সিডর-পরবর্তী এক যুগ আশ্রয়কেন্দ্র হলেও হয়নি বেড়িবাঁধ সংস্কার
- গোলাম কিবরিয়া বরগুনা
- ১৬ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০
গতকাল শুক্রবার ছিল সিডর দিবস। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে ঘণ্টায় ২১৫ কিলোমিটার গতির প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল দক্ষিণের জনপদ। এতে মারা যান চার হাজারের বেশি মানুষ। এ ছাড়া অগণিত গবাদিপশুর প্রাণহানির ঘটনা ঘটে এই অবর্ণনীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগে। বাড়িঘর, ফসলি জমি, রাস্তাঘাট, বেড়িবাঁধ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সুন্দরবনের গাছপালার ব্যাপক ক্ষতি হয়।
সুপার সাইক্লোন সিডরের এক যুগ অতিবাহিত হলেও স্বজন হারানোদের কান্না থামেনি আজো। ১১ বছরে জেলার বরগুনা, পাথরঘাটা, বেতাগী, বামনা, আমতলী ও তালতলী উপজেলায় বেশ কয়েকটি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বেশ কিছু বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সংস্কার করা সত্ত্বেও এখনো অনেক বাঁধ সংস্কারহীন অবস্থায় রয়েছে। নতুন করে অনেক বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। প্রকৃতির সাথে প্রতিদিন যাদের যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হচ্ছে, তাদের জন্য বিকল্প কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এখনো করা হয়নি।
উপকূলীয় জেলা বরগুনায় ৩৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। জেলার ৯৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, মহাসেন, ফণীসহ একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায় সাড়ে পাঁচ শ’ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে বাঁধ এখনো সম্পূর্ণ মেরামত হয়নি। এ জন্য বিলীন হয়ে গেছে বহু বসতবাড়ি, গাছপালা এবং কয়েক শ’ একর ফসলি জমি। এসব বাঁধ সম্পূর্ণ মেরামত না হতেই ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আঘাত হানে।
বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ২২টি পোল্ডারে প্রায় ৯৫০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানে ৩৭ কিলোমিটার বাঁধ মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। বাকি বাঁধও মেরামত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
সুপার সাইক্লোন সিডরের ক্ষত চিহ্ন আজো বয়ে বেড়াচ্ছেন স্বজনেরা। সিডরের দুই দিন আগে উপজেলা ঘটখালী ও বৈঠাকাটা গ্রামে থেকে ১৪ জন দিনমজুর পানের বরজের জন্য ধানশিলতা সংগ্রহে ট্রলার নিয়ে সাগরের সুন্দরবন এলাকার দুবলারচরে যায়। সিডরের ভয়াল রাতে তাদেরকে ট্রলারসহ ভাসিয়ে নিয়ে যায় পায়রা নদীর মোহনাসংলগ্ন টেংরাগিরি বনের কাছে। এদের মধ্যে চারজন জীবিত ফিরে এলেও ১০ জন আজো ফিরে আসেনি। এরা হলো : ইউসুফ (৪০), জব্বার (৫৫), সোবাহান (৪২), হোসেন (৫০), খলিল (৩৫), রতন (৪০), সোহেল (১৮), মনিরুল (২৫), দেলোয়ার (২৫) ও আলতাফ (২০)। স্বজনদের হারিয়ে অসহায় সে পরিবারগুলো এখনো মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে।
গুলিশাখালী ইউপি চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আলহাজ মো: নুরুল ইসলাম বলেন, আমার ইউনিয়নের আঙুলকাটা থেকে কলাগাছিয়া পর্যন্ত ২০ কিলোমিটারের মধ্যে বেড়িবাঁধের বাইরে কোনো সাইক্লোন শেল্টার না থাকায় বন্যা বা সাইক্লোন এলে ওই এলাকার জনসাধারণ ঝুঁকিতে থাকেন।
‘কলাপাড়ায় এখনো মৃত্যুকূপে প্রায় তিন হাজার পরিবার’
কলাপাড়া (পটুয়াখালী) সংবাদদাতা জানান, সিডর ট্র্যাজেডির এক যুগে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় বৈপ্লবিক উন্নয়ন হয়েছে। দুর্যোগ ঝুঁকি কমাতে নির্মাণ করা হয়েছে বেড়িবাঁধ। কিন্তু অপরিকল্পিত উন্নয়নে সেই বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ ভেঙে এখনো মৃত্যুকূপে বাস করছে প্রায় তিন হাজার পরিবার। যারা সিডরের পর থেকে প্রতিটি ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে কলাপাড়ার ধুলাসার, মহিপুর, চম্পাপুর ও লালুয়া ইউনিয়নের প্রায় ১০ কিলোমিটার বাঁধভাঙা অরক্ষিত থাকায় বেড়িবাঁধের বাইরে বসবাস করা পরিবারগুলো রয়েছে এখনো ঝুঁকিতে। অথচ সিডরের পর কলাপাড়ায় ২৩টি আবাসন নির্মাণ করা হয়েছিল সহায়-সম্বলহীন বেড়িবাঁধের বাইরের ছিন্নমূল পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের জন্য। সেখানে আশ্রয় হয়েছে মাত্র ৫৪০ পরিবারের। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়ার ঝুঁকিপূর্ণ তিনটি পোল্ডারসহ রাঙ্গাবালীর চালিতাবুনিয়া পোল্ডারের সম্পূর্ণ বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার একটি ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করলেও প্রকল্পের অনুমোদন না হওয়ায় বেড়িবাঁধের বাইরের বিশাল জনগোষ্ঠী এখনো রয়ে গেছে মৃত্যুঝুঁকিতে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০০৭ সালের সিডরে কলাপাড়া উপজেলায় ৯৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে এক হাজার ৭৮ জন। নিখোঁজ রয়েছে সাত জেলে। উপজেলায় গবাদিপশু মারা গেছে চার হাজার ৯৪৪টি। ক্ষতি হয়েছে ৫৫৩টি নৌযানের।
এ দিকে বাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় কলাপাড়ার ধুলাসার, লালুয়া, মহিপুর, লতাচাপলী ও চম্পাপুর ইউনিয়নে বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধের বাইরে সাগর ও নদীর তীরঘেঁষে প্রায় তিন হাজার পরিবার বাস করছে চরম ঝুঁকি নিয়ে। এসব পরিবার সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পুনর্বাসন সহায়তা না পাওয়ায় এখনো রয়ে গেছে মৃত্যু ঝুঁকিতে। যদির সরকার সিডর-পরবর্তী কলাপাড়ায় পাঁচ হাজার ৪৭৩টি পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। ৫৪০ পরিবারের জন্য ব্যারাক হাউজ নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এসব ব্যারাকের অন্তত ২০০ কক্ষে লোকজন থাকছে না।
লালুয়া ইউপি চেয়ারম্যান শওকত হোসেন বিশ্বাস তপন জানান, ১১টি গ্রামের মানুষ যে কত কষ্ট আছে তা কেউ স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। এমন কোনো ঝড় নেই এরা ক্ষতি না হচ্ছে। কিন্তু বাঁধ নির্মাণও হয় না আর ক্ষতিগ্রস্তরা পুনর্বাসন সুবিধাও পায় না।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা