২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

পুঁজিবাজারে তারল্য সঙ্কট ও ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা

-

অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে গত দুই-তিন সপ্তাহ একটানা পতন ঘটেছে পুঁজিবাজার সূচকের। ৩০ এপ্রিল থেকে ২৩ মে ১৫টি কার্যদিবস টানা পতন ঘটে বাজার সূচকের। আর এ সময় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচকটি হারায় প্রায় ৫০০ পয়েন্টে। ২০১০ সালের পুঁজিবাজার বিপর্যয়ের পরও একটানা এতদিন পতন ঘটেনি পুঁজিবাজার সূচকের।
সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের বক্তব্য অনুসারে তারল্য সঙ্কটের কারণেই টানা পতন ঘটছে পুঁজিবাজারে। আর এ তারল্য সঙ্কটে রয়েছে বাজারের প্রধান অংশীদার প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও বিশেষ করে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ইতোমধ্যে বেশিরভাগ ব্যাংকই তাদের সীমার অতিরিক্ত পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে ফেলেছে। এখন নতুন করে বিনিয়োগতো দূরের কথা হাতের শেয়ার বিক্রি করে তা সীমার মধ্যে আনতে হবে। আর এটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে পুঁজিবাজারের জন্য। প্রতিদিনই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিক্রয়চাপ অস্থির করে তুলেছে পুঁজিবাজারকে। ফলে আরো একবার বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে শেয়ারবাজার।
বিশ্বের সব পুঁজিবাজারে মিউচুয়াল ফান্ডসহ অন্যান্য ফান্ডগুলো পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর নিষ্ক্রিয়তায় আমাদের পুঁজিবাজার এখনো অকেকটাই ব্যাংক নির্ভর। আবার ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছুটা অংশগ্রহণ থাকলেও তারাও ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে বাজারে অংশগ্রহণ করেন। ফলে বলতে গেলে ব্যাংকই ভরসা।
কিন্তু ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মনীতি মেনে চলতে হয়। আগে কোন ব্যাংক তার মোট আমানতের ১০ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারতো। কিন্তু ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের পর ব্যাংকগুলো পরিশোধিত মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। কিন্তু এ বিনিয়োগসীমার ২৫ শতাংশ পুরোটা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে হিসাবে নিলে কোনো ক্ষতি ছিল না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ব্যাংকের অতালিকাভুক্ত কোম্পানি, মিউচুয়াল ফান্ড ও বন্ড সব ধরনের বিনিয়োগকেই ২৫ শতাংশের মধ্যে হিসাব করছে যা ব্যাংকগুলোর জন্য ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা সৃষ্টি করেছে।
পুঁজিবাজারের টেকসই স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে খাতটিতে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমার যে সংজ্ঞা বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করেছে তার পরিবর্তন তথা পুনর্বিবেচনা চান সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, আমাদের পুঁজিবাজার এখনো পুরোপুরি পরিপক্ব নয়। কিন্তু ব্যাংকের বিকল্প মূলধনের উৎস হিসেবে পুঁজিবাজারকে পেতে চাইলে এ খাতে স্থিতিশীলতা অত্যন্ত জরুরি। আর একটি স্থিতিশীল পুঁজিবাজার কার্যকর করা গেলে উন্নত বিশ্বের মতো সামনের দিনগুলোতে সরকারের বড় বড় প্রকল্পগুলোতে এ খাত প্রকল্প ব্যয়ের একটি বড় অংশের জোগান দিতে পারে।
২০১০-১১ সালের পুঁজিবাজার বিপর্যয়ের পর সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বাজারকে স্থিতিশীলতায় ফেরাতে নেয়া কয়েকটি সুপারিশের মধ্যে একটি ছিল ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের এক্সপোজার হিসেবে হিসাব না করা। পরে ২০১৪ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের পর এসব বিষয় চাপা পড়ে যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ব্যাংকগুলোর ঋণ আমানত অনুপাত কমিয়ে দেয়ার ঘোষণায় আরো একবার বিপর্যয়ের মুখে পড়ে পুঁজিবাজারগুলো। তারল্য সঙ্কটের আতঙ্কে ব্যাপক দরপতনের শিকার হয় দুই পুঁজিবাজার। পরে ব্যাংকগুলোর মালিকদের চাপে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুটা ছাড় দেয়ায় পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে। ব্যাংকের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া ছাড়গুলো পুঁজিবাজারের জন্য খুব বেশি সম্পর্কযুক্ত না হলেও বাজারে বেশ কয়েক হাজার কোটি টাকার তারল্য প্রবাহের সুযোগ তৈরি হওয়ায় স্বস্তিতে ফিরে ব্যাংকগুলো। এর আগে সরকারের তহবিলের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে জমা রাখার সিদ্ধান্ত জানান অর্থমন্ত্রী। ব্যাংকের এ স্বস্তি পরোক্ষভাবে পুঁজিবাজরেও স্বস্তি ফিরিয়ে আনে। শঙ্কা কাটিয়ে ওঠে পুঁজিবাজার।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বারবার বাংলাদেশ ব্যাংকের নেয়া কিছু পদক্ষেপ পুঁজিবাজারকে অস্থির করে তোলে। অথচ অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা চাইলে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলার কোনো বিকল্প নেই। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ দরকার যা দেশের পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। এ ক্ষেত্রে শুধু তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগকেই এ হিসাবে ধরা বাঞ্চনীয় বলে মনে করেন তারা। এটা করা হলে ব্যাংকগুলোও বারবার নিয়ম লঙ্গনের সংস্কৃতি এড়াতে পারে আবার পুঁজিবাজারও একটি স্বাভাবিক গতি বজায় রেখে স্থিতিশীলতার দিকে এগোতে পারে।
পরে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা পরিশোধিত মূলধনের ২৫ শতাংশ ঠিক রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতার স্বার্থে কিছু কিছু বিনিয়োগকে এ সীমার বাইরে রাখতে পারে। যেমন অতালিকাভুক্ত কোম্পানি ও বিভিন্ন বন্ডে বিনিয়োগ। এটা করা হলে ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য কিছু তহবিল বাড়তি পায়। যেহেতু আমাদের পুঁজিবাজার এখনো পুরোপুরি পরিপক্ব নয় তাই এখানে ব্যাংকই বাজারের মূলশক্তি। মিউচুয়াল ফান্ডগুলো এখনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। তাই মিউচুয়াল ফান্ড অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোপুরি সক্ষমতা ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত পুঁজিবাজারকে সচল রাখতে গেলে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই।
পুঁজিবাজার অর্থনীতির একটি বড় খাত হলেও আমাদের দেশে বিভিন্ন কারণে এটি যথার্থ অবদান রাখতে পারছে না। মূলধন সংগ্রহে বেসরকারি কোম্পানি ও সরকারি প্রকল্পগুলোকে এখনো ব্যাংকের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হয়। তা ছাড়া এ খাতে এখন কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পুঁজিবাজার ভালো হলে এ সুযোগ আরো বাড়বে। কিন্তু বারবার বড় ধরনের বিপর্যয়ে অস্থির থাকতে হচ্ছে পুঁজিবাজারকে। তাই এখানে ব্যাংকের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি যৌক্তিক ও কার্যকর নীতি সহায়তা দিতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকই। আর তা করা গেলে অদূর ভবিষ্যতে সরকারি-বেসরকারি বড় প্রকল্পগুলোতে মূলধন সরবরাহে ব্যাংক নির্ভরতা কমবে।


আরো সংবাদ



premium cement