে ডেনিমের বিশাল চাহিদা বাংলাদেশও এগিয়ে যাচ্ছে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। বর্তমানে ইউরোপের বাজারে যত ডেনিম রফতানি হয় তার শতকরা ২৭ ভাগই যায় বাংলাদেশ থেকে। চীন এই বাজারে শীর্ষ অবস্থানে থাকলেও ২০১৭ সালে বাংলাদেশ তাকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ডেনিমে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বাংলাদেশের আগে রয়েছে চীন এবং মেক্সিকো। মোট রফতানিতে বাংলাদেশের অংশ শতকরা ১৪ দশমিক ২ ভাগ। ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে প্রায় ১ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ইউরোর ডেনিম জিন্স রফতানি করেছে। এরপর ২০১৭ সালে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ১ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ইউরো। এ ছাড়া রফতানি বেড়েছে দশমিক ৫৮ ভাগ। তবে বালাদেশের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তুরস্কের রফতানি প্রবৃদ্ধি বেশি, ৪ দশমিক ৩৬ ভাগ।
বাংলাদেশে ডেনিমের বাজারসম্পর্কিত বিভিন্ন সমীক্ষা ও গবেষণা বিশ্লেষণ করে জানা যায়, ১৯৮৯ সালে হংকং ও ফিলিপিনসের দুটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে প্রথম যৌথ উদ্যোগে ডেনিম পোশাক তৈরির দু’টি কারখানা স্থাপন করে। তারপরেই শুরু হল বাংলাদেশের ডেনিমের যাত্রা। ১৯৯২ সালের নভেম্বরে বিশ্বের ১১তম ডেনিম সরবরাহকারী দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশ। আগের বছরের তুলনায় সরবরাহ রাতারাতি ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় এই স্বীকৃতি জোটে। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সাল থেকে তৈরী পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশীয় ডেনিম কাপড়ের ওপর নির্ভর করতে শুরু করে।
উদ্যোক্তারা জানান, ডেনিম কাপড়ে তৈরী পোশাকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্ববাজারে রোল মডেল। শুধু পোশাক তৈরিতেই নয় বিশ্ব বাজারে বিশেষ করে ইউরোপীয় মার্কেটে রফতানির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের ডেনিম শীর্ষে অবস্থান করছে। যতটুকু জানা যায় বিশ শতকের মাঝামাঝিতে পশ্চিমা বিশ্বের মার্কিন মুলুকে এর ব্যবহার শুরু হলেও বাংলাদেশ এখন ডেনিমের অন্যতম উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে স্বীকৃত। দেশে ডেনিম পণ্য তৈরি করে এমন কারখানার সংখ্যা প্রায় সোয়া পাঁচ শ’। এসব কারখানার বেশির ভাগই আমদানিকৃত কাঁচামাল-ফেব্রিক্সের ওপর নির্ভরশীল। ডেনিমের ফেব্রিক্স তৈরি করে এমন বড় কারখানার সংখ্যা দেশে ২৭টি। মাত্র তিন দশকের মধ্যেই গড়ে উঠেছে এই ২৭টি বড় বড় ডেনিম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। আরো প্রায় ১৭টি কারখানা প্রক্রিয়াধীন। এই খাতে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করেছেন ৮৩৪ মিলিয়ন ডলার।
ডেনিম খাতে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ বাড়ানোর কারণে বিদেশী ক্রেতারা আগ্রহী হচ্ছেন বাংলাদেশের ডেনিমের প্রতি। প্রধানত তিনটি কারণে বাংলাদেশের ডেনিম পণ্য এখন বিশ্বসেরা। প্রথম কারণ হচ্ছে, ডেনিম ফেব্রিক্সের কাঁচামাল এখন বাংলাদেশেই উৎপাদন হয়। ফলে দাম কম। দ্বিতীয় কারণ হলো, অভিনব ডিজাইন এবং সৃজনশীল ডেনিম পোশাক তৈরিতে বাংলাদেশের নৈপুণ্য। তৃতীয় কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের ডেনিম কারখানাগুলো অত্যাধুনিক এবং ওয়াশিংয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উৎকৃষ্ট। ফলে ডেনিমে উৎপাদিত পণ্যের ফিনিশিং হয় আকর্ষণীয় এবং গুণগত মানে সেরা। মূলত এই তিন কারণেই বাংলাদেশের ডেনিম পোশাকের জনপ্রিয়তা বিশ্বব্যাপী তুঙ্গে। দেশীয় ডেনিম হয়েছে এখন বিশ্বের বিস¥য়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান দফতর ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী গত তিন বছর ধরে ইউরোপের বাজারে ডেনিম পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ শীর্ষে। দিন দিন আরো শক্ত হচ্ছে বিদেশী মুদ্রা আয়ের অবস্থান। ইউরোস্ট্যাটের তথ্য মতে, ২০১৫ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৪৬৫১ মিলিয়ন ইউরোর ডেনিম পণ্য আমদানি করে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকেই রফতানি হয়েছে ১১৭৬ মিলিয়ন ইউরোর ডেনিম পণ্য। ইউরোপের বাজারে ২০১০ সালে ৪৪৪ মিলিয়ন ইউরো, ২০১১ সালে ৫৯১ মিলিয়ন ইউরো, ২০১২ সালে ৭২৫ মিলিয়ন ইউরো, ২০১৩ সালে ৮০৮ মিলিয়ন ইউরো, ২০১৪ সালে ৯৩৯ মিলিয়ন ইউরো, ২০১৫ সালে ১০৩৫ মিলিয়ন ইউরো, ২০১৬ সালে ১৫২৭ মিলিয়ন ইউরো এবং ২০১৭ সালে ১৩২০ মিলিয়ন ইউরোর ডেনিম পণ্য রফতানি হয়েছে বাংলাদেশ থেকে।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, প্রতি বছর ডেনিম কাপড় উৎপাদনে বাংলাদেশের সক্ষমতা রয়েছে ৩৬ কোটি গজ। আর চাহিদা রয়েছে প্রায় ৬০-৬৫ কোটি গজ। ২০২১ সালের মধ্যে এই চাহিদা ১২০ কোটি গজে দাঁড়ালে রফতানি আয়ের আশা করা হচ্ছে প্রায় ৭০০ কোটি ডলার। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ইউরোপের বাজারে ১৭ কোটি পিসের বেশি ডেনিম পোশাক বিক্রি করে আয় করেছে প্রায় ৯৪ কোটি ডলার। অথচ একই সময়ে একই বাজারে চীন বিক্রি করেছে মাত্র সাড়ে ১১ কোটি পিস ডেনিম পোশাক। বিজিএমইএ সূত্র মতে, উচ্চমান ও সাশ্রয়ী মূল্যের পাশাপাশি ফ্যাশনেবল ডেনিমের উৎপাদনকে গুরুত্ব দিয়ে ২০২১ সালে ৫০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কাজ করছেন এ শিল্পখাতের উদ্যোক্তারা। নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতি বছরই ডেনিম কারখানাগুলো তাদের উৎপাদন বাড়াচ্ছে।
ইউনাইটেড স্টেটস ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ডেনিম রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ। রফতানি হয়েছে মোট ১৮ কোটি ৬৩ লাখ ডলারের ডেনিম পোশাক। জিন্সে বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার মূলে রয়েছে ‘ওয়াশ’, যার মাধ্যমে ডেনিম রঙে গাঢ় ও হালকা শেড আনা হয়। একাধিক পোশাক ব্যবসায়ী বলেন, জিন্স বা ডেনিম পোশাক তৈরিতে ওয়াশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টা এমন যে, ওয়াশ ছাড়া জিন্স একেবারেই মূল্যহীন। ওয়াশ করতে বিশাল যন্ত্রের সাহায্যে রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে পোশাককে অনেকক্ষণ ধৌত করা হয়। যন্ত্রটি দেখতে অনেকটা ওয়াশিং মেশিনের মতো, তবে আকারেও অনেক বড়। পরে সিরিস কাগজ দিয়ে ঘসে ও লেজারের সাহায্যে ওয়াশের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। বাংলাদেশে শ্রম সস্তা। তা ছাড়া গ্যাসের দাম এখনো কম। সে জন্য বিদেশী ক্রেতারা সাশ্রয়ী মূল্যের জিন্স তৈরি করতে বাংলাদেশের পোশাক কারখানার দিকে ছুটে আসছেন। এখানকার কারাখানাগুলো বিদেশী ক্রেতাদের প্রতিটি জিনিস গড়ে চার থেকে নয় ডলারে তৈরি করে দেয়।
চট্টগ্রামের ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের মোস্তাফিজ উদ্দিন জানান, বিশ্বের প্রতি তিনজন মানুষের একজন জিন্স পরে। আর শীতপ্রধান দেশে জিন্স ছাড়া তো উপায়ই নেই। তিনি আরো বলেন, ‘বর্তমানে বিশ্বের ডেনিমের বাজার ছয় হাজার কোটি ডলারের। সেখানে আমরা মাত্র ৩৫০ থেকে ৩৭০ কোটি ডলারের ডেনিম পোশাক রফতানি করি। ফলে রফতানি বাড়ানোর সম্ভাবনা আছে। ‘বর্তমানে দেশের ৩০০ থেকে ৪০০ পোশাক কারখানায় ডেনিম পোশাক তৈরি হচ্ছে। অন্য দিকে, ডেনিম কাপড় তৈরির মিল আছে ২৭টির বেশি। সেখানে মাসে তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি গজ কাপড় তৈরি হচ্ছে। তারপরেও চাহিদার ৪০-৫০ শতাংশ চীন, ভারত, পাকিস্তান ও তুরস্ক থেকে আমদানি করা হয়। তবে ব্যবসায়ীরা জানালেন, দেশে কয়েকটি ডেনিম মিল খুব শিগগিরই উৎপাদনে আসবে।
জিন্সে বিশ্বের সেরা ব্র্যান্ডগুলো হলো লিভাইস স্ট্রাউস, ডিজেল, র‌্যাংলার, রিপেন্ড. হুগো বস, জি-স্টার, পেপে, টমি, জ্যাক অ্যান্ড জোনস, কেলভিন কেইন, স্পিরিট। এসবের মধ্যে টমি, জি-স্টার, জ্যাক অ্যান্ড জোনস, কেলভিন কেইন, স্পিরিট বাংলাদেশের কারখানা থেকে জিন্স তৈরি করছে। পাশাপাশি ডেনিম কাপড়ের শার্ট, জ্যাকেট এবং শিশুদের পোশাকও তৈরি হচ্ছে। স্কয়ার ডেনিমের মহব্যবস্থাপক সাঈদ আহমাদ চৌধুরী বলেন, ডেনিম কাপড়ের মানোন্নয়ন ঘটানোয় আগের চেয়ে ভালো করছে কারখানাগুলো। ফলে জি-স্টার, স্পিরিটের মতো বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড এখন বাংলাদেশের ডেনিম দিয়েই তৈরি করছে। এত দিন তাদের তৈরী পোশাকের কাপড় আসত অন্য দেশ থেকে।
জানতে চাইলে বিজিএমইএ-এর সহসভাপতি মাহমুদ হাসান জানান, একসময় ওভেন পোশাকে ভালো করলেও আমরা এখন নিট পোশাকে ভালো করছি। ডেনিমের ক্ষেত্রেও এমন ঘটনাই হয়েছে। বিজিএমইএ-এর সভাপতি বলেন, দেশে ডেনিম কাপড় উৎপাদনে মিলের সংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ডেনিম পোশাক বা জিন্সের রফতানি ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ, দেশেই কাপড় পাওয়ায় দ্রুত পোশাক তৈরি করে পাঠানো যাচ্ছে। ক্রেতারা এটাই চান। অন্য দিকে, ওয়াশের মাধ্যমে মূল্য সংযোজনের সুযোগ থাকায় দেশের উদ্যোক্তারাও জিন্স তৈরিতে ঝুঁকছেন বেশি পরিমাণে।


আরো সংবাদ



premium cement
সাজেকে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ শ্রমিক নিহতের খবরে ঈশ্বরগঞ্জে শোক দুর্যোগে এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু কেন বাংলাদেশে? জবিতে ভর্তি পরীক্ষায় আসন বেড়েছে ৫০টি বিএনপি ক্ষমতায় আসতে মরিয়া হয়ে উঠেছে : ওবায়দুল কাদের মাটির নিচে পাওয়া গ্রেনেড মাইন মর্টার শেল নিষ্ক্রিয় করল সেনাবাহিনী অনির্দিষ্টকালের জন্য অনলাইন ক্লাসে যাচ্ছে জবি, বন্ধ থাকবে পরীক্ষা কুড়িগ্রামে রেলের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদ ক্রিকেট খেলতে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে দেওয়ানগঞ্জের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী শিহাব কিশোরগঞ্জে বৃষ্টির জন্য বিশেষ নামাজ সাতক্ষীরা বৈদ্যুতিক খুটিতে ধাক্কা লেগে মোটরসাইকেলআরোহী নিহত বার্সেলোনাতেই থাকছেন জাভি

সকল